ভূতাত্ত্বিক গঠন ও তার প্রভাব
যে কোন কাঠামোকে বড় ধরনের ভূকম্পন সহ্য করতে হলে এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে গোটা কাঠামোটা একক - ইউনিট হিসাবে সাড়া দেয় ( কেননা যে কোন এক অংশ অপর অংশের চেয়ে বেশী বা কম নড়লে যে “সিয়ারিং” জনিত চাপ সৃষ্টি হয় তাতেই কাঠামোটা ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা ) এবং কম্পনের তালে নড়েচড়ে বসার একটু সুযোগ যেন ভিত গঠনের মধ্যে থাকে।
1906 সালের ভূমিকম্পের পর ভূতত্ত্ববিদ ও ভূকম্পন বিশারদরা দশকের পর দশক উন্নত থেকে উন্নততর যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই উপসাগরীয় অঞ্চলে ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন। তার মধ্যে যে কয়েকটা মূল্যবান তথ্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তা হলো –
1) কালিফোর্নিয়ার উত্তর দক্ষিণে ( তার মধ্যে সানফ্রানসিসকো ও লস এঞ্জেলস শহর দুটো অন্তর্ভুক্ত ) 8000 মাইল ব্যপী এবং 11 মাইল গভীর যে সানএন্ড্রিয়াস ফণ্ট আছে তাকে ঘিরেই সব বড় বড় ভূকম্পন হবে। এই ফল্ট আসলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট ও উত্তর আমেরিকার প্লেটের মিলনস্থলের একাংশ যা কিনা প্রতিবছর কয়েক ইঞ্চি করে পরস্পরের গা ঘেঁষে নড়াচড়া করে। এই রকম নড়াচড়ার ফলে যে চাপ বা টেনসন সৃষ্টি হয় তা বছরের পর বছর জমে জমে একটা মাত্রার বাইরে গেলে ভূমিকম্পের আকারে আত্মপ্রকাশ করে তবে প্রশমিত হয়। একই অঞ্চলে উত্তর আমেরিকার প্লেটে আরও দুটো ছোট ফল্ট আছে। সবমিলে গোটা অঞ্চলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা প্রবল করে তুলেছে। 1906 ও 1989 সালের দুটো বড় ভূকম্পের মাঝে কয়েক শত ছোট ছোট কম্পন এই সান এন্ড্রিয়াস ফল্টের ধারে কাছেই হয়ে গেছে।
2) 1906 সালের পর হিসাব করা হয়েছিল যে 2000 সালের মধ্যে অন্ততঃ একটা বড় ভূমিকম্প এই উপসাগরীয় অঞ্চলে হবেই। 1939 সালের 7.1 রিক্টার কম্পনের পর আবার হিসেব করে জানা গেল যে এটাই সেই প্রত্যাশিত বড় ভূকম্পন নয়। আগামী 30 বছরের মধ্যে আরও বড় একটা ভূকম্পন ( 8.0 রিক্টার মাপের ) হওয়ার 60 - 70 শতাংশ সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কাজেই 1989 সালের ভূকম্পনের অভিজ্ঞতা আগামী ভয়ানক দিনটির জন্য আরো ভালো করে প্রস্তুত হয়ে থাকার সুযোগ এনে দিল। এখন চারিদিকে সাজ সাজ রব। যে কয়েকশত যন্ত্রপাতি 1989 সালের ভূকম্পনের নাড়ি-নক্ষত্র ধরে রেখেছে, বিজ্ঞানীরা তার বিশ্লেষণ করে প্রাণপণ বোঝার চেষ্টা করছে যে মূল কম্পনের কিছু আগেই তার পূর্বাভাষ পাওয়া যায় কি না। দীর্ঘ -সময় আগের পূর্বাভাষ ( Long term prediction ) যদিও মোটামুটি সঠিক ভাবে ধরা যাচ্ছে অল্প সময় আগের পূর্বাভাষ ( short term prediction ) ধরা নিয়ে এখন সবার মাথাব্যথা হচ্ছে। সম্প্রতি ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটির একজন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছেন যে 1989 সালের ভূমিকল্পের ঠিক আগেই একটা “রেডিও ওয়েভ” ভীষণভাবে সাড়া দিয়ে উঠেছিলো। সেটা কাকতালীয় না ভূকম্পনের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন। যদি এই সম্পর্ক সত্যি প্রমানিত হয়, তাহলে পূর্বাভাগের ক্ষেত্র বৈপ্লবিক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
3) সারা অঞ্চলের বিস্তৃত ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র তৈরী করে জানা গেছে কোন কোন অঞ্চলের ভূস্তর কতটা দুর্বল এবং কোন কোন অঞ্চলের কম্পন সহ্য করার ক্ষমতা কতটা। দুর্বল অঞ্চলগুলির ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ও দুর্বলতার কারণও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এইসব মূল্যবান তথ্য সাহায্য করেছে ভূকম্পন সহ্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজাইন তৈরী করার যা উত্তরোত্তর রাস্তাঘাট, ইমারত, উড়ালপথ, পাতালরেল প্রভৃতিকে রক্ষা করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভূকম্পন সংক্রান্ত কারিগরী কৌশলের উদ্ভাবন ও প্রয়োগের মাধ্যমে এই চ্যালেজের মোকাবিলা করা হচ্ছে।
ব্লিডিং কোড, রিট্রোফিটিং এবং ভূকম্পন সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন ডিজাইনের কার্য্যকারিতা -
ক) পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতির বিশ্লেষণ করে যে দুটো বিষয়ে সকলে একমত হয়েছেন তা হলো –
1) যেখানে বৃহত ইমারত তৈরী হবে তার নীচের জমির কোন স্তরে যেন চাপে বা নড়াচড়ায় তরলীকরণ ( Liquefaction ) না হয়। তা হলে ভূকম্পনের প্রভাব এর নিকটবর্তী এলাকায় আরও পরিবর্ধিতরূপ অনুভূত হবে। অবস্থাটা অনেকটা ভেজা বালির মধ্যে একটি দন্ডকে পুঁতে দিয়ে উপরের অংশটা নাড়ালে যেমন হবে। যে সমস্ত জমি কোন এককালে কাদা - বালি দিয়ে ভরাট করে তৈরী হয়েছে সেখানে এই সম্ভাবনা রয়েছে। এরকম জমিতে শুধুমাত্র বাড়ীঘর নয়, মাটির নীচ দিয়ে চলে যাওয়া গ্যাসলাইনও একেবারে নিরাপদ নয়। ওকল্যান্ড শহরের দোতলা উড়ালপথ ভেঙ্গেপড়া, মেরিনা শহরে বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হওয়া এবং গ্যাসলাইন ফেটে আগুন লেগে যাওয়ার কারণ এটাই। কাজেই, ফল্টের কাছাকাছি এই ধরণের জমি থাকলে সেখানে কোন কাঠামো তৈরী করতে গেলে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং জমিকে উপযুক্তভাবে মজবুত করে নিতে হবে।
2) যে কোন কাঠামোকে বড় ধরনের ভূকম্পন সহ্য করতে হলে এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে গোটা কাঠামোটা একক - ইউনিট হিসাবে সাড়া দেয় ( কেননা যে কোন এক অংশ অপর অংশের চেয়ে বেশী বা কম নড়লে যে “সিয়ারিং” জনিত চাপ সৃষ্টি হয় তাতেই কাঠামোটা ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা ) এবং কম্পনের তালে নড়েচড়ে বসার একটু সুযোগ যেন ভিত গঠনের মধ্যে থাকে। ব্যবস্থাটা যেন বাড়ীর ভিতর নীচে ঢাকা জুড়ে দেবার মতো। একটা কাঠামোকে ভূকম্পন সহ্য করার জন্য মজবুত করতে গেলে শুধুমাত্র উচ্চমানের ইস্পাত ও প্রি -কাষ্ট কংক্রীট ব্যবহার করলেই চলবে না। ছাদ, দেওয়ার ফ্রোর ও ভিত অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে দেওয়ার কারিগরী কৌশলও রপ্ত করতে হবে। বার্কেলেতে আমাদের 6 তলার গবেষণাগার এইরকম পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়েছিল বলে অনেকক্ষণ ঝাঁকুনি খেয়েও ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। সানফ্রানসিসকোর ডাউন টাউনে ব্যাংক অব আমেরিকার 52 তলার বাড়ীটি একই কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি।
খ) কালিফোর্নিয়ায় বিল্ডিং রোড চালু করে যে সমস্ত নিরাপদ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তার প্রয়োগের চেষ্টা সহকারে করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি -স্বাধীনতা ও অধিকার - সচেতন সমাজে অপার জনসাধারণ বা ক্ষমতাধর ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের উপর কোন বিধিনিষেধ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সহজ নয়, তারজন্য দীর্ঘদিনের বোঝাপড়ার প্রয়োজন। কাজেই বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ এখনও সুসম্পন্ন নয়।
গ) নিরাপদ করার আর একটি উপায় হলো রিট্রোফিটিং ( Retrofitting)। যে সমস্ত পুরনো কাঠামো বিল্ডিং - কোড মাফিক তৈরী করা সম্ভব হয়নি, তাদের মজবুত করার জন্য বাইরে থেকে আলাদা করে বীম, পিলার, নাট - বল্টু লাগিয়ে জুড়ে দেওয়া সম্ভব যাতে গোটা কাঠামোর প্রতিটি অংশ পরস্পরের সাথে শক্তভাবে এঁটে থাকে। এটাও একটা আলাদা কারিগরী কৌশল। অর্থব্যয় করে যোখানে যেখানে রিট্রোফিটিং করা হয়েছিলো, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকায় সেই সব কাঠামো ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। এই ধরনের ফলাফল বিশেষজ্ঞদের মনে পরিকল্পনা ও ডিজাইনের ব্যাপারে অনেক আস্থা জাগিয়েছে।
ঘ) 1989 সালের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বার্কেলেতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী ও কারিগরেরা বিশাল বিশাল ক্রেন ও জ্যাকের সাহায্যে নাড়িয়ে নাড়িয়ে কৃত্রিম উপায়ে ভূমিকম্পের মতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেখছেন ব্রীজ, উড়ালপথ ও ইমারতের কাঠামোয় দুর্বলতাগুলো কোথায় কোথায় রয়েছে এবং কেন। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্য একটাই। আগামী 80 মাপের বড় ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা। বিশেষজ্ঞ মহলে প্রবল ভরসা রয়েছে যে বর্তমান অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে ব্যবস্থা নিলে আসন্ন বড় ভূমিকম্পকে সম্মান জানালেও তার সামনে অসহায়ভাবে মার খেতে হবে না।
বলা বাহুল্য এত সব গবেষণা, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার পিছনে প্রচুর অর্থ বার করতে হয়েছে এবং হচ্ছে যা একমাত্র কালিফোর্নিয়ার পক্ষে সম্ভব। তবু ভেবে আশার আলো পাওয়া যায় যে মানুষ তার নিজের প্রচেষ্টায় এতবড় একটি প্রাকৃতিক বিপর্যায়ের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার পথ তৈরী করে নিতে পারছে। এখানকার অভিজ্ঞাতা যে ভিত তৈরী করে রাখছে হয়ত ভবিষ্যত পৃথিবীর আরও দেশ এই পথে সামিল হতে পারবে।
( বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক দ্বি-মাসিক পত্রিকা, জুলাই - আগষ্ট ১৯৯০, B – 2 বৈশাখী, 153 / 1 যশোহর রোড, কলিকাতা – 700 114)