আর্সেনিকের বিষণ দুর্ঘটনা


বর্তমানে আর্সেনিক বিষণে BLA একটি স্বীকৃত ঔষধ। তবে এটি দামী, এবং বিশেষ কার্যকরও নয়। যুদ্ধাস্ত্রের সন্ধানে আর্সেনিকের উপর বিস্তর রাসায়নিক গবেষণা হয়েছে। কৃত্রিমভাবে সংশ্লিষ্ট প্রায় 32,000 আর্সেনিক জৈবরাসায়নিক ( organo arsenicals ) বিশ শতকে তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে প্রকৃতিতে কয়েক ডজনমাত্র পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা “এজেণ্ট অরেঞ্জ ব্লু” প্রয়োগ করেছিল গেরিলা যোদ্ধা আড়ালকারী গাছপালা বিনাশ করার জন্যে।

আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, শিল্পকর্ম, চাষবাস, খনিজ উত্তোলন, ধাতুনিষ্কাশন যত বেড়েছে, আর্সেনিকের পরিবেশ দূষণ ও দুর্ঘটনা তত বড় আকারে ঘটেছে। বিষাক্ত এই বিরাট ইতিহাস থেকে নির্বাচিত কয়েকটির উল্লেখ নীচে করা হল।

উনিশ শতকে শুধু নানারকম ওষুধপত্রই নয়, আর্সেনিক ঘটিত নানারকম রঞ্জকদ্রব্যব্যাদির ব্যাপক ব্যবহার হত বই ও ছবির কাগজপত্রে, বিজ্ঞাপনের রঙে, মিঠাই লজেন্সের মোড়কে, ফুলপাতা ও ঘর সাজানোর নানা জিনিসে, কার্পেটে, দেওয়ালের রঙে। গায়ে মাখার সাবান তেল থেকে ভেড়ার স্নানের জলে, ইঁদুর মারা বিষে সর্বত্র আর্সেনিক নানাভাবে নানারঙে মানুষের অর্থনৈতিক ও সমাজজীবনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

আর্সেনিক দুর্ঘটনার নানা ঘটনাবলির মধ্যে একটি হল 1828 ও 1829 সালে প্যারিসে স্নায়ুদৌর্বল্য, হজমের ও ত্বকের অসুখের মহামারী (“Acrodynie”) । এতে চার হাজারের মতো মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এর পিছনে আর্সেনিক বিষণ নির্ণীত হয়েছিল।

1842 সালে ডাবলিনে 14 জন শিশু মিঠাইয়ের মোড়কের কপার আর্সেনেট পেটে যাওয়ায় অসুস্থ হয়। ম্যানচেস্টারেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। 1857 সালে 340 জন শিশু আর্সেনিক দূষিত দুধ খেয়ে অসুস্থ হয়। ব্র্যাডফোর্ডের এক মিঠাই প্রস্ত্ততকারক লজেন্সে ভুল করে প্লাস্টার অফ প্যারিসের বদলে আর্সেনিক ব্যবহার করায় 200 জনের আর্সেনিক বিষণ হয়। এর মধ্যে যারা লজেন্স খেয়েছিল তাদের 17 জনের মৃত্যু হয়।

ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্সেনিক দূর্ঘটনা হল 1900 সালের ম্যানচেস্টারের “বিয়ার ট্র্যাজেডি”। আর্সেনিক দূষিত বিয়ার পান করে 6000 জন মদ্যপায়ী অসুস্থ হয়, তার মধ্যে 40 জনের মৃত্যু হয়। এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার যে তদন্ত কমিশন গঠন করেন তার চেয়ারম্যান ছিলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন। রির্পোট থেকে জানা যায়, যে গ্লুকোজ ব্যবহার করে বিয়ার প্রস্ত্তত করা হয়েছিল, তাতে ঘটনাক্রমে আর্সেনিক ঢুকে পড়েছিল। গ্লুকোজ তৈরীতে যে সালফিউরিক অ্যসিড ব্যবহার করা হয়েছিল, তা আবার আর্সেনিক ঘটিত পাইরাইট (FeS) থেকে প্রস্ত্তত হয়েছিল। সালফিউরিক অ্যসিডে 1% আর্সেনিক ঢুকে পড়েছিল যার ফলে বিয়ারে লিটার প্রতি 1.5 থেকে 3 মিলিগ্রাম আর্সেনিক ছিল।

এই কমিটির সুপারিশে জলে গ্রহণযোগ্য আর্সেনিকের “সর্বোচ্চ দূষক সীমা” 150 পিপিবি (বা লিটার প্রতি 0.15 মিলিগ্রাম) নির্দিষ্ট হয়। বিশ্বে এই প্রথম দূষকের সর্ব্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণের নীতি শুরু হয়। পরবর্তীকালে এই মাত্রা 50 এবং বর্তমানে 10-এ নামিয়ে আনা হয়েছে।

জাপানে আর্সেনিকজনিত দুর্ঘটনা অনেক হয়েছে। 1955 সালে মরিনাগায় গুঁড়ো দুধের আর্সেনিক বিষণে 13,419 জন জাপানি শিশু অসুস্থ হয় যার মধ্যে 1839 জন মারা যায়। নানা অসুস্থতা নিয়েও যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকের মধ্যেই মানসিক প্রতিবন্ধিতা দেখা যায়। দুধে আর্সেনিক আসে সুস্থিতি-সঞ্চারক মিশ্রণ দ্রব্য (স্টেবিলাইজার) হিসাবে যে ফসফেট ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে শতকরা তিন ভাগ আর্সেনিক থাকায়।

1956 সালে আর্সেনিক দূষিত সয়াসসে আরো চারশ জন জাপানি শিশু অসুস্থ হয়। আর্সেনিক দূষণের নানা ঘটনা চিকিত্সা বিজ্ঞান ও বিষবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। 1984 সালে আমেরিকা বিষনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সমূহের সংগঠন এক সমীক্ষায় জানান যে, ভারী ধাতু (লেড, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক) বিষণের পাঁচ হাজারটি ঘটনার মধ্যে বারোশই ছিল আর্সেনিক বিষণের ঘটনা।

রাসায়নিক যুদ্ধে আর্সেনিক


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন ছিল পদার্থবিদদের যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (1914 - 18) ছিল রসায়নবিদদের যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র লিউসাইট ব্যবহার করেছিল। এই ভয়ঙ্কর রাসায়নিকটি একটি জৈব আর্সেনিক যা শত্রুসৈন্যের গায়ের সংস্পর্শে এলে মারাত্মক ফোস্কা ও ঘা সহ অন্যান্য কষ্ট সৃষ্টি করে। অকসফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ রাসায়নিকরা এর প্রতিষেধক ব্রিটিশ অ্যাণ্টিলিউসাইট (BLA) তৈরি করে ফেলল, তবে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়াতে তার আর প্রয়োজন হয় নি।

বর্তমানে আর্সেনিক বিষণে BLA একটি স্বীকৃত ঔষধ। তবে এটি দামী, এবং বিশেষ কার্যকরও নয়। যুদ্ধাস্ত্রের সন্ধানে আর্সেনিকের উপর বিস্তর রাসায়নিক গবেষণা হয়েছে। কৃত্রিমভাবে সংশ্লিষ্ট প্রায় 32,000 আর্সেনিক জৈবরাসায়নিক ( organo arsenicals ) বিশ শতকে তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে প্রকৃতিতে কয়েক ডজনমাত্র পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা “এজেণ্ট অরেঞ্জ ব্লু” প্রয়োগ করেছিল গেরিলা যোদ্ধা আড়ালকারী গাছপালা বিনাশ করার জন্যে। বর্তমানে কীটনাশক, আগাছানাশক প্রভৃতি পেস্টিসাইডের যে ঢালাও কারবার চলছে, তা রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র শিল্পজাত।

প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading