বাংলার মানুষ ও ক্রনিক আর্সেনিক বিষণের প্রতিক্রিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য


কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলে বা বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুকালের জন্য সক্রিয় সংক্রামক ব্যাধির অস্বাভাবিক প্রকোপকে মহামারী ( epidemic ) বলা হয়। কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনও বিশেষ রোগে আক্রান্ত সংখ্যা যদি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি হয়, তাহলেই তা মহামারী বলে গণ্য হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, কলেরা প্রভৃতির সঙ্গে ফ্লোরোসিস, আর্সেনিকোসিস প্রভৃতিও আজকাল মহামারীরূপে পরিগণিত হচ্ছে।

- এগারো বছরের কমবয়সি শিশুদের দেহেও আর্সেনিক মেলানোসিস দেখা যায়, যা অন্যত্র বিরল।

- যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দীপঙ্কর চক্রবর্তী দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে অল্পবয়সি শিশুরা আর্সেনিকে বিশেষ স্পর্শকাতর। কম বয়সি যত বেশি শিশু প্রকটভাবে যত বেশি আর্সেনিক আক্রান্ত এমনটা পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। আর্সেনিক আক্রমণের স্পষ্ট চিহ্ন যুক্ত আঠারো মাস বয়সি যে শিশুর ছবি তিনি দেখাচ্ছেন, সে বোধ হয় পৃথিবীর কনিষ্ঠতম আর্সেনিক আক্রান্ত জীবিত শিশু।

- শরীরে আর্সেনিক রোগ লক্ষণযুক্ত মানুষেরা সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অনেকেরই আবার রোদে বেরোলে, এমনকী শীতকালেও গায়ে চুলকানি ও জ্বালা হয়।

- আর্সনিক বিষণের দরুন পায়ে কেরাটোসিস হলে উন্নত দেশে মানুষ মরে না। কিন্তু বাংলায় দারিদ্র্য হেতু ঐ অবস্থায়ও জীবন - জীবিকার প্রয়োজনে হাঁটা চলা, কাজকর্ম করতেই হয়, কখনও খালি পায়েও। উপযুক্ত চিকিত্সা ও যত্ন হয় না। প্রায়ই নিবারণযোগ্য মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে।

- গ্রামের দরিদ্র মানুষজনই বেশি ভুগছে, কষ্ট পাচ্ছে, মরছে। একে পানীয় জলের নিকটবর্তী উত্সের সুযোগ কম, তার ওপরে তাদের দারিদ্র্য হেতু আছে ক্রমিক অপুষ্টি আর চিকিত্সার অভাব।

প্রাণরাসায়নিক সুরক্ষাব্যবস্থা


দেহ সুরক্ষার সুন্দর নানা ব্যবস্থা মানবদেহের প্রাণ রাসায়নিক ব্যবস্থার মধ্যেই অন্তনির্মিত ( in-built)। প্রবিষ্ট সমধিক বিষাক্ত আর্সেনিক ( III )-কে দেহ ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত আর্সেনিক (V)-এ জারিত করে। দ্রুত জীবমিথাইলেশন করে হ্রস্বিত বিষের অধিক দ্রাব্য MMA ও DMA উত্পন্ন করে কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বার করে দেয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে সাধারণতঃ মানবদেহে প্রবিষ্ট আর্সেনিকের 45 থেকে 75 শতাংশ আর্সেনিক প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। তাই বহু লোক আর্সেনিক যুক্ত জল খাওয়া সত্ত্বেও বহুদিন আর্সেনিক রোগলক্ষণমুক্ত থাকে। ঘাম ও মলেও কিছু বেরিয়ে যায়, তবে তা সামান্যই।

‘আর্সেনিক’ কথাটা আর্সেনিকের সবরকম রাসায়নিক প্রজাতির জন্য ব্যবহার করা হলেও জীবদেহে সব রাসায়নিক প্রজাতির ক্রিয়াবিধি এক নয়, আবার একই আর্সেনিক প্রজিতর ক্রিয়াবিধি দেহের সর্বাঙ্গেও এক নয়।

প্রতিক্রিয়াসমূহ জটিল ও এখনও অস্পষ্ট, যদিও এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম হচ্ছে প্রচুর, প্রকাশিত হচ্ছে শতশত গবেষণাপত্র। এখানে শুধু আর্সেনিক (V) ও আর্সেনিক (III)-এর ক্রিয়াবিধির সামান্য প্রাথমিক আলোচনা হবে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ধরণ ও ক্রিয়াবিধির বিস্তৃত ক্ষেত্রকে মোটামুটি চারটিভাগে ভাগ করা যায়।

1, ক্রোমোজোম বিকৃতি ও পরিব্যক্তি সংঘটন।
2, কোষচক্র নিয়ন্ত্রণ, প্রেরিত সঙ্কেতে পরিবর্তন, শ্রেণী বিভাজন ও নির্দেশিত সংকেতে কোষমৃত্যু।
3, জারণজনিত চাপসঞ্চার।
4, জিনের প্রকাশ পরিবর্তন।

আর্সেনিকের বিপাকীয় রূপান্তর


মনুষ্যসহ বহুপ্রজাতির জীবের ভিতর আর্সেনিকের দু-ধরনের বিক্রিয়া দেখা যায় : জারণ - বিজারণ ও জীমিথাইলেশন। বিজারণকারী হল গ্লুটাথায়োন (GSH), আ জারণ ও মিথাইল সংযোজন করে S-অ্যাডেনোসিল মেথিওনিন (SAM)। তার সঙ্গে GSH কো – ফ্যাকটর হিসাবে কাজ করে। আর্সেনিকে মিথাইল সংযোজন মিথাইল ট্রান্সফারেজ (ferase) এনজাইমের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে MMAv ও পরে তা DMAv এ রূপান্তরিত হয়। অতি সম্প্রতি এই বিক্রিয়াক্রমে আরো দুটি আর্সেনিক প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে, তারা হল MMAIII ও DMAIII (G9, 8.4)। এইসব বিক্রিয়াগুলি লিভারেই ঘটে থাকে।

2000 সালে রুমানিয়াতে ও 2001 সালে পশ্চিমবঙ্গে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিকঘটিত পানীয়জল ব্যবহারকারী মানুষদের প্রস্রাবে MMAIII ও DMAIII শনাক্ত করা গেছে ( G9 ) । জন্তুজানোয়ারদের ওপর পরীক্ষা করেও এগুলো পাওয়া গেছে। এগুলি খুবই সক্রিয় (তাই বোধ হয় তাদের বিলম্বিত আবিষ্কার ) ও অতিমাত্রায় বিষাক্ত। ক্যানসার ও অন্যান্য অসুখে MMAIII ও DMAIII এর ভূমিকা নিয়ে কাজ চলছে।

জীবদেহে আর্সেনিক মাইটোকন্ড্রিয়ার শ্বসন আটকে দেয় এবং দেহকোষে ATP উত্পাদন কমে যায়। তার সঙ্গে হাইড্রোজেন পারকসাইডের (H2O2) উত্পাদনও বাড়ায়। এর ফলে কতকগুলি ক্ষণস্থায়ী অকসিজেন প্রজাতির (freeradicals) সৃষ্টি হয়, যার দরুন দেহে জারণজনিত চাপ বা (oxidativestress) হয়। এর ফলে ‘হিম’ তৈরির পথ বিঘ্নিত হয় এবং কতকগুলি স্ট্রেস প্রোটিনের উদ্ভব হয়। আর্সেনিকঘটিত জারণজনিত চাপ ডি.এন.এ কে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা এখনও পর্যন্ত বোঝা না গেলেও এটা মনে করা হচ্ছে যে, কোষমধ্যে সক্রিয় কোনও অকসিজেন প্রজাতি সরাসরি অথবা স্বাভাবিক সংকেতগুলির পরিবর্তন করে ডিএনএ কে অস্বাভাবিক করে বিভিন্ন রকমের অসুখ, যেমন ক্যানসারের সূত্রপাত ঘটায়।

অজৈব আর্সেনিক ক্রোমোজোমে বিকৃতি আনে। বিভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে, এমনকী মানুষের মতো একই প্রজাতির জীবেদের মধ্যে আর্সেনিকের জারণ - বিজারণ ও মিথাইলেশনে বিপুল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

আর্সেনিক রোগ অনুসন্ধানে এপিডেমিওলজি বা মহামারীবিদ্যা


কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলে বা বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুকালের জন্য সক্রিয় সংক্রামক ব্যাধির অস্বাভাবিক প্রকোপকে মহামারী ( epidemic ) বলা হয়। কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনও বিশেষ রোগে আক্রান্ত সংখ্যা যদি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি হয়, তাহলেই তা মহামারী বলে গণ্য হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, কলেরা প্রভৃতির সঙ্গে ফ্লোরোসিস, আর্সেনিকোসিস প্রভৃতিও আজকাল মহামারীরূপে পরিগণিত হচ্ছে। কোনও কোনও সীমিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, কিন্তু মহামারীর আশঙ্কা জাগায়, তাকে ঐ অঞ্চলের সীমিতমারী ( endemic ) বলে। আর্সেনিকোসিস বা আর্সেনিয়াসিস বাংলায় মহামারীরূপেই গণ্য। এপিডেমিওলজিকে রোগ গোয়েন্দা বলা হয়।

চারদিক বহুজনের ভেতর আজকাল যেসব রোগলক্ষণ দেখা যাচ্ছে তার পিছনে পরিবেশীয় আর্সেনিকের ভূমিকা সত্যিই কতটা এবং সক্রিয় তার সঠিক নিরূপণ খুব একটা সহজ নয়। এই অনুসন্ধানে বিজ্ঞানের অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা এপিডেমিওলজির পদ্ধতি পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে থাকেন। এপিডেমিওলজি জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞান থেকে এলেও বর্তমানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। প্রাপ্ত রাশিতথ্যের বিশ্লেষণে পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বা রাশিবিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহ অত্যন্ত উপযোগী, তাই আজকাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য সর্বত্রই পরিসংখ্যান বা রাশিবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।

লক্ষ লক্ষ মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত – এই সন্দেহে সকলের পরীক্ষা নিরীক্ষা, তথ্য সংগ্রহ খুব সহজ নয়। তার বদলে পরিকল্পনামাফিক বিশ, পঞ্চাশ, কয়েকশত বা কয়েক হাজার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিধিমতো নির্বাচন করে কিছু নমুনার ( model sample ) তথ্যের ওপর রাশিবিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে কোনও অনুমিতি বা প্রকল্পের সত্যতার সম্ভাবনা হিসাব করা হয়।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder. First Published in July 2006

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading