পুকুর বাঁধা ধর্মস্বভাব

5 Apr 2016
0 mins read

আজ সম্ভবত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কিন্তু তখন বড় বিদ্যাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তটি পুকুর তৈরীর প্রসঙ্গে বদলে যেতো| মধুবনী, দ্বারভাঙ্গা এলাকায় এই ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল বহুদিন| কোন পুকুরই একা নয়| সে ভরভরন্ত জল পরিবারের এক সদস্য| তাতে সকলের জল মিশে আছে ও তার জল মিশে আছে সকলের মধ্যে| এই কথা যাঁরা মে করেন তাঁরা সত্য সত্যই এরকমই এক পুকুর তৈরী করে দেখিয়ে দিয়েছেন| পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে বিন্দু সাগর| সমস্ত দেশের প্রবাহ, সমস্ত নদী এমনকী সাগরের জল পর্যন্ত এখানে মিলিত হয়েছে| দূর দূরান্ত থেকে পুরীতে আসেন যে সকল ভক্ত, তাঁরা নিজেদের এলাকার একটুখানি জল সঙ্গে করে নিয়ে এসে বিন্দু সাগরে অর্ঘ্য দেন| সমাজকে যা জীবন দান করে তাকে নির্জীব বলে কী করে স্বীকার করা সম্বভ? পুকুর, জলস্রোত-ই জীবন| আর মানুষ তো তার চারদিকেই জীবন রচনা করেছে| যার সঙ্গে সম্বন্ধ যত কাছের, যত স্নেহের, মন ততই তার নিত্য নতুন নাম রাখে| দেশের আলাদা আলাদা রাজ্যে, আলাদা আলাদা ভাষায়, চলিত কথায় পুকুরের অনেক নাম| চলিত কথার ভান্ডারে, ব্যাকারণে, পর্যায়ক্রমিক শব্দ তালিকাতে পুকুরের নামের এক ভর-ভরন্ত সংসার পাওয়া যায়| ডিঙ্গল ভাষার একটি ব্যাকরণ বই ‘হমির নাম মালা’-তে পুকুরের পর্যায়ক্রমিক নাম তো রয়েইছে, সঙ্গে তার স্বভাবের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ধর্মস্বভাব’ কথাটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে|

মানুষ ধর্মস্বভাবের সঙ্গে জুড়ে যায়, বাঁধা পড়ে যায়| প্রসঙ্গ যদি হয় সুখের, তাহলে পুকুর তৈরী হবে, প্রসঙ্গ যদি হয় দু:খের, তাহলেও পুকুর তৈরী হবে| জয়সলমের, বাড়মের-এর পরিবারগুলিতে সামর্থ কম থাকলে, নতুন পুকুর করার সুযোগ না থাকলে, সেই সীমিত সাধ্যে তাঁরা আগের তৈরী কোন পুকুরের পাড়ে মাটি দেওয়া, ছোটখাটো মেরামতি প্রভৃতি করতেন| কোন পরিবারে মৃত্যু না আসে? কিন্তু প্রতিটি পরিবার নিজের দু:খের প্রসঙ্গকে সমাজের সুখের জন্য পুকুরের সঙ্গে জুড়ে দিতেন|

পুরো সমাজের উপরই দু:খ এসেছে, দুর্ভিক্ষ এসেছে কিন্তু তবুও পুকুর তৈরী হয়েছে| মানুষের সাময়িক সাহায্য তো এতে হয়ই এবং জলের ব্যবস্থা হওয়ার ফলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দু:খকে সহ্য করার শক্তিও সমাজে গড়ে ওঠে| বিহারের মধুবনী এলাকায় ছয়ের দশকে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় পুরো এলাকার সব গ্রামগুলি মিলে তেষট্টিটা পুকুর খুঁড়েছিল|

এত বড় পরিকল্পনা পরিকল্পিত হওয়ার থেকে কাজে পরিণত হওয়া পর্যন্ত না জানি কত সংগঠন তৈরী করতে হয়েছিল – নতুন মানুষজন, নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থাগুলি সেটা একবার ভেবেও তো দেখতে পারে| মধুবনীতে পুকুরগুলি এখনও আছে এবং মানুষজন এখনও সে কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে|

কোথাও পুরস্কার স্বরূপ পুকুর করে দেওয়া হতো তো কোথাও পুকুর করার জন্য পুরস্কৃত করা হতো| গোণ্ড রাজাদের সীমায় যেই পুকুর করুক তাঁকে তার নীজের জমির খাজনা দিতে হতো না| এই প্রথা বিশেষভাবে দেখা যায় সম্বলপুর এলাকায়|

দণ্ড বিধানেও পুকুর পাওয়া যায়| বুন্দেলখণ্ডে জাতীয় পাঞ্চায়েতে যখন নিজেদের কোন সদস্যকে ক্ষমাহীন কোন অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হতো, তখন সেই দণ্ডতে সাধারণত পুকুর কাটতে বলা হতো| এই ঐতিহ্য রাজস্থানেও আছে| আলোয়ার জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম গোপালপুরা, সেখানে যাঁরা পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত মানেননি দণ্ডস্বরূপ তাঁদের কিছু কিছু পয়সা গ্রাম কোষাগারে জমা করতে হয়| পরে সেই পয়সা দিয়ে ছোট ছোট দুটো পুকুর কাটানো হয়|পুঁতে রাখা সম্পত্তি কেউ পেলে নিজের জন্য নয়, ঐতিহ্য ছিলো পরোপকারে ব্যবহার করার| পরোপকার বলতে সাধারণভাবে মনে করা হতো পুকুর খোঁড়া বা পুরোনো পুকুরের সংস্কার করানো| বলা হয়, বুন্দেলখণ্ডের মহারাজা ছত্রসালের ছেলে জগতরাজ মাটিতে পুঁতে রাখা সম্পত্তির এক তালিকা পেয়েছিলেন| তালিকার নির্দেশ অনুসারে তিনি সে সম্পত্তি খুঁড়ে বার করেন| ছত্রসাল জানতে পেরে খুবই অসন্তুষ্ট হন| ছেলেকে বলেন – ‘মৃত চন্দেলকে কেন তুমি খুঁড়লে’? কিন্তু সম্পত্তি খুঁড়ে যখন বার করা হয়েই গেছে তখন তা যেন ভাল কাজে ব্যবহার হয়| তিনি পুত্রকে আদেশ দিলেন – ‘চন্দেলের তৈরী সমস্ত পুকুরগুলি মেরামত করা হোক ও নতুন পুকুর তৈরী করা হোক’ | সম্পত্তি ছিলো প্রচুর| পুরোনো পুকুরগুলি মোরামত করা হলো এবং নতুন খোঁড়াও শুরু হল| বংশ তালিকা দেখে বিক্রম সংবত ২৮৬ থেকে ১১৬২ পর্যন্ত বাইশ প্রজন্মের নামে বাইশটা পুকুর তৈরী করা হয়| বুন্দেলখণ্ডে গেলে আজও পুকুরগুলি দেখতে পাওয়া যাবে|মাটিতে খোঁড়া সম্পত্তি সকলে পায় না| কিম্তু সকলকে পুকুরের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার জন্য কিছু দৃষ্টান্ত সমাজে রয়েছে| অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা এই দিন দুটিকে ‘করাজ’ অর্থাত ভালো এবং সর্বজনীন কাজের দিন হিসাবে ঠিক করা হয়েছে| কৃষক এই দিন দুটিতে নিজের নিজের খেতে কাজ করত না, সেই সময়টা সে দিত নিজের নিজের এলাকার পুকুরের দেখাশোনা বা মেরামতিতে| সমাজে শ্রমও একটা পুঁজি| সেই পুঁজি লাগানো হতো সর্বজনীন মঙ্গলে|

শ্রমের সঙ্গে পুঁজিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে আলাদা করে| এই পুঁজির প্রয়োজন পড়বে শীতের পর পুকুরের জল কমে গেলে| তখন গ্রীষ্ম সামনে দাঁড়িয়ে, পুকুরে কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে, কোথাও ভেঙ্গে-টেঙ্গে গেছে তা দেখে নেওয়ার এটাই সবথেকে ভালো সময়| বছরের বারোটা পূর্ণিমা রাখা হয় শ্রমদানের জন্য কিন্তু পৌষের পূর্ণিমায় পুকুরগুলির তত্ত্বাবধান বা পুকুরের জন্য পয়সা জোগাড়ের চল রয়েছে| ছত্রিশগড়ে এই সময় পালিত হতো ছের-ছেরা উত্সব| ছের-ছেরা উত্সবে সকলে দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঘরে গিয়ে ধান জোগাড় করতো| সময়টাও ধান ওঠার সময়| প্রতিটি পরিবার ধান দান করতো নিজের সামর্থ অনুযায়ী| এইভাবে জোগাড় করা ধান রাখা হতো গ্রামকোষে| এই কোষ থেকেই আগামী দিনে পুকুর ও অন্যান্য সর্ব্বজনীন ক্ষেত্রের মেরামতি এবং নতুন কাজও করা হবে|

সর্ব্বজনীন পুকুরে তো সকলের শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন হতোই, ব্যক্তিগত পুকুরেও সর্ব্বজনিক স্পর্শ আবশ্যিক ছিল| পুকুর খোঁড়া হয়ে গেলে সেই এলাকার সব সর্ব্বজনিক স্থান থেকে একটু একটু করে মাটি এনে পুকুরে ফেলার প্রচলন আজও পাওয়া যায়| ছত্রিশগড়ে পুকুর হলেই তাতে ঘোড়াশাল, হাতিশাল, বাজার, মন্দির, শ্মশান, বেশ্যালয়, আখড়া ও স্কুলের মাটি এনে ফেলা হতো|

আজ সম্ভবত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কিন্তু তখন বড় বিদ্যাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তটি পুকুর তৈরীর প্রসঙ্গে বদলে যেতো| মধুবনী, দ্বারভাঙ্গা এলাকায় এই ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল বহুদিন|পুকুরেরও প্রাণ রয়েছে. তাই প্রাণপ্রতিষ্ঠা উত্সব পালিত হতো খুব ধুমধাম করে| পুকুরের নামকরণও হতো সেই দিনই| কোথাও কোথাও তাম্রফলক বা প্রস্তর ফলকে পুকুরের পুরো বিবরণ উত্কীর্ণ করা হতো|

কোথাও কোথাও বিয়ের পুরো নিয়মানুসারে বিয়ে দেওয়া হতো| ছত্রিশগড়ে এই প্রথা আজও রয়েছে| বিয়ের আগে পুকুরের জল ব্যবহার করা যাবে না| বিয়েতে পুরো গ্রাম জমা হয়| আশপাশের মন্দির থেকে মাটি আসে| গঙ্গাজল আসে| গঙ্গাজলের সঙ্গে পাঁচটা বা সাতটা কুয়ো অথবা পুকুরের জল মিশিয়ে বিয়ে শেষ হয়| কখনো কখনো প্রস্তুত কারকেরা সামর্থ অনুযায়ী পণের ব্যবস্থা করেন|

পুকুরে বিয়ের১ উত্সবের স্মৃতিতে পুকুরে স্তম্ভ বসানোর ঐতিহ্য তো রয়েইছে| কিন্তু পরে দ্বিতীয়বার যখন পুকুর পরিষ্কার বা খোঁড়া হতো সেই ঘটনার স্মরনেও স্তম্ভ লাগানোর ঐতিহ্য ছিলো|

বর্তমান পরিভাষায় বড় শহর পরিগণিত হয় জনসংখ্যার হিসেবে| অতীতে কিন্তু বড় গ্রাম বা শহরের পরিভাষায় পুকুর গোনা হতো| কত জলসংখ্যার গ্রাম বা শহর ? এ প্রশ্নের বদলে জিজ্ঞাসা কর হতো কত পুকুরের| ছত্রিশগড়ে প্রবাদে বড় গ্রামকে বলা হয়েছে ‘ছৈ আগর ছৈ কোরি’ অর্থাত ছয় কুড়ির থেকে ছয় বেশী পুকুর হওয়া চাই| বর্তমান বিলাসপুর জেলার মালহার এলাকায় যে ঈসা অতীতে স্থাপিত হয়েছিল, সেখানে একশো ছাব্বিশটি পুকুর ছিলো| ঐ এলাকারই রতনপুর (দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী), খরৌদি((সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী), রায়পুরের আরঙ্গ ও কুবরা এবং সরগুঞ্জা জেলার দীপডিপা প্রভৃতি গ্রামে আজও কোথাও বা একশো আবার কোথাও পুরো একশো কুড়িটি পুকুর গোণা যেতে পারে|

এই পুকুরগুলির দীর্ঘ জীবনের রহস্য ছিলো একটাই – মানুষের ভালোবাসা ও মমত্ব| এ শব্দটা আমার দেওয়া| এইসব দৃষ্টান্তের পর রক্ষণাবেক্ষণের মতো শব্দ বড় ছোট লাগে| ‘ভূজলিয়ার আট অঙ্গ যেমন জলে ডোবে’- এ গান গাইতে পারেন, এ কামনা২ করতে পারেন, এমন স্ত্রীলোকেরাও ছিলেন| আর এরকম স্ত্রীলোকেরা যদি থাকেন তাহলে তার পিছনে সেরকম সমাজও ছিলো, যাঁরা এই কামনাকে পূরণ করার মতো পরিবেশ তৈরী করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করতেন| ঘরগৈল, ঘরমৈল অর্থাত সব ঘরের মিলনেই পুকুরের কাজ হতো|

সকলের মিলনেই তীর্থ| যিনি তীর্থে যেতে পারেননি তিনি নিজের এলাকাতে পুকুর করিয়ে পুণ্য অর্জন করতে পারেন| যিনি পুকুর তৈরী করেন তিনি পুণ্যাত্মা| আর যাঁরা পুকুর বাঁচিয়ে রাখেন তারাও সমান সম্মানের অধিকারী| এইভাবে পুকুর এক তীর্থ| এখানে মেলা বসে| আর এই মেলায় জমা হওয়া সমাজ পুকুরকে নিজেদের নয়নে ও হৃদয়ে যায়গা দিয়েছেন|

পুকুর সমাজের মনে রয়েছে| আবার কোথাও শরীরেও| অনেক বনবাসী মানুষই পুকুর, বাউড়ির উল্কি করান| সহরিয়া সমাজ উল্কিতে পশু, পাখি, ফুল, মাছ... ইত্যাদির সাথে সীতা বাউড়ি বা সাধারণ বাউড়িও বানান| সহরিয়া নিজের শরীরকে পূর্ব পুরুষ মনে করে, সীতাজীর সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ আছে বলে ভাবে| তাই সহরিয়া খুব গর্বের সঙ্গে সীতা বাউড়ি উল্কিতে আঁকায়|

সীতা বাউড়ির বিশালতা প্রধান্য পেয়েছে ভেতরে ঢেউ| মাঝখানে একটি ছাট্ট বিন্দু, যা জীবনের প্রতীক| বিস্তারের বাইরে সিঁড়ি এবং চার কোণায় ফুল| ফুলে জীবনের সুবাস| এত কথা এক সহজ-সরল রেখাচিত্রে ফুটিয়ে তোলা খুব একটা সহজ নয়| কিন্তু যাঁরা উল্কি করেন সেই শিল্পীগণ এবং উল্কি করাতে চান যে নারী-পুরুষ তাঁদের সকলেরই হৃদয় – পুকুর, বাউড়িতে এতই বিহ্বল যে আট-দশটা রেখা, কয়েকটা ফুটকি শরীরে পুরো দৃশ্যটিকে সহজেই ফুটিয়ে তোলে| এই প্রথা তামিলনাড়ুর দক্ষিণে আরকাট জেলার কুঁরাও সমাজেও রয়েছে|

যাঁদের মনে পুকুর, শরীরে পুকুর, তাঁরা পুকুরকে শুধু একটা জলভরা গর্ত মনে করতে পারেন না| তাঁদের কাছে পুকুর এক জীবন্ত ঐতিহ্য, পরিবার ও অনেক সম্বন্ধ-সম্বন্ধী| কোন সময় কাকে স্মরণ করতে হয় সে সম্পর্কেও তাঁদের পূর্ণ চেতনা আছে| যেমন, যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে কতদূর প্রার্থনা পৌঁছতে হবে? ইন্দ্র হলেন বৃষ্টির দেবতা, কিন্তু সরাসরি তাঁকে ডাকা কঠিন, সম্ভবত ঠিকও নয়| তাঁর মেয়ে কাজল| কাজল মায়ের কাছ পর্যন্ত প্রার্থনা পৌঁছালে তিনি ভালোভাবে পিতার নজর এদিকে টানতে পারবেন| বীজ ফেলার পক্ষকালের মধ্যে বৃষ্টি না হলে কাজল মায়ের পূজা হবে| গোটা গ্রাম কাঁকড়বনি অর্থাত গ্রাম সীমার জঙ্গলে যে পুকুর, গান গাইতে গাইতে সেখানে জড়ো হবে| তারপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে সকলে প্রার্থনা জানাবে| দক্ষিণ থেকেই তো জল আসে|

পুকুর কানায় কানায় ভরে ওঠাও এক উত্সব| অপরা বইতে শুরু করেছে – সমাজের কাছে এর থেকে বড় আর কোন প্রসঙ্গ হতে পারে! ভুজ(কচ্ছ)-এর সব থেকে বড় পুকুর হমিরসর-এর ঘাটে হাতির এক মূর্তি অপরা বইতে শুরু করার সূচক| মূর্তি স্পর্শ করলেই খবর ছড়িয়ে পড়ত| শহর এসে উপস্থিত হত ঘাটে| কম বৃষ্টিপাতের এই এলাকা দিনটিকে উত্সবে স্মরণীয় করে তুলতো| ভুজের রাজা ঘাটে আসতেন ও সকলের উপস্থিতিতে পুকুরের পূজো করে ভরা পুকুরের আশির্বাদ নিয়ে ঘরে ফিরতেন| টলটলে ভরে ওঠা পুকুর শুধুই একটা ঘটনা নয়, আনন্দ ও মঙ্গলের সূচক| উত্সব, মহোত্সব রাজা-প্রজাকে ঘাট পর্যন্ত নিয়ে আসে|

এই দিনগুলিতে দেবতারাও ঘাটে আসেন. জলঝুলন উত্সবে মন্দিরগুলির চলমূর্তি৪ পুকুর পর্যন্ত আনা হয় এবং পূর্ণ শৃঙ্গারের সঙ্গে তাঁদের দোলনায় দোলানো হয়| ভগবানও শ্রাবণের ঝুলনে দোলার আনন্দ উপভোগ করেন|কোন পুকুরই একা নয়| সে ভরভরন্ত জল পরিবারের এক সদস্য| তাতে সকলের জল মিশে আছে ও তার জল মিশে আছে সকলের মধ্যে| এই কথা যাঁরা মনে করেন তাঁরা সত্য সত্যই এ রকমই এক পুকুর তৈরী করে দেখিয়ে দিয়েছেন| পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে বিন্দু সাগর| সমস্ত দেশের প্রবাহ, সমস্ত নদী এমনকী সাগরের জল পর্যন্ত এখানে মিলিত হয়েছে| দূর দূরান্ত থেকে পুরীতে আসেন যে সকল ভক্ত, তাঁরা নিজেদের এলাকার একটুখানি জল সঙ্গে করে নিয়ে এসে বিন্দু সাগরে অর্ঘ্য দেন|

এই মুহূর্তে যখন দেশের একতা প্রশ্নচিহ্নের মুখে তখন বিন্দু সাগরকে রাষ্ট্রীয় একতার সাগর বলা যেতে পারে| বিন্দু সাগর যেন অখণ্ড ভারতের প্রতীক|

ভবিষ্যত কাল কেমন হবে.. এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সব সময়ই শক্ত. কিন্তু এরও একটা মানদণ্ড ছিল – ‘পুকুর’ | নবরাত্রের পর অঙ্কুরিত যব বিসর্জন দেওয়া হয় পুকুরে| এই সময় রাজস্থানের মানুষ জড়ো হতেন পুকুরে| ভোপা অর্থাত পুরুত ঠাকুর যব বিসর্জনের পর পুকুরের জলস্তর দেখে আগত দিনের ভবিষ্যত বাণী করতেন| বর্ষা ততদিনে পেরিয়ে গেছে, পুকুরে যতটা জল আসার কথা, এসে গেছে| এখন এই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের পরিস্থিতি|আজকাল এই প্রথা প্রায় উঠেই গেছে| পুকুরের জলস্তর দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে আজ অনেক পুকুরের পাড়ে দাঁড়ানো ভোপাই বলবেন – ‘সময় খারাপ আসছে’ |

পষ্চিমবাংলাতেও পুকুরের বিয়ে এখনও প্রচলিত রয়েছে| যে পুকুরের মাঝে শাল কাঠের স্তম্ভ বা ছোট্ট মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, বুঝতে হবে সে পুকুরের বিয়ে হয়েছে| পুকুর প্রতিষ্ঠারও প্রচলন রয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠাতেও স্তম্ভ লাগানো হয়, তবে এক্ষেত্রে সাধারণত বেল কাঠ ব্যবহার করা হয়|

বাংলা বা বিহারের উত্সব – জিতাষ্টমী হা জিতিয়া| এই উত্সবের শেষে মেয়েরা পুকুর বা নদীর জলের তলায় দাঁড়িয়ে শসা জাতীয় ফল খেয়ে ব্রত বা উপবাস ভঙ্গ করেন| এই উপবাস হয় আশ্বিন মাসে| অর্থাত পুকুরের আগর তখন জলরাশিতে পরিপূর্ণ| এই উত্সবের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই সমাজের মহিলারা শুধু আট অঙ্গ ডোবার কামনাতেই তাদের ব্রত শেষ করতে চাননি, একেবারে ডুবে পরখ করে নিতে চেয়েছেন| লোককথা বলছে পুত্র লাভের কামনায় মহিলারা করেন এই ব্রত| আশ্বিনের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে সন্ধ্যায় ঘরের উঠোনে পুকুর কেটে শালিবাহন পুত্র জীমূতবাহনের পূজা করেন| লোককথা যাই বলুক, জীমূত মানে মেঘ, আর জীমূতবাহন অর্থাত মেঘযান – ইন্দ্র| তাই পুকুরের সঙ্গে, জলের সঙ্গে এই ব্রতের গভীর সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না|

বৃষ্ট হওয়া না হওয়ার অপেক্ষা না করেই বাংলায় জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ঘরে ঘরে পালিত হতো পূণ্যিপুকুর| এখন আর বাংলার মেয়েদের পূণ্যিপুকুর ব্রত করতে দেখা যায় না|

মন্দির থেকে যে বিগ্রহ বাইরে আনা যায় তা হলো চল মূর্তি|

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishra in Bengali
Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading