মরীচিকাকে মিথ্যা করে পুকুর

20 Mar 2016
0 mins read

এই সকল মানুষজন, যাঁরা সারা দেশ জুড়ে জলের কাজ করতেন মরুভূমিতে এলেই তাঁদের মাথা মরীচিকায় ঘেরা হয়ে যায়|

সবথেকে গরম ও সবথেকে রুক্ষ্ম হলো এই অঞ্চলটাই| মাত্র তিন থেকে বারো ইঞ্চি বৃষ্টি হয় সারা বছরে| জয়সলমের, বাড়মের ও বিকানেরের কিছু অংশে এটুকুই বৃষ্টি হয়| এটুকু বৃষ্টি দেশের অনেক জায়গায় এক দিনেই হয়ে যায়| নিজের পূর্ণ তেজ নিয়ে সূর্য এখানে সবথেকে বেশি উজ্জ্বল| মনে হয় গ্রীষ্ম ঋতু এখান থেকেই তার পরিক্রমা শুরু করে| এরপর বিভিন্ন রাজ্যে হাজিরা দিয়ে এসে ফের এখানে জাঁকিয়ে বসে| তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি না ছুঁলে মরুভূমির মানুষদের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়| ভূগর্ভস্থ জলের স্তরও এখানে সব থেকে নীচে| জলের অভাবই তো মরুভূমির স্বভাব| মরুভূমির মানুষ কিন্তু একে অভিশাপ নয়, প্রকৃতির খেয়ালেরই একটা বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন এবং পাক্কা খেলোয়াড়ের মতোই পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে এই খেলায় অংশগ্রহণ করতেন|

চারিদিকে মরীচিকায় ঘেরা তপ্ত মরুভূমিতে জীবনের এক জীবন্ত সংস্কৃতির ভিত তৈরীর সময় এই সমাজ সম্ভবত জলের সঙ্গে সম্পর্কিত তুচ্ছাতিতুচ্ছ তথ্যও খুঁজেছে ও পরখ করে দেখেছে| জল সমস্যার প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁরা খুঁজেছেন জীবনের রীত| মরীচিকাকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য এক এক জায়গা এক এক রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন|

যেখানে পুকুর নেই, অর্থাত জল নেই, সেখানে গ্রামও নেই| পুকুরের কাজ আগে হবে তবেই তাকে কেন্দ্র করে গ্রাম বসবে| মরুভূমিতে শত শত গ্রাম পাওয়া যাবে যেগুলির নাম তাদের পুকুরের নাম দিয়েই| বিকানের জেলায় - বিকানের তহশিলে চৌষট্টিটি, কোলায়ত তহশিলে কুড়িটি এবং নোখা ক্ষেত্রে একশো তেইশটি গ্রামের নাম সর দিয়ে| ‘নুনকরমসর তহশিল’ - এই তহশিলটির নামই তো সর দিয়ে| এ ছাড়াও এ তহশিলে আরও পঁয়তাল্লিশটি গ্রামের নাম সর দিয়ে| অবশ্য বাকি যেসব গ্রামের নামে সর নেই সেখানেও পুকুর পাওয়া যাবে| তবে দু-চারটে গ্রাম হয়তো এমনও পাওয়া যেতে পারে যেগুলির নামে সর আছে কিন্তু সরোবর নেই| গ্রামে সরোবর হবে - এরকম ইচ্ছা গ্রামের লোকের অবশ্যই ছিলো| ঠিক যেমন ছেলের নাম রামকুমার বা মেয়ের নাম পার্বতি রাখার সময় মাতা-পিতা সন্তানদের মধ্য এঁদের গুণ কামনা করেন|

অধিকাংশ গ্রামেই এই পূর্ণ হয়ে যাওয়া কর্তব্য আর যেখানে কোন কারণবশতঃ তা সম্ভব হয় নি তা নিকট ভবিষ্যতে পূর্ণ দেখার কামনা – মরুভূমির সমাজকে জলের ব্যবস্থায় এক বলিষ্ঠ সংগঠনে রূপান্তরিত করেছিলো |

রাজস্থানের এগারোটা জেলায়- জয়সলমের, বাড়মের, যোধপুর, পালি, বিকানের, চুরু, শ্রীগঙ্গানগর, ঝুঁঝনু, জাগৌর, নালৌর ও সিকর-এর সর্বত্রই বিস্তারিত মরুভূমি| তবুও মরুভূমিকে নিজের মধ্যে সীমিত করে নিয়ে সমস্যা সমাধান করে জয়সলমের, বাড়মের ও বিকানের| এই অংশেই দেশের মধ্যে সবথেকে কম বৃষ্টি হয়, সবথেকে বেশী গরম, আছে বালির ঝড়, আর ডানা মেলে এখানে ওখানে উড়ে বেড়ানো বিশাল বিশাল বালির টিলা| এই তিনটি জেলায় সব থেকে বেশী জলের অভাব হওয়ার কথা| কিন্তু মরুভূমির এই জেলাগুলির একশো শতাংশ গ্রামেই জলের ব্যবস্থা রয়েছে| আদমসুমারীর কর্মীদেরও একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়| অথচ এই ব্যবস্থা অধিকাংশ গ্রামেই মরুভূমির সমাজ নিজের হিম্মতে করেছিলো| শুধু তাই নয় এই ব্যবস্থা এতোই মজবুত ছিলো যে তীব্র উপেক্ষার দীর্ঘ সময় পার করেও এই ব্যবস্থা এখনো টিকে রয়েছে|

গেজেটিয়ারে জয়সলমেরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা খুবই ভয়াবহ – এখানে একটাও বারমাসি নদী নেই, ভূগর্ভস্থ জল একশো পঁচিশ থেকে দুশো পঞ্চাশ ফুট গভীরে, কোথাও কোথাও এই গভীরতা চারশো ফিটে গিয়েও পৌঁছায়| বর্ষা অবিস্মরণীয়ভাবে কম, মাত্র ১৬.৪সেমি১| বিগত ৭০ বছরের অধ্যয়নে বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশো পঞ্চান্ন দিনই শুকনো গোণা হয়েছে| অর্থাত একশো কুড়ি দিনের বর্ষা ঋতু এখানে নিজের সংক্ষিপ্ততম রূপে মাত্র দশ দিনের জন্যই আসে|

জল সমস্যার প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁরা খুঁজেছেন জীবনের রীত| মরীচিকাকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য এক এক জায়গা এক এক রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন|

এ হিসেব-নিকেশ আবশ্য আধুনিক প্রজন্মের| মরুভূমির সমাজ সম্ভবত এই দশ দিনের বর্ষায় কোটি কোটি বৃষ্টি বিন্দু অনুভব করেন এবং তাই সঞ্চয় করার কাজ ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে শুরু করে দেন| এই তপস্যার পরিণাম- জয়সলমের জেলায় বর্তমানে পাঁচশো পনেরোটি গ্রাম আছে| এর মধ্য তিপ্পানটি গ্রাম কোন না কোন কারণে উঠে গেছে| চারশো বাট্টিটি গ্রামে বসতি রয়েছে| এই চারশো বাষট্টিটি গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম ছাড়া বাকি সবগুলিতেই পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে| যে গ্রামগুলো উঠে গেছে সেগুলোতে এথনো এই ব্যবস্থা টিকে রয়েছে| সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী জয়সলমেরে ৯৯.৭৮ শতাংশ গ্রামেই কুয়ো, পুকুর ও অন্যান্য জলের উত্স পাওয়া যায়| এর মধ্যে পাইপ টিউবওয়েলের মতো নুতন ব্যবস্থা খুবই কম| ১.৭৩ শতাংশ গ্রামের অর্থ কী হয় জানি না, কিন্তু সীমান্তবর্তী এই জেলার পাঁচশো পনেরোটি গ্রামের মধ্যে শুধু ১.৭৩ শতাংশ গ্রামেই বিদ্যুত পৌঁছেচে| এর অর্থ দাঁড়ায় বেশীরভাগ জায়গাতেই টিউবওয়েল বিদ্যুতে নয় ডিজেলে চলে| তেল আসে বাইরে অনেক দূর থেকে| আর্থাত তেলের ট্রেকার না এলে পাম্প চলবে না এবং জল পাওয়া যাবে না| আর সব কিছু ঠিকঠাক চললেও আজ অথবা আগামীকাল টিউবওয়েলে জলের স্তর নীচে নামবেই| টিউবওয়েলে জল তোলা চলবে অথচ জলস্তর যথাস্থানে ঠিক থাকবে এরকম উপায়তো এখনো উদ্ভাবন হয়নি|

আরও একবার বলে রাখি, মরুভূমির মধ্যে সবথেকে বিকট এই এলাকায় শতকরা ৯৯.৭৮ শতাংশ গ্রামে জলের ব্যবস্থা আছে এবং মরুভূমির সমাজ তা নিজের ক্ষমতাতেই করেছে| এরই সঙ্গে সেই সুবিধাগুলিও দেখে নেওয়া যাক, যেগুলির জোগাড় নব্য সমাজের নতুন সংস্থাগুলির বিশেষত সরকারের বলে মনে করা হয়| পাকা রাস্তার সঙ্গে মাত্র ১৯ শতাংস গ্রামই যুক্ত হতে পেরেছে| ডাক প্রভৃতি পরিষেবা পৌঁছেচে শতকরা ৩০ ভাগ গ্রামে| ডাক্তারি সুবিধে ৯ ভাগ গ্রামে| শিক্ষা ব্যবস্থা এগুলির তুলনায় কিছুটা ভালো- শতকরা ৫০ ভাগ|

ফেরা যাক জলের প্রসঙ্গে- পাঁচশো পনেরোটি গ্রামে ছয়শো পঁচাত্তরটি কুয়ো পুকুর রয়েছে| এর মধ্যে পুকুরের সংখ্যা দুশো চুরানব্বইটি|

যে জায়গাটিকে নতুন প্রজন্ম নিরাশার ক্ষেত্র বলে মনে করে, সেখানে সীমানার শেষ অংশে পাকিস্তানের কিছু আগে রয়েছে আশু তাল, আর্থাত আশার তাল| তাপমাত্রা যেখানে পঞ্চাশ ডিগ্রী ছুঁয়ে ফেলে সেখানে রয়েছে সিতলাঈ| শীতল তলাই| আর বর্ষা যেখানে সব থেকে বেশী বিশ্বাসঘাতকতা করে সেখানে বদরা সর| মরুভূমিতে জলের কষ্ট নেই ব্যপারটা এ রকম নয়| কিন্তু সেখানের সমাজ কখনো জলের কান্না কাঁদেনি| তারা এই কষ্টকে কিছুটা সহজ করে নেওয়ার আশা রাখে এবং সেই আশার ভিত্তিতেই নিজেদের এমন সংগঠন তৈরী করেছে যেখানে একদিকে জলের প্রতিটি ফোঁটা সংগৃহীত হয় অতি যত্ন সহকারে, আবার অন্য দিকে তার ব্যবহারও করা হয় যথেষ্ট বুঝে-সুঝে, মিতব্যয়িতার সঙ্গে|

এই সংগ্রহ ও মিতব্যয়িতার স্বভাবকে অনুভব করতে, বুঝতে পারেনি গেজেটিয়ার বা সেই গ্রন্থ যাদের প্রতিনিধিত্ব করে সেই প্রতিনিধিরা| তাই তারা এই সমাজকে, মরুভূমিকে - জনহীন, বিভত্স, জীবনহীন ও আনন্দহীন দেখেছে| কিন্তু গেজেটিয়ারে যারা এই কথা লিখেছিল, তারাও যখন ঘড়সীসরে পৌঁছায় তখন এটা ভুলে যায় যে তারা মরুভূমির যাত্রায় রয়েছে|

কাগজে পর্যটন মানচিত্রে যতবড় শহর জয়শলমের প্রায় ততবড়ই পুকুর ঘড়সীসর| মানচিত্রের মতোই মরুভূমিতে এরা পরস্পরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| ঘড়সীসর ছাড়া জয়সলমের হতো না| প্রায় আটশো বছরের পুরোনো এই শহরের সাতশো বছরের প্রতিটি দিন ঘড়সীসরের এক একটি বিন্দুর সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বদ্ধ|

বালির এক বিশাল টিলা সামনে দাঁড়িয়ে| কাছে গেলেও মনে হবে না টিলা নয় ঘড়সীসরের উঁচু বিস্তৃত, লম্বা চওড়া পাড়| আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা যায় দুটো মিনার, পাথরের ওপর সুন্দর নকসাদার পাঁচটা জানলা এবং দুটো ছোট ও একটা বড় থামের প্রবেশদ্বার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে| বড় ও ছোট থামের সামনে নীল আকাশ চকচক করছে| পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে প্রবেশদ্বার থেকে যতটা নজরে আসে তার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন দৃশ্য যোগ হতে থাকে| এই পর্যন্ত পৌঁছে বুঝতে পারা যাবে যে থাম থেকে যে নীল আকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো তা আসলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘড়সীসরের নীল জল| তারপর ডাইনে বাঁয়ে সুন্দর পাকা ঘাট, মন্দির, চাতাল, স্তম্ভ-ঘেরা সুসজ্জিত বারান্দা, ঘর, আরও না জানি কী কী| প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া দৃশ্য অতিক্রম করে পুকুরের কাছে পৌঁছে বিশ্রামের সময় চোখ সামনের দৃশ্যগুলিতে কোন একটার ওপর স্থির হতে পারে না| চোখের মণি প্রতি মুহূর্তে ঘুরে ঘুরে ঐ বিচিত্র দৃশ্যকে মেপে নিতে চায়|

কিন্তু চোখ যে তা মাপবে সে সাধ্য তার নেই| প্রায় তিন মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া আগরের এই পুকুরের আগৌর একশো কুড়ি বর্গমাইল ক্ষেত্র বিস্তৃত| এটি জয়সলমেরের রাজা মহা রাওল ঘড়সি তৈরী করিয়েছিলেন বিক্রম সংবত ১৩৯১ –তে, অর্থাত ১৩৩৫ সালে| অন্যান্য রাজারাও পুকুর তৈরী করিয়েছেন কিন্তু ঘড়সি তো এতে নিজে অংশ গ্রহণ করেন| ঘড়সি প্রতিদিন সুউচ্চ কেল্লা থেকে নেমে আসতেন এবং খোঁড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজ নিজে দেখাশোনা করতেন| এই সময়টা জয়সলমেরের পক্ষে খুব একটা ভালো সময় ছিলো না| ভাটি বংশে গদীর দখল নিয়ে অন্তর্কলহ, ষড়য্ত্র ও সংঘর্সের মধ্য দিয়ে চলছিলো| একদিকে মামা নিজের ভাগ্নের ওপর আঘাত হানছিলো, ভাই ব্যস্ত ছিলো ভাইকে দেশ ছাড়া করতে, আবার কোথাও বা কারো খাবারে বিষ মেশান হচ্ছিলো|

রাজবংশ নিজেদের মধ্যে কলহ তো ছিলই, অন্য দিকে রাজ্য ও শহর জয়সলমেরও দেশী বিদেশী হামলাদারদের ঘিরে ফেলছিলো যখন-তখন| পুরুষেরা বীরগতি প্রাপ্ত হচ্ছিল, মেয়েরা নিজেরাই চিতা জ্বালিয়ে নিজেদের আহুতি দিচ্ছিল l

এই রকম জ্বলন্ত সময় ঘড়সি নিজে রাঠোরের রাণার সাহায্য নিয়ে জয়সলমের অধিকার করেন| ইতিহাসে ঘড়সির কাল জয় পরাজয়, বৈভব পরাভব, ও মৃত্যুর ঘাট ও সমর সাগরের মতো শব্দে ভর্তি |

অথচ তখনও সেই সাগর তৈরী হচ্ছিল| দীর্ঘ সময়ের এই পরিকল্পনায় কাজ করার জন্য ঘড়সি অশেষ ধৈর্য ও অপার সাধনাপ্রাপ্ত করেছিলেন| এজন্য অবশ্য তাকে চুড়ান্ত মূল্যই দিতে হয়েছিলো| পাড় তৈরী হচ্ছে, মাহারাওল পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সমস্ত কাজ দেখাশোনা করছেন| এরই মধ্যে রাজ পরিবারের ভেতরে চলা ষড়যন্ত্র পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘড়সির ওপর আক্রমণ করে| সে সময় রাজার চিতায় রাণীর সতী হওয়ার প্রচলন ছিলো রাণী বিমলা সতী হলেন না| তিনি রাজার স্বপ্ন পূরণ করেন|

বালির এই স্বপ্নের দুটো রং রয়েছে| নীল রং জলের এবং হলুদ রং তিন-চার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পুকুরের অর্ধগোলাকার ঘাট, মন্দির মিনার ও বারান্দার| দুটি রং-এর এই স্বপ্ন কিন্তু দিনে দুবার একই রং-এ রঙিন হয়ে ওঠে| উদিত ও অস্তগামী সূর্য ঘড়সীসরে ‘মন’ ভর সোনা ঢেলে দেয়| এ মন মাপ-জোক করার মন নয়, সূর্যের ঠিক যতটায় মন ভরে ততটাই|

মানুষও ঘড়সীসরে নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী সোনা নিক্ষেপ করেছিলো| পুকুর রাজার ছিলো, কিন্তু প্রজারা সেটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করতে থাকে| প্রথম দফায় তৈরী হলো মন্দির ঘাট এবং এই ভাবেই জল মহল বেড়ে চলে| যখন যাঁর যা কিছু ভালো মনে হয়েছে তা সে ঘড়সীসরকে সমর্পণ করেছে| রাজা প্রজার যুগলবন্দীতে ঘড়সীসর হয়ে ওঠে এক অপূর্ব সঙ্গীত|

এক সময় ঘাটের ওপর পাঠশালাও করা হয়েছিলো| শহর বা আশপাশের গ্রামের ছাত্ররা এসে থাকতো| এবং সেখানেই গুরুর কাছে জ্ঞানপ্রাপ্ত হতো| পাড়ের একপাশে ছিলো রান্নাঘর, থাকার ঘর| গ্রাম থেকে লোক শহরে আসতেন কাছারি বা অন্যান্য কাজে| কিন্তু কাজ যদি একদিনে শেষ না হতো বা কোন কারণে আটকে যেতো তাহলে তাঁরা সাময়িকভাবে এখানেই আশ্রয় নিতেন| নীলকণ্ঠ ও গিরিধারীর মন্দির যজ্ঞশালা, জামালশাহ পীরের চৌকি সবকিছু একই ঘাটে| রোজগারের জন্য জয়সলমেরের বাইরে চলে গিয়েছিলো যে সমস্ত পরিবারগুলি তাঁদেরও মন পড়ে থাকতো ঘড়সীসরে| জয়সলমের থেকে গিয়ে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে ডেরা বেঁধে ছিলেন সেঠ গোবিন্দ দাসের পূর্বপুরুষ| দেশে ফিরে সেঠ গোবিন্দ দাস এই পাঠশালে এক বিশাল মন্দির তৈরী করান|

সারা শহরের জল যেতো ঘড়সীসর থেকেই| সাধারণভাবে সারাদিনই এখান থেকে জল ভরা চলতো, তবে সকাল ও বিকেলে জল ভরতে আসা মেয়েদের মেলা লেগে যেতো| এই দৃশ্য শহরে পাইপ আসার আগে পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেছে| ১৯১৯সালে ঘড়সীসরের ওপর রচিত উম্বেদসিংজী মেহেতার রচিত গজলে এই রকম দৃশ্যের খুব সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়| ভাদ্রের উত্সব – তৃতীয়ার মেলায় সারা শহর সেজেগুজে ঘড়সীসরে পৌঁছাতো| শুধুমাত্র নীল ও হলুদ রঙের এই পুকুরে সমস্ত প্রকার রঙ চরিদিকে ছড়িয়ে পড়তো|

ঘড়সীসরের জন্য মানুষের ভালোবাসা একতরফা ছিলো না| মানুষ ঘড়সীসরে আসতো, ঘড়সীসরও তাদের মনে পৌঁছে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলো| দূর সিন্ধু প্রদেশে বসবাসকারী টীলো নামের গণিকার মন সম্ভবত এরকমই কোন মূহুর্তে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে|

পুকুরে ঘাট-পাট সবই ছিলো| ঠাটের কোন কম ছিলো না তবু টীলোর মনে হয় এতো সুন্দর পুকুরে একটা সুন্দর প্রবেশদ্বারও থাকা দরকার| টীলো ঘড়সীসরের পশ্চিমঘাটে ‘পোল’ অর্থাত প্রবেশ দ্বার করানোর সিদ্ধান্ত নেন| পাথরের ওপর সুক্ষ্ম নকশাদার, সুন্দর জানালা দেওয়া বিশাল দ্বার পূর্ণ হয়েই এলেছিলো, এমন সময় কিছু লোক রাজার কাছে গিয়ে কান ভাঙানি দেয় – ‘আপনি এক গণিকার তৈরী প্রবেশদ্বার দিয়ে ঘড়সীসরে প্রবেশ করবেন!’ বিবাদ শুরু হয়ে যায়, ওদিকে প্রবেশদ্বারে কাজ চলছে| এরপর রাজা এটি ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন| টীলো খবর পান| রাতারাতি প্রবেশদ্বারের সবথেকে উঁচু তলায় মন্দির করিয়ে দেন| মহারাজও মত বদলান| তখন থেকেই সারা শহর এই সুন্দর প্রবেশদ্বার দিয়ে পুকুরে যাতায়াত করেন এবং সশ্রদ্ধায় এটিকে টীলোর নামের সঙ্গেই মনে রাখেন|

টীলোর প্রবেশদ্বারের ঠিক সামনে পুকুরের বিপরীতে চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা গোল মিনার| পুকুরের বাইরে তো বাগান প্রভৃতি হয়ই, কিন্তু এই মিনারে পুকুরের ভেতর বাগান তৈরী হয়েছে| এখানে মানুষ ‘গোঠ’ অর্থাত আনন্দ মঙ্গল করতে আসতো| এরইসঙ্গে পূর্বদিকে চারদিকে ঘেরা আরও একটা বড় গোল জায়গা ছিল| সেখানে পুকুর রক্ষাকারী ফৌজ থাকতো| দেশী বিদেশী শত্রুতে ঘেরা রাজ্য সমস্ত মানুষকে জল প্রদানকারী পুকুরের সুরক্ষারও ব্যবস্থা করেছিলো|

ঘড়সীসরে আগৌর এত বড় ছিলো যে মরুভূমিতে যত কম বর্ষাই হোক সেখানের প্রতিটি বিন্দু গড়িয়ে এসে পুকুরকে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতো| তখন পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার ফৌজের হাত থেকে বেরিয়ে নেষ্টার হাতে চলে যেতো| নেষ্টা বইতে শুরু করতো, যে অতিরিক্ত জল পুকুর ভেঙ্গে ফেলতে পারে তা বেরিয়ে যেতো| কিন্তু এই বয়ে যাওয়া ছিলো খুবই বিচিত্র| বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা সংগ্রহ করে ঘড়সীসরকে ভরাতে জানতেন যাঁরা, তাঁরা এই অতিরিক্ত জলকে শুধুই জল নয়, জলরাশি মনে করতেন| নেষ্টা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া জল সামনে একদিকে একটা পুকুরে জমা করা হতো| ঘড়সীসরের নেষ্টা তখনো বইতে থাকলে জমা করা পুকুরের নেষ্টাও বইতে শুরু করতো| এই অতিরিক্ত জলও দ্বিতীয় একটা পুকুরে জমা করা হতো| এই ধরাবাহিকতা নয়টি পুকুর পর্যন্ত চলতো| নৌতাল, গোবিন্দসর, জোশিসর, গোপালসর, ভাটিয়াসর, সূদাসর, মোহতাসর, রতনসর, কিষাণঘাট| এপর্যন্ত পৌঁছেও যদি জল বেঁচে যেতো তাহলে কিশাণঘাটের পর তাকে কিছু বেরিতে অর্থাত কুয়োর মতো ছোট ছোট কুণ্ডে ভরে নেওয়া হতো| জলের এক এক ফোঁটা যেন শব্দ ও বাক্যের মতো ঘড়সীসর থেকে কিষাণঘাট পর্যন্ত সাত মাইল লম্বা রাস্তায় নিজের ঠিক ঠিক অর্থ পেয়ে যেতো|

আজ যারা রাজ্য পরিচালনা করে, যাদের হাতে জয়সলমেরের ভার, তারা ঘড়সীসরের অর্থই ভুলে গেছে তো তার সঙ্গে যুক্ত নয়টি পুকুরের খেয়াল কী করে তাদের থাকবে! ঘড়সীসরের আগৌরে এখন বায়ুসেনার বিমানঘাঁটি হয়েছে| তাই আগৌরের জল এখন পুকুরের দিকে না এসে অন্য কোথাও বয়ে যায়| নেষ্টা ও তার রাস্তায় পড়ে যে নয়টি পুকুর তার আশপাশেও আজ দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠা শহরের গৃহ ও নতুন গৃহ নির্মাম সমিতিগুলির, এমন কী জলের সমস্যা নিয়ে যারা নতুন কাজ করছে সেই ইন্দিরা প্রাধিকরণের অফিস হয়েছে এবং তাতে যারা কাজ করে তাদের কলোনি গড়ে উঠেছে|

ঘাট, পটসাল, রান্নাঘর, বারান্দা, মন্দির সবকিছুই যথার্থ দেখাশোনার অভাবে আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে| শহর আজ আর লহা্স খেলে না, যাতে রাজা প্রজা সকলে মিলে ঘড়সীসরকে পরিষ্কার করতো, পাঁক বার করতো| পুকুরের ধারে স্থাপিত জলস্তম্ভও কিছুটা নড়বড়ে হয়ে এক দিকে হেলে পড়েছে|

তবুও ছয়শো আটষট্টি বছরের ঘড়সীসর এখনও মরে যায়নি| যাঁরা ঘড়সীসর তৈরী করেছিলেন তাঁরা তাকে সময়ের থাপ্পড় সহ্য করার মতো মজবুত করেই করেছিলেন| মরুভূমির বালির ঝড়ের মাঝে নিজেদের পুকুরটিকে যাঁরা উন্নত রক্ষণাবেক্ষণে বেঁধেছিলেন সম্ভবত তাঁরা এটা জানতেন না যে কখনও উপেক্ষার ঝড়ও বইতে পারে| কিন্তু এই ঝড়কেও ঘড়সীসর ও যাঁরা ঘড়সীসরকে চান তাঁরা খুব ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে চলেছেন| পুকুর পাহারা দেওয়ার জন্য আজ ফৌজ না থাকলেও মানুষের মনের পাহারা আজও রয়েছে|

সূর্যের প্রথম কিরণের সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরে ঘন্টা বেজে ওঠে| দিনভর মানুষ ঘাটে যাতায়াত করেন| কিছু মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা মৌন বসে ঘড়সীসরের দিকে চেয়ে থাকতেন| কেউ গান করেন, কেউ ‘রাবন হত্মা’(এক ধরণের সারেঙ্গী)বাজান|

মেয়েরা জল নেওয়ার জন্য আজও ঘাটে আসে| উটের গাড়িতেও জল যায়| এখন দিনে কয়েকবার ট্যাঙ্কারও দেখা যায়, যাতে ঘড়সীসর থেকে জল ভরার জন্য ডিজেল পাম্প পর্যন্ত লাগানো থাকে|

ঘড়সীসরের জন্য মানুষের ভালোবাসা একতরফা ছিলো না l মানুষ ঘড়সীসরে আসতো, ঘড়সীসরও তাদের মনে পৌঁছে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলো l দূর সিন্ধু প্রদেশে বসবাসকারী টীলো নামের গণিকার মন সম্ভবত এরকমই কোন মূহুর্তে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে l

ঘড়সীসর আজও জল দিয়ে চলেছে| আর সেইজন্য উদিত ও বিদায়ী সূর্য আজও মন ভর সোনা ঢেলে যায়|

ঘড়সীসর এক দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলো| এর পর আর কোথাও পুকুর করা কঠিন ছিল বোধহয়| কিন্তু তবুও জয়সলমেরে প্রতি একশো বা পঞ্চাশ বছর অন্তর মানিকসম ঘড়সীসরের সঙ্গে মুক্তোর মতো গাঁথা হয়ে একের পর এক পুকুর হতে থাকে|

ঘড়সীসর থেকে প্রায় একশো পঁচাত্তোর বছর পর তৈরী হয় জৈতসর| বাঁধনের মতই পুকুর ছিলো জৈতসর| তবে সংলগ্ন বিশাল বাগানের জন্য পরে একে ‘বড়াবাগ’-এর মতই মনে রাখা হয়েছে| এই পাথরের বাঁধ জয়সলমেরের উত্তর দিকের খাড়া পাহাড় থেকে আসা সমস্ত জল আটকে রেখেছে| একদিকে জৈতসর ও অন্যদিকে রয়েছে এই জল থেকেই সিঞ্চিত বড়াবাগ| এ-দুটিকে পৃথক করে রেখেছে বাঁধের দেওয়াল| তবে এটিকে দেওয়াল নয়, বড়সড় চওড়া রাস্তা মনে হয়| যা ঘাটি পার করে সামনের রাস্তা পর্যন্ত চলে গেছে| দেওয়ালের নীচে সেচ নালার নাম রামনাল|

রামনাল নহর, বাঁধের দিকে সিঁড়ির মতো| জৈতসরে জলের স্তর বেশি হোক বা কম, নহরের এই সিঁড়ির মতো গঠন, জল বড়াবাগের দিকে নামিয়ে নিয়ে যায়| বড়াবাগে পৌঁছে রামনাল রামের নামের মতোই কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে| নহরের প্রথম কিনারে একটা কুয়ো রয়েছে| জল শুকিয়ে গেলে বা নহর বন্ধ হয়ে গেলে চুঁইয়ে রড়া জলে ভর্তি এই কুয়ো ব্যবহার করা হয়| ওদিকে আগরের জল শুকিয়ে গেলে গম বুনে দেওয়া হয়| তখন দেওয়ালের দু-দিকই সবুজ আর সবুজ|

‘হারাবাগ’ সত্যি সত্যি খুবই বড়| বিশাল উঁচু আমের বাগান ও তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের গাছপালা| অধিক বৃষ্টিপাতের এলাকায় নদীর ধারে সাধারণত যে ধরণের বড় বড় অর্জুন গাছ পাওয়া যায়, বড়াবাগে তাও পাওয়া যাবে| সূর্যের কিরণ বড়াবাগের গাছের পাতায় আটকে থাকে| হাওয়া দিলে পাতা নড়ে, সুযোগ বুঝে ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছুটা কিরণ ঢুকে পড়ে| বাঁধের ওপাশে রাজবংশের শ্মশান| সেখানে স্বর্গতদের উদ্দেশ্যে সুন্দর ছত্র করানো রয়েছে|

ঘড়সীসরের তিনশো পঁচিশ বছর পর তৈরী হয় অমর সাগর| এক্ষেত্রেও প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো বয়ে যাওয়া জলকে আটকানো| তবে অমর সাগর যাঁরা তৈরী করেছিলেন তাঁরা এটাও জানাতে চেয়েছিলেন যে উপযোগী ও সুন্দর পুকুর তৈরীর করার ইচ্ছা অমর| পাথরের টুকরো জোড়া দিয়ে কতখানি ‘বেজোড়’ পুকুর হতে পারে অমর সাগর তার বিরল উদাহরণ| পুকুরের চওড়া একটা বাহু বেরিয়ে এসেছে খাড়া একটা দেওয়াল থেকে, দেওয়ালের সঙ্গে জোড়া সিঁড়ি, জানালা ও মিনার ছুঁয়ে তা নীচে নেমে গেছে| এই দেওয়ালের সমতল অংশে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় স্থাপিত হয়েছে পাথরের হাতি, ঘোড়া প্রভৃতি| পাথরের এই মূর্তিগুলি পুকুরের জলস্তরের সূচক| অমর সাগরের আগৌর এত বড় নয় যে তার থেকে সারা বছরের জল পাওয়া যাবে| গরম পড়তে না পড়তেই অমর সাগর শুকিয়ে আসে| তার মানে কি এই যে জয়সেলমেরের মানুষ এই সুন্দর পুকুরটিকে সেই সময়ই ভুলে যাবে, যখন সবথেকে বেশি জলের প্রয়োজন|

জয়সলমেরের শিল্পীরা অমর সাগরে এমন কিছু কাজ করেছেন যা শিল্প শাস্ত্রে কয়েকটা নতুন পাতা যোগ করেছে| এই পুকুরের তলায় সাতটা বেরি তৈরী করা হয়েছে| বেরি মানে এক ধরণের বাউড়ি, একে পগবাও-ও বলা হয়| পগবাও শব্দ এসেছে পগবাহ থেকে| বাহ, বায় বা বাউড়ি| পাগবাও অর্থাত পা-পা হেঁটেই যেখানে জল পর্যন্ত পৌঁছানো যায়| পুকুর শুকিয়ে যায় কিন্তু চোঁয়ানো জলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ওপরে উঠে আসে| এই পরিষ্কার ছাঁকা জলে বাউড়ি ভরে থাকে| বাউড়িগুলি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে গ্রীষ্মে অমর সাগর তার সৌন্দর্য হারিয়ে না ফেলে| সমস্ত বাউড়িগুলিতে পাথরের সুন্দর চাতাল, স্তম্ভ, ছত্র ও নীচে নামার জন্য শৈল্পিক সিঁড়ি| শুকনো অমর সাগরের সিড়িগুলি দেখতে লাগে মহলের একাংশের মতো| আর যখন ভরে ওঠে তখন মনে হয় পুকুরে ছাতাওয়ালা নৌকো ভাসছে| গ্রীষ্মের বৈশাখেও অমর সাগরে মেলা বসতো, আর বর্ষার ভাদ্রেও|

জয়সলমের মরুভূমির এমন একটা রাজ্য, বানিজ্যে একসময় যার জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে| তারপর মন্দার সময় এলো, কিন্তু জয়সলমের ও তার আশপাশের পুকুর তৈরীতে মন্দা পড়েনি| গজরূপ সাগর, মূল সাগর, গঙ্গা সাগর, গোপাল পুকুর ও ইসরালজীর পুকুর – একের পর এক পুকুর তৈরী হয়েছে| ধারাটি ইংরাজ আসার আগে পর্যন্ত বজায় ছিলো| তবে এই ধারা, তার সুরক্ষা, শুধুমাত্র রাজ, রাওল বা মহারাণাদের ওপরও ছেড়ে দেওয়া হয়নি| সমাজের সেই অংশ যাদের বর্তমান পরিভাষায় দুর্বল বলা হয়, তারাও সমানভাবে এই ঐতিহ্যপূর্ণ ধারাটিকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন|

তবুও ছয়শো আটষট্টি বছরের ঘড়সীসর এখনও মরে যায়নি l যাঁরা ঘড়সীসর তৈরী করেছিলেন তাঁরা তাকে সময়ের থাপ্পড় সহ্য করার মতো মজবুত করেই করেছিলেন l মরুভূমির বালির ঝড়ের মাঝে নিজেদের পুকুরটিকে যাঁরা উন্নত রক্ষণাবেক্ষণে বেঁধেছিলেন সম্ভবত তাঁরা এটা জানতেন না যে কখনও উপেক্ষার ঝড়ও বইতে পারে l

মেঘা পশু চরাতো : এই গল্প পাঁচশো বছরের পুরানো| পশুগুলো নিয়ে মেঘা ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তো| মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা মরুভূমি| সারাদিনের জন্য সে এক কোপড়ি(মাটির চ্যাপ্টা কুঁজো)জল সঙ্গে নিতো| ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে| এক দিন মেঘার অল্প একটু জল বেঁচে যায়| কী জানি কী ভেবে মেঘা একটা গর্ত খুঁড়ে জলটুকু তাতে ঢেলে দিয়ে ভালোভাবে তাতে আকন্দ পাতা ঢাকা দিয়ে দিলো| চরানোর কাজ আজ এখানে তো কাল অন্য কোথাও| মেঘা পরের দুদিন আর সেখানে যেতে পারলো না| তৃতীয় দিনে সেখানে পৌঁছে কৌতুহলের সঙ্গে পাতা সরালো| গর্তে অবশ্যই জল ছিলো না কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া লাগলো চোখে মুখে| মেঘা বলে উঠল – ‘ভাপ’! সে ভাবলো এখানে এই অল্প একটু জলের আদ্রতা যটি টিকে থাকে তাহলে এখানে পুকুর হতে পারে|

মেঘা একাই পুকুর খুঁড়তে শুরু করে| এখন সে প্রতিদিন কোদাল, ঝড়া সঙ্গে করে নিয়ে যায়| দিনভর একাই মাটি কাটে, পাড়ে এনে ফেলে| গরুগুলো আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়| ভীমের মতো শক্তি তো তার ছিলো না, তবে সঙ্কল্প ছিলো ভীষ্মের মতোই| দু-বছর সে একাই কাজ করে যায়| সপাট মরুভূমিতে এখন পাড়ের ঘেরা দূর থেকেই দেখা যায়| ধীরে ধীরে পাড়ের খবর একদিন গ্রামেও এসে পৌঁছায়| এরপর ছোট-বড় অনেকেই প্রতিদিন মেঘার সঙ্গে কাজে যাওয়া শুরু করে| সকলে মিলে কাজ করে| বারো বছর পুকুরের কাজ চলে| কিন্তু মেঘার জীবনকাল পূর্ণ হয়ে আসে| তাঁর স্ত্রী সতী হয়নি| এরপর মেঘার বদলে তাঁর স্ত্রী পুকুরের কাজে আসে| আরও ছ’মাস লাগে পুকুর তৈরী হতে|

ভাপ দেখে পুকুর তৈরী হয়েছিলো, তাই সে জায়গার নামও হয়ে যায় ভাপ| পরে যা বিকৃত হয়ে ‘বাপ’ হয়ে যায়| রাখাল মেঘাকে সমাজ মেঘাজী-র সম্মানে স্মরণে রেখেছে আর পুকুরের পাড়ে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে সুন্দর এক ছত্র এবং তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিতে ওখানেই এক দেব মন্দির করা হয়েছে|

‘বাপ’ বিকানের, জয়সলমের রাস্তার ওপর ছোট্ট এক শহর| চা, কচুড়ির ছ-সাতটা দোকানওয়ালা বাসস্ট্যান্ড এবং বাসের তিন গুণ উচ্চতার পাড় স্ট্যান্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে| মে-জুন মাসে পাড়ের এদিকে লু বয়, ওদিকে মেঘাজী পুকুরে ঢেউ ওঠে| বর্ষার দিনে পুকুরে লাখেটা(দ্বীপ) লাগানো হয়| তখন চার মাইল পর্যন্ত জল ছড়িয়ে পড়ে|

মেঘ ও মেঘরাজ যদিও মরুভূমিতে কম আসেন কিন্তু মেঘাজীর মতো লোকের অভাব কোনদিন হয়নি| জল সমস্যার সমাধানে এতখানি যোগ্য হয়ে ওঠা সমাজ, নিজের যোগ্যতা ও কৌশলকে কখনই নিজের বলে অহংকার করে না| তাঁরা এর কৃতিত্ব নতমস্তকে ভগবানের কাছে সমর্পণ করেন| বলা হয়ে থাকে, মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হলে কুরুক্ষেত্র থেকে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে দ্বারকায় ফিরছিলেন| তাঁদের রথ মরুপ্রদেশের ওপর দিয়ে চলেছিলো| বর্তমান জয়সলমেরের কাছে ত্রিকুট পর্বতে তাঁরা উত্তুঙ্গ ঋষিকে তপস্যা করতে দেখেন| প্রণাম করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বর চাইতে বলেন| উত্তুঙ্গ অর্থাত উচুঁ| সত্যিই ঋষি উঁচু মনের মানুষ ছিলেন| তিনি নিজের জন্য কিছুই চাইলেন না| প্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন – ‘হে ভগবান, যদি আমার কিছুমাত্র পূ্ণ্য থেকে থাকে, তাহলে বর দিন এই এলাকায় যেন কোন দিন জলের অভাব না থাকে|

মরুভূমির সমাজ এই বরদান-কে আদেশের মতো গ্রহণ করেন এবং নিজেদের দক্ষতা ও কৌশলে মরীচিকাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন|

১. ভারতের প্রায় অর্ধেক জায়গায়(৪৯.২%)গড় বৃষ্টিপাত তিরিশ ইঞ্চি(৭৬ সে মি)-র মতো| ২৯.৬ শতাংশ এলাকায় এর পরিমান ৪৬ইঞ্চি(প্রায়১১৪ সে মি)-র বেশি| পরবর্তী এলাকার মধ্যে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ| কাজেই বৃষ্টপাতের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে| রাজ্যের যে দুটি জেলার বৃষ্টিপাত সব থেকে কম(পুরুলিয়া ও মুর্শিদাবাদ) সেগুলিরও পরিমাণ ৫৩ থেকে ৫৪ ইঞ্চি| যা ভারতের অর্ধেক এলাকায় যে বৃষ্টিপাত হয় তার প্রায় দ্বিগুণই| কিন্তু বৃষ্টিপাতের পরিনাণই যে একমাত্র কথা নয় তা আমরা ফি বছরে খরা ঘোষিত হওয়া পুরুলিয়ার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি| আর মুর্শিদাবাদের আর্সেনিক সমস্যার ভয়াবহতা নতুন করে বলার কিছু নেই বা এই পরিসরে তা বলা সম্ভবও নয়| (পরিসংখ্যানটি নেওয়া হয়েছে – পশ্চিমবঙ্গের জল সমস্যা : নাগরিক মঞ্চ : কলকাতা)

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishraa in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bunddelkhand, Tanks in Rajasthan

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading