সহস্র নাম

3 Dec 2015
0 mins read

যে সময়টায় পুকুরের যত্ন যথেষ্ট ভালোভাবেই করা হতো সেই সময়ও কোন না কোন কারণে এক-আধটা পুকুর সমাজের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েই পড়তো l এইরকম পুকুরকে বলা হতো হাতীতাল l ‘হাতী’ শব্দ সংস্কৃত হত শব্দ থেকে এসেছে l যার অর্থ হলো নষ্ট হয়ে যাওয়া l ‘হত তেরে কি’–র মতো সাধারণ ব্যবহারেও এই শব্দ হতো তেরে ভাগ্য কী- অর্থাত তোর ভাগ্য নষ্ট হয়ে যাক, এ রকম অর্থই বোঝাতো l

উল্লাসের উচ্চতার যে দর্শন, তাকে গভীরতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন যে সব মানুষ তাঁরা জীবনকে জলের একটা বুদবুদ মনে করেন l আর এই সংসারকে বিশাল এক সাগর l এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে, চলে যায় l যুগ আসে যুগ যায়-ঠিক ঢেউয়ের মতো l জীবন ও মৃত্যু তরঙ্গে তরঙ্গায়িত ভবসাগরের দিকে এগিয়ে চলা সমাজ বিভিন্ন প্রকারে পুকুর তৈরী করেছেন এবং খুবই রুচিসম্মতভাবে সেগুলির নামকরণও করেছেন l এই নাম পুকুরের গুণাগুণ স্বভাব বা বিশেষ কোন ঘটনা থেকেও রাখা হতো l নাম এতো প্রকার যে কখনো কখনো তো ভাষা অভিধান কম পড়েছে l তখন চলিত কথা থেকে ধার নেওয়া হয়েছে, কখনো বা সংস্কৃত পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়েছে l সাগর, সরোবর ও সর চারদিকেই পাওয়া যাবে l সাগর ভলোবাসার খাতিরে সগরাও হয়েছে কোথাও কোথাও এবং সাধারণভাবে বড় পুকুরের অর্থে ব্যবহার হয়েছে l সরোবর কোথাও সরবরও l সব সংস্কৃত সরস শব্দ থেকে এসেছে l গ্রামে এর সরসতা কয়েশো বছর ধরে পাওয়া যাচ্ছে l আকারে বড়ো এবং ছোট পুকুরের নামকরণ জোহড়-জোহড়ি, বাঁধ-বাঁধিয়া, তাল-তলৈয়া তথা পুকুর-পুকুরী প্রভৃতি পুলিংঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের এই জোড়গুলি দিয়ে হয়ে আসছে l এই জোড়গুলি রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার এবং বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় l এমন কি সীমা পেরিয়ে নেপালেও l পুকুর সংস্কৃত পুষ্কর থেকে এসেছে l অন্য জায়গায় তো গ্রামে গ্রামে পুকুর ছিলো, আর বাংলায় ছিলো ঘরে ঘরে l সাধারনত ঘরের পিছনে কম জায়গায় ছোট ছোট পুকুরে মাছ চাষ করা হতো l বাংলায় পুকুরের জন্য পুষ্করিনী শব্দও প্রচলিত রয়েছে l পুষ্করতো ছিলই l আদর বা শ্রদ্ধাপূর্বক পুকুরের পর ‘জী’ শব্দ বসে সাধারণ পুকুরকে সামান্য, আসাধারণ পুকুরে পরিণত করে l রাজস্থানে আজমের-এর কাছে পুষ্করজী নামে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র আছে l এখানে ব্রহ্মার মন্দিরও রয়েছে l

যদিও সবথেকে বেশী প্রচলিত নাম পুকুরই কিন্তু পুকুরের নামকরণে এই শব্দের প্রয়োগ কমই পাওয়া যায় l ডিগ্গি নাম হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও দিল্লীতেও পাওয়া যাবে l জল রাখার ছোট্ট চৌবাচ্চা (হৌজ) থেকে শুরু করে বড় পুকুর পর্যন্ত ডিগ্গি নামে পাওয়া যায় l অতীতের দিল্লীতে লালকেল্লার ঠিক সামনে লালডিগ্গি নামে একটি বড় পুকুর ছিলো l অম্বালাতে এখনো অনেক পুকুর রয়েছে যেগুলিকে ডিগ্গিই বলা হয় l ডিগ্গি শব্দ দীঘি দীঘিকা প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে l

হৌজ-এর মতোই পাকা, ছোট্ট প্রকার হলো কুণ্ড l তবে কোথাও কোথাও বড়সড় পুকুরের নামও পাওয়া যায় হৌজ বা কুণ্ড l মধ্রপ্রদেশের খাণ্ডওয়া শহরে কুণ্ড নামে পরিচিতি পেয়েছে অনেক পুকুর l হৌজ-এর একটি অন্যতম উদাহরণ হলো দিল্লীর হৌজখাস, যা এখন পুকুরের চেয়ে পাড়া হিসেবেই বেশী পরিচিতি পেয়েছে l

তাল অনেক জায়গাতেই রয়েছে তবে এর সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একটি শব্দ ‘চাল’ যা এক জায়গাতেই সীমিত রয়ে গেছে l এই জায়গাটি হলো উত্তরপ্রদেশের হিমালয় l এই পাহাড়ী জেলাগুলিতে অতীতে গ্রামে গ্রামে চাল ছিলো l সমভূমি অঞ্চলে গ্রাম বা শহরে পুকুরগুলি, জনবসতির মাঝে বা কাছাকাছি করা হয়, কিন্তু পাহাড়ী গ্রামগুলিতে চাল গ্রাম থেকে কিছু দূরে ওপরে তৈরী করা হতো l চালগুলি সরাসরি খাবার জলের জন্য ব্যবহার করা হতো না ঠিকই কিন্তু চালগুলির জন্যই গ্রামের ঝর্ণাগুলিতে সারা বছর জল পাওয়া যেতো l পাহাড়ে বর্ষার বেগ সামলাতে, হঠাত আসা বন্যা আটকাতে ও সারা বছরের জলের চাহিদা মেটানোর জন্য, চালের প্রচলন এতো বেশী ছিলো যে গ্রাম নিজের ওপরের পাহাড়ে তিরিশ থেকে চল্লিশটা পর্যন্ত চাল তৈরী করতো l

চাল প্রায় তিরিশ হাত লম্বা, একই রকম চওড়া ও চার-পাঁচ হাত গভীর হতো l এটা কোন এক পক্ষের দায়িত্বে থাকতো না l সকলেই চাল তৈরী করতে জানতেন, সকলেই হাত লাগাতেন পরিষ্কারের কাজেও l চাল নিস্তারের কাজে লাগতো l গ্রামের পশু ছাড়াও বন্য পশুদেরও পানীয় জলের জোগান দিতো l

হিমালয়ে চাল কোথাও কোথাও খাল হয়েছে l আবার কোথাও তোলি তো আবার কোথাও চৌরা l আশেপাশের গ্রামগুলিও পরিচিতি পেতো এই নামেই l যেমন- উফরেখাঁল, রানীচৌরা, দুধাতোলি l উত্তরের এই শব্দই দক্ষিণ ভারতে পৌঁছে কেরালায় চৈর ও অন্ধ্রপ্রদেশে চেবরু শব্দে পরিণত হয়েছে l

চৌকো পাকা ঘাটে ঘেরা পুকুরকে চোপরা, চৌপরা আবার ‘র’, ‘ড়’ হয়ে কোথাও কোথাও চৌপড়াও বলা হয় l চৌপড়া উজ্জয়িনীর মতো প্রাচীন শহরে, ঝাঁসির মতো ঐতিহাসিক শহরে বা চিরগাঁও-এর মতো সাহিত্যপ্রধান জায়গাতেও পাওয়া যাবে l

চৌপরার সঙ্গে মিল রয়েছে এমন আরও একটি নাম চৌঘরা l চারিদিকে পাকা ঘাট দিয়ে ঘেরা পুকুরকে চৌঘরা বলে l এরকম আরো একটি নাম তিঘরা l এতে এক দিক সম্ভবত আগৌরের দিকটা কাঁচা রাখা হতো l তিনঘাট ও চারঘাট থেকে এগিয়ে আটঘাটি, আর্থাত যার আটটা ঘাট l এর মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষদের জন্য আলাদা স্নানের ব্যবস্থা ছত্রিশগড়ে মেয়েদের জন্যে ছিলো ডৌকি ঘাট, আর ছেলেদের জন্য ঘাট ডৌকা l কোন ঘাটে গণেশজী বিসর্জিত হতেন তো কোন ঘাটে মা দুর্গা , আবার কোন ঘাটে হয়তো বা তাজিয়া l সবার আলাদা ঘাট l এইভাবেই পুকুরে হয়ে যেতো আট ঘাট এবং তাকে বলা হতো আটঘাটি l

দূর থেকেই দেখতে পাওয়া যেতো আটঘাটি পুকুর ঝলমল করছে কিন্তু গুহিয়া পুকুর সেথানে পৌঁছানোর পরই দেখতে পাওয়া যেতো l গুহিয়া আর্থাত গুহায় লুকিয়ে থাকা পুকুর l এর আকার খুব ছোট, সাধারণত বর্ষার জল জমে নিজে নিজেই পুকুরের আকার নিত l বিহারে দুটো গ্রামের মাঝে নির্জন জায়গায় এখনো গুহিয়া পুকুর দেখতে পাওয়া যায় l

নিজে নিজেই গড়ে ওঠা পুকুরগুলির আরও একটি নাম অমহাতাল l ছত্রশগড়ীতে অমহা শব্দের অর্থ অনায়াস (স্বাভাবিকভাবে)l গ্রামের সঙ্গে লাগোয়া ঘন বনে প্রাকৃতিকভাবে নীচু জমিতে এইরকম পুকুর স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায় l সাধারণত যাঁরা ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন তাঁরা এই পুকুরগুলিকে কিছুটা ঠিকঠাক করে ব্যবহারযোগ্য করে নেন l

অমহা শব্দের আরও একটি অর্থ আম l আম গাছ দিয়ে বড় বড় আমের বাগান দিয়ে ঘেরা পুকুরকে ‘অমহা তলিয়া তাল’ বা ‘আম তরিয়া’ বলা হয় l এইরকমই আরোও একটি নাম আমরোহা l এখন এটা একটা শহরের নাম কিন্তু একসময় আমের গাছ দিয়ে ঘেরা পুকুরের নাম ছিলো l কোথাও কোথাও এরকম পুকুরকে আমরাহ-ও বলা হয়েছে l অমরাহের মতোই রয়েছে ‘পিপরাহ’ l আর্থাত পুরো পুকুরপাড় জুড়ে বিশাল বিশাল অশ্বত্থ গাছ l অমরাহ, পিপরাহতে পাড়ে বা নীচে যতো গাছই লাগানো হোক তা গোনা যেতো, কিন্তু ‘লাখপেড়া’ তাল থাকতো লক্ষ গাছে ঘেরা l লক্ষ অর্থাত অগুণতি l কোথাও কোথাও এইরকম পুকুরকে লাখরাঁও বলা হয়েছে l

লাখরাঁওকে পিছনে ফেলে দেয় ভোপালতাল l ভোপালতালের বিশালতা তার আশেপাশে বসবাসকারীর গর্বকে অহংকারে বদলে দিয়েছে l প্রবাদে একে একমাত্র পুকুর বলা হয়েছে - ‘তাল তো তাল ভোপালতাল, বাকি সব তলৈয়া’ তাল এই বিশাল পুকুরটির সংক্ষিপ্ততম বিবরণেও চমকে উঠতে হয় l একাদশ শতাব্দীতে রাজা ভোজ কর্তৃক নির্মিত এই পুকুর তিনশে পঁষট্টি নালা নদী দিয়ে দুশো পঞ্চাশ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিলো l মালওয়ার সুলতাল হুশেন শাহ পনেরো শতাব্দীতে সামরিক কারণে এই পুকুরটি ভেঙ্গে ফেলেন l হুশেন শাহ-র পক্ষে এই কাজ যুদ্ধের চাইতে কম কিছু ছিলো না l ভোপালতাল ভাঙ্গার জন্য তাঁকে ফৌজ নামাতে হয়েছিলো l বিশাল ফৌজেরও এই কাজে সময় লাগে তিন মাস l এরপর তিন বছর এই পুকুরের জল বয়ে যেতে থাকলো, অবশেষে তল দেখা গেলো l কিন্তু এর পর আগোরের পাঁক রইলো আরও প্রায় ত্রিশ বছর! শুকোনোর পর এখানে চাষ শুরু হয় l তখন থেকে এখনো পর্যন্ত এখানে উন্নতমানের গমের ফলন হয়ে চলেছে l

বড়র কথা এখন থাক, আবার একটু ফেরা যাক ছোট পুকুরে l অগভীর, ছড়ানো ছোট আকৃতির পুকুরকে বলা হয় চিখলিয়া l এই নাম চিখড় অর্থাত কিচড় (কাদা) থেকে এসেছে l এই রকম পুকুরের একটা পুরোন নাম-ডাবর l এখন এটি শুধুমাত্র ডাবরা (ডোবা) শব্দের মধ্যেই বেঁচে রয়েছে l বাই বা বায়ও এইরকম ছোট্ট পুকুরেরই নাম l অবশ্য পরে এই নামটি পুকুর থেকে সরে এসে বাউড়িতে আটকায় l দিল্লীতে কুতুব মিনারের কাছে রাঞ্জো-দের বায় নামক বাউড়ি আজ এই শব্দটির মতোই পুরোনো হয়ে গেছে l

পুরোনো হয়ে যাওয়া নামের তালিকায় নিওয়ান, হ্রদ, কাসার, তড়াগ, তাম্রপর্ণী, তালি, তল্ল প্রভৃতি শব্দগুলিকেও স্মরণ করা যেতে পারে l এর মধ্যে ‘তল্ল’ এমন একটি নাম যা দীর্ঘ সময় পার করেও বাংলা ও বিহারে ‘তল্লা’ রূপে আজও টিকে রয়েছে l এরকমই একটি পুরোনো শব্দ ‘জলাশয়’, যা ডুবে গিয়েও সরকারী সেচ বিভাগের কল্যাণে আবার উঠে এসেছে l অনেক জায়গাতেই খুবই পুরেনো পুকুরের পুরেনো নাম যা সমাজ মনে রাখার যোগ্য বলে মনে করেনি, তা ক্রমে ক্রমে মুছে গেছে এবং তার আবার নতুন নাম দেওযা হয়েছে l পুরনৈহা-অর্থাত বহু পুরোনো পুকুর l আশপাশের পুকুরের তুলনায় একেবারে প্রথমে তৈরী নৈতালকে একসময় নয়াতাল বলা হতে লাগল l পুরেনো হয়ে গেলেও কিন্তু এটি এই নামেই পরিচিত থাকবে l

গুজকুলিয়া বলা হয় এমন পুকুরকে যা ছোট কিন্তু পাড় থেকেই গভীর l পল্বলও এই রকমই গভীর পুকুরেরই নাম l সময়ের তীব্র গতিতে এই নামও পিছনে পড়ে গিয়েছে l আজ এই নাম বেঁচে রয়েছে দিল্লীর কাছে পলওল নামে ছোট্ট একটা শহর ও স্টেশনের নামে, যে স্টেশনে ট্রেন না দাঁড়িয়েই চলে যায় !

খুদতাল ছত্রিশগড়ে এমন এক পুকুরকে বলা হয় যেটির জল ঝকঝকে পরিষ্কার ও পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় l পনখতি পুকুর শুধুমাত্র নিস্তারের কাজে লাগে l এই রকমই লগুয়াতাল ও খুরতাল l এগুলি নিস্তার, সেচ ও পশুদের পানের কাজে লাগতো l

আলাদা আালাদা ভাবে তৈরী পুকুর ছাড়াও কোথাও কোথাও একটিকে অন্যটির সঙ্গে জুড়ে পুকুর শৃঙ্খল তৈরী হতো l প্রথমটার অতিরিক্ত জল দ্বিতীয়টায় l দ্বীতীয়টার তৃতীয়টায় – এ রকম ব্যবস্থা কম বৃষ্টিপাতের জায়গা রাজস্থান ও অন্ধ্রের রায়লসীমা এলাকায়, আবার সাধারণ বৃষ্টিপাতের জায়গা বুন্দেলখণ্ড বা মালওয়াতে এমনকী অধিক বৃষ্টিপাতের জায়গা গোয়া, কোঙ্কনেও সমভাবে পাওয়া যায় l উত্তরে এর নাম সাঁকল বা সাঁখল এবং দক্ষিণে বলা হয় দশফলা পদ্ধতি l

পুকুরের এই শৃঙ্খল মোটামুটিভাবে দুই থেকে দশ পর্যন্ত চলে l শৃঙ্খল যদি দুটি পুকুরের মধ্যে হয় তাহলে তাকে ছিপলাই বলে l অর্থাত বড় তাল-এর পিছনে লুকিয়ে যাওয়া তলাই l যে পুকুরটা সামনে রয়েছে, দেখতেও খুব সুন্দর, তার নাম যাই হোক না কেন সেটিকে সগুঁরি তলাই বলা হতো l যে পুকুরে কুমীর থাকতো সে পুকুরের নাম যত বড় রাজার নামেই হোক না কেন, মানুষজন নিজেদের সাবধানতার জন্য, শিক্ষার জন্য মগরাতাল নামেই ডাকতো l অথবা নকয়াতাল বা নকরাতাল l নকরা শব্দ সংস্কৃত নক্র অর্থাত কুমীর থেকে এসেছে l কিছু জায়গায় গাধয়া তাল পাওয়া যায় l গাধয়া তালে কুমীরের মতো গাধা অবশ্যই থাকতো না l গাধা তো বোঝা বয় l মোটা দড়ির যতটা বোঝা গাধা বইতে পারে সেই দড়ির দৈর্ঘ্যের সমান গভীর পুকুরকে গাধয়া তাল বলা হয়েছে l পুকুরের পুরোনো নাম মুঝে যাওয়ার পিছনে কখনো ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনাও পাওয়া যায় l এখানে ওখানে নাম শোনা যায় ব্রাহ্মনমারা তাল l ব্রাহ্মণমারা তালের অবশ্যই অন্য কিছু নাম ছিলো, হয়তো বা কোনো ব্রহ্মণ সেখানে কোন দুর্ঘটনায় পড়েন আর তারপর থেকে সেটিকে ব্রাহ্মণমারার মতোই স্মরণ করা হয় l এই রকমি আর একটি নাম বৈরাগী তাল l এর পাড়ে বসেই বোধহয় কেউ কখনো বৈরাগী হয়ে যায় l

নদীর ধারে পাওয়া যায় নদেয়া তাল l নদেয়া তাল আগৌরের জলে নয়, বন্যার জলে ভরতো l নদীর জলের পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ কোন স্রোতের সাথে যুক্ত পুকুরকে বলা হতো ভূঁইফোড় তাল l ভূঁইফোড় পুকুর সেসব জায়গাতেই বেশী ছিলো যেখানে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর যথেষ্ট ওপরে l উত্তর বিহারে এই রকম পুকুর অনেক ছিলো, কিছু নতুনো করা হয়েছে l

যে সময়টায় পুকুরের যত্ন যথেষ্ট ভালোভাবেই করা হতো সেই সময়ও কোন না কোন কারণে এক-আধটা পুকুর সমাজের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েই পড়তো l এইরকম পুকুরকে বলা হতো হাতীতাল l ‘হাতী’ শব্দ সংস্কৃত হত শব্দ থেকে এসেছে l যার অর্থ হলো নষ্ট হয়ে যাওয়া l ‘হত তেরে কি’–র মতো সাধারণ ব্যবহারেও এই শব্দ হতো তেরে ভাগ্য কী- অর্থাত তোর ভাগ্য নষ্ট হয়ে যাক, এ রকম অর্থই বোঝাতো l আর এইভাবেই হাতীতাল নাম দেওয়া হয় পরিত্যক্ত পুকুরগুলিকে l ‘হাতিতাল’ কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন নাম l এতে বোঝাতো এমন পুকুর যার গভীরতা হাতির মতো l আরো একবার ফেরা যাক হাতীতালে l এই নাম সংস্কৃত থেকে দীর্ঘ যাত্রাপথে যদি কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তাহলে টাটকা নাম বেরিয়ে এসেছে চলিত কথা থেকেই, যেমন ফুটাতাল, ফুটেরাতাল... l

যে পুকুরে বসার জায়গা করা হতো, গাঁয়ের বরযাত্রীও সেখানে দশ-বারো বার বসানো হয়েছে তার নাম হয়ে যেতো বরাতিতাল l অবশ্য বিহারে মিথিলার দুলহাতাল একটি বিশেষ পুকুর l মিথিলা সীতাজীর বাপের বাড়ি l তাঁর স্বয়ম্বরের স্মৃতিতে এখনও সেখানে স্বয়ম্বর হয় l তফাত একটাই এখন আর পাত্র নির্বাচন কন্যা করে না, করে কন্যাপক্ষ l দুলহাতালে নির্দিষ্ট তিথিতে অনেক ছেলেপক্ষ নিজেদের ছেলে নিয়ে জড়ো হন l কন্যাপক্ষের লোকেরা তাদের মধ্য থেকে নিজেদের কন্যার জন্য যোগ্য পাত্র বেছে নেন l ছত্রিশগড়েও এ রকম কিছু পুকর রয়েছে l ওখানে সেগুলোর নাম দুলহারাতাল l

অনেক পুকুরের নামের পিছনে লম্বা কাহিনী পাওয়া যায় l পুকুরগুলি দীর্ঘ সময় মানুষের সেবা করেছে আর মানুষও দীর্ঘ সময় ধরে এই কাহিনীগুলি হুবহু মনে রেখেছে l এই পুকুরগুলির মধ্যে একটি বিচিত্র নাম হলো ‘হা হা পঞ্চকুমারীতাল’ l বিহারে মুঙ্গেরের কাছে একটি উঁচু পাহাড়ের তলায় এই পুকুরটি রয়েছে l গল্পে রাজা আছেন l রাজার পাঁচ মেয়ে l কোন কারণে পাঁচটি মেয়েটি উঁচু পাহাড় থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয় l পাঁচ রাজকন্যার শোকে মানুষ পুকুরের আসল নাম ভুলে যান এবং হা হা পঞ্চকুমারী নামই আজও স্মরণে রেখেছেন l

বিহারেরই লখিসরায় অঞ্চলের আশেপাশে কোন এক সময় তিনশো পঁয়ষট্টিটা পুকুর এক ঝটকায় তৈরী হয়েছিলো l গল্পটিতে কোন এক রাণীর কথা পাওয়া যায় l যিনি নাকি প্রতিদিন নতুন পুকুরের জলে স্নান করতে চাইতেন l এই অদ্ভুত অভ্যাসে সারা এলাকা পুকুরে ভরে যায় l এই গল্পের শ’খানেক পুকুর এখনো সেখানে রয়েছে এবং তাই সেখানের জলস্তরও যথেষ্ট ওপরে l

পোখর সাধারণত ছোট পুকুরকেই বোঝাতো তবে বরসনা (মথুরা)-তে এটি বড় পুকুরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য রয়েছে l রাধার হাতের হলুদ ধোয়া প্রসঙ্গে কথিত আছে যে তাতে নাকি পোখরার জল হলুদ হয়ে গিয়েছিলো l তাই তার নাম হয় পিলীপোখর l

রং থেকে আসা যাক স্বাদে l মহারাষ্ট্রের মাহড় এলাকায় পুকুরের জল এতো স্বাদু যে তার নাম দেওযা হয় চাওদারতাল l চাওদার অর্থাত জাইকেদার (স্বাদু)l সমাজ যখন পতনের মুখে তখন কয়েকটা ‘নীচুজাতি’র জন্য এই পুকুর ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয় l এই চাওদার তাল থেকেই ১৯৭২ সালে ভীমরাও আম্বেদকর অচ্ছুতদের উদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন l

বিচিত্র পুকুরের তালিকায় আবু পর্বত (রাজস্থান)-এর নখী সরোবরও বাদ যায় না l এই সরোবরটি সম্পর্কে বলা হয় দেবতা বা ঋষিরা নখ দিয়ে খুঁড়েছিলেন এই পুকুর কিন্তু যে সমাজে সাধারণ মানুষও পুকুর তৈরীতে পিছিয়ে থাকে না সেথানে দেবতাদের যোগদান শুধুমাত্র একটা পুকুরে কিভাবে সীমাবদ্ধ থাকবে l

গাড়োয়ালে সহস্রতাল নামক এলাকায় সত্যি সত্যি সহস্র পুকুর রয়েছে l হিমালয়ের এই এলাকাটি দশ থেকে তেরো হাজার ফুট ওপরে l এখানে এখন প্রকৃতির একরূপ (বনস্পতি) বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ও অন্যরূপ (বরফ) রাজত্ব প্রতিষ্ঠার l আশেপাশে দূর দূর পর্যন্ত কোন বসতি নেই l নিকটতম গ্রাম পাঁচ হাজার ফুট নীচে, সেখানকার লোকেরা বলে সহস্রতাল আমাদের নয় দেবতাদের তৈরী l

বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়া পুকুরগুলির মধ্য সচিত্র বর্ণনা করার মতো হলো জয়পুরের পাশে তৈরী গোলতাল l এর আকৃতি গোলাকার তাই এর নাম গোলতাল,- এরকম নয় l একটি তোপের গোলা থেকে এই তাল তৈরী হয়ছিলো বলে কথিত আছে l তখনো জয়পুর শহর গড়ে ওঠেনি রাজধানী ছিল আমের l জয়বাণ নামে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক কামান তৈরী করেন জয়গড়ের রাজা l কামানটি জয়গড় কেল্লার ভেতরেই তোপ কারখানায় ঢালাই হয়েছিলো l এটির গোলা গিয়ে পড়তো কুড়ি মাইল দূরে l কামানটির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য কেল্লারই কোন একটি মিনারে চড়িয়ে এটিকে দাগা হয় l গোলা গিয়ে পড়ে কুড়ি মাইল দূরে চাকসু নামক এক স্থানে l বিষ্ফোরণ এতো ভারী ছিলো যে লম্বা-চওড়া-গভীর বিশাল গর্ত হয়ে যায় l পারে বর্ষার জল ভরে যায় এবং এরপর আর কখনো শুকায় নি l এইভাবে জয়বাণ কামান তৈরী করলো গোলতাল l কামনটি আর কখনো চালান হয় নি l পরীক্ষার পরই শান্তি স্থাপিত হয় l শোনা যায় এরপর আর কেউ সেদিকে হামলা করতে সাহস করেনি l গোলতাল এখনো চাকসু শহরকে জল দিয়ে চলেছে l পারমাণবিক শক্তির শক্তিমান পরীক্ষা এরপরও অনেক জায়গায় অনেকবার হয়েছে l এই রাজস্থানেই তো পোখরানে হলো l কিন্তু কোন গোলতাল তৈরী হয় নি l যদি হতোও, তাহলে হয়তো না হওয়ার থেকেও বেশী ক্ষতি হতো তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে l

কখনো কখনো কোন একটি পুকুর অন্য গুলির তুলনায় মানুষের মনে বেশী প্রভাব ফেলে l তখন তা হয়ে যায় ঝুমরতাল l ঝুমর (ঝুমকা) মাথায় পরার এক প্রকার গহনা l ঝুমরতাল বস্তুত সেই জায়গার মাথা উঁচু করে দিতো l তাই ভালোবেসে যেমন বেটাকে কখন কখনো বিটিয়া বলা হয়, সেইরকম ঝুমুরিতলৈয়া l সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে এক ঝুমুরিতলৈয়ার নাম বিবিধভারতীর কল্যাণে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিলো l

ভারতীয় ভাষার বিভিন্নতা, তাল তলৈয়ার বিভিন্নতা সমাজে মাথা উঁচু করতো l

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishraa in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bunddelkhand, Tanks in Rajasthan

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading