আর্সেনিক মহামারীর আর্থ – সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি


মোকরামপুর মুর্শিদাবাদের অন্যান্য গ্রামের মতনই সাধারণ একটা গ্রাম। পার্থক্য এই এখানে শতকরা 75 জন মানুষই আর্সেনিক রোগাক্রান্ত 12 বছরের পরভানা বেগমের কোনও বর জুটবে না, কারণ সম্প্রতি তার দেহে আর্সেনিক রোগলক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের, যাদের দেহে আর্সেনিক রোগলক্ষণ বেরিয়েছে তারা জানে তাদের অবিবাহিত অবস্থায় এক ঘরে হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। মোকরামপুর এ পর্যন্ত 12 জন মারা গেছে। নিরাময়ের কোনও আশাই গ্রামের লোকেদের নেই 26 বছরের সালামত শেখের জীবনে আর কোনও আশা নেই। তার পা ও হাতের তালু বিকৃত হয়েছে, ফুলে উঠেছে। সারা গায়ে আর্সেনিকের সাদা কালো ছোপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালামত বলেন – “আমি বুঝে গেছি বেশিদিন আর আমি বাঁচব না।

সমাজ মানসে মহামারীর দীর্ঘ প্রভাব


দুই বাংলায় আজ চোদ্দ কোটির মতো মানুষ আর্সেনিক অধ্যুষিত অঞ্চলে বাস করেছেন। চার কোটি মানুষ 50 পি. পি. বি. -এর বেশি মাত্রার আর্সেনিক দূষিত জল পান করছেন এবং কম - বেশি নানা রকম আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এইসব রোগের কোনো চিকিত্সা বা নিরাময় নাই। তবু দায়ে পড়ে লোকে চিকিত্সার আশায় ডাক্তারের কাছে যান ও ওষুধ কেনেন এবং স্বাভাবিক ভাবে ঠকেনও উপার্জন হয় না, বা কম হয়। বরং নানা ভাবে খরচ বাড়ে। ব্যক্তিমানস নিয়েই সমাজমানস তাই সমাজমানসও এর ফলে নির্জীব হয়ে পড়ে ; উন্নতিও ব্যাহত হয়। ইতিহাসে বহু দেশে বহু যুগেই দেখা গেছে মহামারীর দীর্ঘস্থায়ী অশুভ কুপ্রভাব সমাজে থেকেই যায়। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে স্যানিটারি বিপ্লবের পর পাশ্চাত্য দেশসমূহে জন স্বাস্থ্যের যে বিপুল উন্নতি হয়, তা ঐসব দেশকে শিল্প বিজ্ঞানে ও সামগ্রিক ভাবে এগিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপক দারিদ্র্য আর পশ্চাদপরতার ভারতীয় উপমহাদেশে এখন চলছে আই টি বিপ্লব, জিন বিপ্লব, মহাকাশ প্রকল্প ইত্যাদি। সুস্থ সবল শিক্ষিত শৃঙ্খলাপরায়ণ জন সম্পদই যে কোনও দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তা সরকারি নীতিতে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। আর এ দেশে পুরাতন বহাল অন্যান্য সমস্যার ওপর নতুন করে চাপল কালান্তক এই আর্সেনিক সমস্যা।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের ত্বকে নানারকম দাগ, কালো কালো গুটি ও বিকার ঘটে আর্সেনিক বিষণে। অজ্ঞাত ও অশিক্ষার ফলে লোকে সেগুলিকে কুষ্ঠর মতো কোনও সংক্রামক রোগ মনে করে আর্সেনিকে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলেন। গ্রামাঞ্চলে এই রকম আক্রান্ত ব্যক্তিকে একাকী বাঁচার চেষ্টা করতে হয়। গায়ে আর্সেনিকের দাগ হয়েছে এমন স্ত্রী লোকদের অন্য বাড়িতে গৃহস্থালির কাজেও নেওয়া হচ্ছে না, পুরুষ মানুষদেরও জীবিক অর্জনে বিঘ্ন ঘটছে। বিবাহিত জীবনও অনেকের বিনষ্ট হচ্ছে। অবিবাহিত ছেলে - মেয়েদের দেহে আর্সেনিক রোগ লক্ষণ দেখা দিলে তাদের বিয়ে হওয়াই দায় হয়ে পড়ছে। বাংলার মানুষজন খবরের কাগজ ও টি. ভি. -তে গত কয়েক বছরে আর্সেনিক জন - জীবনে যে বিপর্যয় আনছে সে সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। আমরা এবার কাগজের কয়েকটি সংবাদের দিকে দৃষ্টি দিই।

সংবাদ মাধ্যমে আর্সেনিক তান্ডব


“আর্সেনিক তান্ডব, চার মাসে মৃত আট (8) পূর্বস্থলিতে”
আনন্দবাজার পত্রিকা, 26 জুন 2005 সংবাদ শিরোনামা

মোকরামপুর মুর্শিদাবাদের অন্যান্য গ্রামের মতনই সাধারণ একটা গ্রাম। পার্থক্য এই এখানে শতকরা 75 জন মানুষই আর্সেনিক রোগাক্রান্ত 12 বছরের পরভানা বেগমের কোনও বর জুটবে না, কারণ সম্প্রতি তার দেহে আর্সেনিক রোগলক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের, যাদের দেহে আর্সেনিক রোগলক্ষণ বেরিয়েছে তারা জানে তাদের অবিবাহিত অবস্থায় এক ঘরে হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। মোকরামপুর এ পর্যন্ত 12 জন মারা গেছে। নিরাময়ের কোনও আশাই গ্রামের লোকেদের নেই 26 বছরের সালামত শেখের জীবনে আর কোনও আশা নেই। তার পা ও হাতের তালু বিকৃত হয়েছে, ফুলে উঠেছে। সারা গায়ে আর্সেনিকের সাদা কালো ছোপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালামত বলেন – “আমি বুঝে গেছি বেশিদিন আর আমি বাঁচব না। মোকরামপুরে সবার ভাগ্যই তাই। আমার এখনকার কষ্ট অসহ্য”।

মশির শেখের ভাগ্যও ঐ একই রকম। মাত্র 40 বছর বয়সেই সে একটি চলমান মৃতদেহ তারাচাঁদ শেখের কণ্ঠস্বর প্রায় বন্ধ। তার দেহ এখন আর চলে না। মোকরামপুরের শিশুরা নির্জীব, নিস্তেজ 10 বছরের আজিজুল শেখের গা চুলকোয় যা আর্সেনিক বিষণের একটি লক্ষণ।

সৈয়দ আলির সারা গায়ে বুকে পেটে আর্সেনিকের দাগ সে বলল, “কিছু দিনের মধ্যেই ক্ষেতে কাজ করার জন্য আর কেউ থাকবে না”। গ্রামের স্ত্রীলোকদের অবস্থাও মোটেই ভাল নয়। হামিদা বিবির হাতের চেটোতে আর্সেনিকের গুটি, তার কাজ করতে কষ্ট হয়। “কাজ করতে গেলেই যদি কষ্ট হয়, ঝিনঝিন করে, তা হলে আমি কী করে কাজ করি” ?

মুর্শিদাবাদের চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডি এস মিশ্র স্টেটসম্যান পত্রিকা - কে বলেন – “আরও আর্থিক অনুদান নিয়ে গভর্নমেণ্ট এগিয়ে না এলে এই আর্সেনিক মহামারীর মোকাবিলা করা খুবই কঠিন”। মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্বাঞ্চল মারাত্মকভাবে আর্সেনিক বিষণে আক্রান্ত। গরাইমারী, বারোমাসিয়া, ঘোষপাড়া, বৃন্দাবনপাড়া, জয়কৃষ্ণপুর, কাদুপাড়া, নরসিংহপুর প্রভৃতি গ্রামগুলি ভয়ঙ্কর আর্সেনিক পীড়িত। – দি স্টেটসম্যান, 26 জানুয়ারি, 1999 (বেলডাঙ্গা)

রিয়াজউদ্দিন শেখের ডানহাত আর্সেনিক রোগের জন্য কাটতে হয়েছে। এবার একই কারণে তার বাম হাতটিও কাটতে হবে। মজলুর হকেরও ডান পা হাঁটুর নীচ থেকে কাটতে হয়েছে সেই আর্সেনিক রোগের জন্যই। শেখদের মতো মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, ডোমকল, বহরমপুর, রঘুনাথগঞ্জ I ও II, ভগবানগোলা, লালগোলা, হরিহরপাড়া, নবাদা, বেলডাঙ্গা, রাণীনগর I ও II ব্লকের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বহু মানুষ সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে অনশন করছেন।

“আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে আমি যখন ভুগছিলাম তখন আমর স্ত্রী আমাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তার বাবা - মা তাকে আমার কাছে ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ দিলে সে আত্মহত্যা করে”, বলল ফজল করিম। “এখন আমাদের দুই মেয়ে নিয়ে আমি একা অসহায় অবস্থায় পড়েছি। আমার অল্প একটু ক্ষেত ছিল, চিকিত্সার খরচ যোগাতে সেই ক্ষেতটুকুও বেচে ফেলতে হয়েছে”।

আবু তাহেরের গল্পও প্রায় একই রকম। আমার বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকে বোন গুলশনকে তাড়িয়ে দিল। যখন তার শরীরে আর্সেনিক রোগ লক্ষণ দেখা গেল তার স্বামী তাকে তালাক দিল।

আর্সেনিক রোগ লক্ষণের জন্য স্কুল থেকেও অনেক ছাত্রকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ছাত্ররাও সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে যে অনশন, সেই অনশনে সামিল হয়েছিল।

-দি স্টেটসম্যান, 11 ডিসেম্বর, 1999 (বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ)

Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading