বর্ণালী বিশ্লেষণ অতি-উন্নত পদ্ধতিসমূহ (Sophisticated Spectroscopic Methods)


পারমাণবিক শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ (Atomic Absorption Spectrometry)


তপ্ত শিখা মধ্যস্থ আর্সেনিক পরমাণুর শোষণ বর্ণালী পরিমাপন (Flame Atomic Absorption Spectrometry, FAAS) পদ্ধতিতে নানারকম বিঘ্ন হয়। এই পদ্ধতিতে আর্সেনিক নিরূপণের নিম্নসীমা অনেক ঊর্ধ্বে থাকায় একক ভাবে এই পদ্ধতির প্রয়োগ সীমিতই ছিল। কিন্তু এই পদ্ধতির সঙ্গে যখন হাইড্রাইড প্রজনন (Hydride Generation, HG) যুক্ত করে পরিমাপের নতুন পদ্ধতির প্রচলন হল, তখন থেকে পরিবেশীয় আর্সেনিক গবেষণা নতুন মাত্রা পেল। এই পদ্ধতিই এখন সর্বত্র – বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায়ও – ব্যাপকভাবে প্রচলিত। সংক্ষেপে এই পদ্ধতিকে F1 – HG - AAS বলা হয়। তড়িত তাপীয় পারমাণবিক শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ (- Electrothermal Atomic Absorption Spectrometry, ET AAS) বা গ্রাফাইট চুল্লি পারমাণবিক শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ ( Graphite Furnace Atomic Absorption Spectrometry, GF AAS) অনুরূপ আর একটি পদ্ধতি, যা আজ বহু ব্যবহৃত। এইসব পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে পরিবেশীয় আর্সেনিকের ওপর বেশ আলোকসম্পাত সম্ভব হচ্ছে।1973 সালে ব্রামান ও ফোরেব্যাক অ্যাটমিক অ্যাবসরপসন পদ্ধতির সঙ্গে হাইড্রাইড প্রজনন প্রযুক্তির সংযোগ করেন।

আবেশযুক্ত প্লাজমা বর্ণালী বিশ্লেষণ (Inductively Coupled Plasma Mass Spectrometry ICP-MS)


আর্সেনিক পরিমাপের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহের মধ্যে আবেশযুক্ত প্লাজমা ভর বর্ণালী বিশ্লেষণ নানাদিক দিয়ে অন্যান্য পদ্ধতিসমূহের থেকে উত্কৃষ্টতর। যন্ত্র দামি হলেও এর সুবিধা অনেক। নিরূপণ মাত্রা সীমা অনেক নীচে, নিরূপণ সীমার বিস্তার (wide linear range) অনেক বেশি এবং অনেক মৌল একই সঙ্গে নিরূপিত হতে পারে (multi element capabilities)।

একস রশ্মির বর্ণালী বিশ্লেষণ (X-ray Spectroscopy)


আর্সেনিকের (বস্তুত, আরও অনেক ধাতব বস্তুর) সামান্য টুকরোর ওপর তড়িতাহত কণাবর্ষণে উত্পন্ন এক্স-রে বিকিরণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে মৌলসমূহ শনাক্তকরণ ও পরিমাপ করা যায় (Partielemental technique X-ray Emission Spectrometry, PIXES)। PIXES হল বহু মৌল নির্ণয়ের প্রযুক্তি (multielemental technique) যার মৌল পরিমাণ নির্ণয়ের নিম্নতম সীমা গ্রাম প্রতি 0.1 মাইক্রোগ্রাম।। এতে সুবিধা হল অত্যল্প (1 মিগ্রা বা তার কম) জিনিস নিয়ে পরীক্ষা করা যায় এবং বস্তুটি অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া যায়। পিরসেসের প্রয়োগ অত্যাধিক বেশি হয়েছে বায়ুমন্ডলের ধূলিকণার আর্সেনিক নিরূপণে।

একস-রে ফ্লোরেসেন্স (X-ray Flouorescence, XRF) বর্ণালী বিশ্লেষণ


সোডিয়াম ডাইবেনজাইল ডাই থায়োকার্বামেট (Sodium Dibenzyl Dithio Carbamate, DBTC) দিয়ে As(III) -কে অধঃক্ষিপ্ত করে একস-রে ফ্লোরেসেন্স বর্ণালী বিশ্লেষণ করা হয়।

একাধিক প্রযুক্তির সংযুক্তি কৌশল (Hyphenated Techniques)


একাধিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার সংযুক্তি বা সমন্বয়ে গঠিত অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন অপর একটি একক (Single) পদ্ধতির সংগঠনকে সংযুক্তি কৌশল বলে। ক্রোমাটোগ্রাফি দিয়ে পৃথকীকৃত ও মৌলবিশেষের বিকিরিত বর্ণালী বিশ্লেষণ (Atomic Fluorescence Spectroscopy, AFS), এই দুই পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত পরীক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যে পরিবেশীয় নানা পদার্থের রাসায়নিক প্রজাতি নির্ণয় আজকাল সুন্দর ভাবে সম্ভব হচ্ছে। পারমাণবিক প্রতিপ্রভা বর্ণালী বিশ্লেষণ ও তরল ক্রোমাটোগ্রাফির (liquid chromatography) সংযোজন ঘটিয়ে “অনলাইনে” (on line) আর্সেনিক প্রজাতি নিরূপণ করা হয়েছে। আবার অ্যানায়ন এক্সচেঞ্জ HPLC, হাইড্রাইড উত্পাদন এবং AFS এর সংযুক্তি ঘটিয়ে আর্সেনাইট, আর্সেনেট, DMA , MMA এর পরিমাণ করা গেছে।

HPLC - HG - AAS সম্ভবত সবচেয়ে সহজ সুন্দর রুটিন পদ্ধতি. আর HPLC - HG – ICP - AES বহু মৌল পরীক্ষার (multi-elemental analysis) কাম্য পদ্ধতি।

ক্যাপিলারি জোন ইলেকট্রোফোরেসিস (Capillary Zone Electrophoresis)


এটি একটি বিচিত্রমুখী শক্তিশালী প্রযুক্তি, যার সাহায্যে ছোট অজৈব অণু থেকে প্রোটিন, নিউক্লিক অ্যাসিড প্রভৃতির মতো বড় বড় প্রাণ-রাসায়নিক অণুসমূহ (biomolecules) পৃথক করা যায়। সুতরাং CE- ICP- MS সমন্বয়িত সংযুক্ত প্রযুক্তিটি সম্ভবনাময়। বর্তমানে লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফির সঙ্গে সংযুক্ত মৌল নির্দিষ্ট গ্রাহক / নির্দেশ (element specific detectors) সবচেয়ে ভাল মনে হলেও CE এর চমত্কার ক্রোমাটোগ্রাফির বিভাজন ও দ্রুত বিশ্লেষণ (high chromatographic and analysis time) বিশেষ আকর্ষণীয়।

এই পদ্ধতিতে স্যাম্পল খুব কম (ন্যানোলিটার মাত্রাস্তর ) লাগে। এই পদ্ধতিতে As(III), As(V), মনোমিথাইল আর্সোনিক, ডাইমিথাইল আর্সিনিক অ্যাসিড, ফিনাইল আর্সোনিক অ্যাসিড, আর্সেনোবিটেন, আর্সেনোকলিন প্রভৃতির নিরূপণ ও পরিমাপ সম্ভব হচ্ছে। সাধারণত কোয়ার্টজ ক্যাপিলারি ব্যবহৃত হয়।

বায়োসেন্সর (Biosensors)


কিছু কিছু জীবাণু আছে যারা আর্সেনিক সুবেদী (arsenic sensitive) । যেমন মানুষের অন্ত্রের জীবাণু ই-কোলি (Es-cherichia Coli) । এদের জিনে আলোক উত্সারী (bioluminescent) এমন কিছু জিন সংযোজিত করা যায় যাতে পরিবর্তিত জিনের এই কৃত্রিম জীবাণুরা জল বা কোনও দ্রবণে আর্সেনিক থাকলে আলোক বিচ্ছুরণ করে। উত্সারিত আলোর পরিমাণ আর্সেনিকের পরিমাণের সঙ্গে সমানুরাতী অনুপস্থিতিতে ম্লান আলো, উপস্থিতিতে জোরালো আলোর পরিমাণ আর্সেনিকের পরিমাণের সঙ্গে সমানুপাতী। আর্সেনিকের অনুপস্থিতিতে ম্লান আলো, উপস্থিতিতে জোরালো আলো। জিন-পরিবর্তিত জীবাণু নিষিক্ত কাগজ বা প্লাস্টিকের পাত (‘‘dipsticks’’) পরীক্ষার জল বা দ্রবণে ডুবিয়া উত্সারিত আলোর পরীক্ষা করা হয়।

জোনাকি পোকায় যে জিনের জন্য আলোক উত্সারিত হয়, তা ই-কোলির জিনে সংযুক্ত করা হলে পরিবর্তিত জিনের ই-কোলিও আলো উত্সারণ করবে। অনুরূপে আলোক উত্সারী জেলিফিস বা সামুদ্রিক জীবাণু বিশেষের জিন সংযোজন করে সাদা, নীল প্রভৃতি আলোউত্সারী জীবাণু সৃষ্টি করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে আর্সেনিক নিরূপণ অতি সুবেদী (supersensitive sentinel) একটি পদ্ধতি হবার সম্ভাবনা রাখে। পদ্ধতিটি এখনও পরীক্ষা স্তরেই আছে. সুইজারল্যান্ডের van der Meer Swiss Federal Institute for Environmental Science and Technology পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করে উন্নয়ন করছে এখন। যেহেতু পরিবর্তিত জিনের কৃত্রিম কোনও জীবাণু ল্যাবরেটরির বাইরে নিয়ে যাওয়া আইনত নিষিদ্ধ, তাই এই পদ্ধতিটির বাণিজ্যিকিকরণ এখনও হয়নি। তবে ভিয়েতনামে ক্ষেত্র পরীক্ষা (field trial) চলছে। এই পদ্ধতিতে আর্সেনিক করা যাবে খুব কম খরচে। তবে এর বড় অসুবিধা কৃত্রিম এই জীবাণুরা আর্সেনিক ছাড়া আরও কিছু পদার্থে অনুরূপ সুবেদী। যেমন তামা (Cu2+) আর অন্য কিছু দূষক জীবাণুকে মেরেও পারে। আর্সেনিক থাকলেও মৃত জীবাণুরা আলো উত্সারণ করবে না।

আর্সেনিকের ছত্রাক পরীক্ষা (Mycological Test for Arsenic)


কতকগুলি ছত্রাক (যেমন Scopulariopsis brevicaulis ) খাদ্যবস্তু (প্রকৃতপক্ষে যে কোনও জৈববস্তু) থেকে প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উদ্বায়ী আর্সাইন গ্যাস উত্পন্ন করে। তাদের গন্ধ বা কোনও বিকারকের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়াজাত বর্ণাদি পরীক্ষা করে আর্সেনিক সনাক্তকরণ সম্ভব ।

আর্সেনিকের রাসায়নিক প্রজাতি নিরূপণ


আর্সেনিকের প্রজাতি নিরূপণে তিনটি প্রধান ধাপ আছে -
প্রথমত, স্যাম্পল থেকে আর্সেনিক নিষ্কাশন করতে হয়। এটাও সুনিশ্চিত করতে হয় যেন কোনও আর্সেনিক রাসায়নিকের পরিবর্তন বা পরিমাণের ক্ষতি না করে। জল বা পোলার (polar) কোনও দ্রাবক দিয়ে প্রায়ই একাধিকবার নিষ্কাশন করতে হয়, যাতে সবরকম আর্সেনিকের সবটাই নিষ্কাশিত হয়। নিষ্কাশন রাসায়নিক ভাবে যতটা মৃদু (mild) করা যায় ততটাই ভাল. তাতে যৌগাদি রাসায়নিকভাবে অপরিবর্তিত থাকে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্লেষ্য দ্রবণটিকে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক প্রক্রিয়া করে উপযুক্ত প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের পৃথকীকরণ করে আর্সেনিকের বিভিন্ন রাসায়নিক প্রজাতি সমূহকে আলাদা করা হয়। রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আর্সেনিক যৌগগুলি তিন রকম হতে পারে -

ঋণাত্মক আধানযুক্ত আয়ন (anion),
আধানবিহীন যৌগ (neutral),
ধনাত্মক আধানযুক্ত আয়ন (cation)।

তৃতীয়ত বা শেষধাপে, পৃথকীকৃত যৌগাদির পরিমাণ ও আণবিক গঠন শনাক্ত করতে হবে। রাসায়নিক ভাবে কঠিন এইসব কাজের জন্য শক্তিশালী অত্যাধুনিক পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার বহু উন্নতদেশে বিভিন্ন ল্যবরেটরিতে রাখা হয়েছে এবং আর্সেনিকের প্রজাতি ও পরিমাণ নির্ণয় এখন প্রায় রুটিন কাজ হয়ে গেছে।

পরবর্তিত (modified) মলিবডেনাম ব্লু পদ্ধতিতে As(V) [ এমনকি As(V) ] এর উপস্থিতিতে As(III) এর পরিমাপন সম্ভব। জারণ না করে প্রথমে As(V)+P(V) পরিমাপ করে নিয়ে পরে আর একটি নতুন নমুনা নিয়ে তাকে ভালমতো জারণ করে নিয়ে As(V)+As(III)+P(V) করে সমগ্র মান থেকে প্রথমের As(V)+P(V) বিয়োগ করলে As(III) -এর পরিমাণ পাওয়া সম্ভব।

আনায়ন এক্সচেঞ্জ রেজিন ব্যবহার করে সহজেই As(V) As(III) -কে পৃথক করে নিয়ে তাদের পরিমাপ সম্ভব। বিশেষ একটি pH -এ (ধরা যাক, 6 – 7 ) আর্সেনিক অ্যাসিড বিয়োজিত হয়ে আর্সেনেট অ্যানায়ন উত্পন্ন করবে। তখন আধানবিহীন আর্সেনিয়াস অ্যাসিড অবিয়োজিত থাকবে. এই পদ্ধতিতে তাদের সহজেই আলাদা করে পরিমাপ করা যাবে। HG AAS পদ্ধতিতে 5pH শুধু As(III) -ই আর্সাইন উত্পন্ন করে, As(V) করে না। আর গাঢ় অ্যাসিডে (Ph>1) বোরোহাইড্রাইড বা Zn + HCI আর্সেনিক অ্যাসিড, ডাইমিথাইল আর্সেনাস অ্যাসিড (DMA), মনোমিথাইল আর্সেনিক অ্যাসিড (MMA) থেকে আর্সাইন উত্পন্ন করেপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, HPLC – HG - FAAS এর সাহায্যে আর্সেনিক প্রজাতি সমূহের পৃথকীকরণ ও পরিমাপন এবং লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফির সঙ্গে । CP- MS, HG-FAAS সংযুক্ত করে রাসায়নিক প্রজাতি সমূহের নিরূপণও প্রায় রুটিন কাজ হয়ে গেছে।

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading