ধাপার মাঠ
মেছো ভেড়ি থেকে বসত বাড়ি হচ্ছে তিন ভাবে। কোনো কোনো জায়গায় ভেড়ি মালিকরা সোজা প্রোমোটারদের কাছে জলাভূমি বিক্রী করছে। জমির দলিল-এ জলাভূমি প্রথমে হচ্ছে ধানজমি, তারপর বস্তু জমি। ওই অঞ্চলের ‘পার্টি’ হোলো পাহারাদার। দ্বিতীয় কায়দা একটু অন্যরকম। ‘পার্টির’ নেতৃত্বে ভেড়ি শ্রমিকদের দিয়ে ফ্ল্যাগ পুঁতে ভেড়ি দখল হচ্ছে - জল বার করে দিয়ে মাছ লুঠ হচ্ছে। তারপর ‘শুকনো ভেড়ি’ শ্রমিকদের ধান-জমি বলে বিলি করা হচ্ছে। শেষে সেই ধান-জমির জন্য শ্রমিক কৃষকদের কিছু পাইয়ে, জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রোমোটারদের হাতে। কলকাতা শহরের ছেলেবেলায়, নোংরা আবর্জনা ফেলা হোতো সোজা হুগলী নদীতে। তারপর বেশ কয়েক বছর ভরাট করা হোতো মজে যাওয়া খাল, নীচু জমি ওই নোংরা দিয়েই। এ ভাবেই সার্কুলার খাল বুজিয়ে সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছে। তারপর বছর ঘুরছে - কলকাতা বড় হয়েছে। বেড়েছে আবর্জনার স্তূপ। খোঁজ পড়েছে পাকাপোক্তা নোংরা ফেলার জায়গার।
1865 সালে পূর্ব কলকাতা জলা - ভূমির ধারে ধাপা অঞ্চলের এক (1) বর্গ মাইল অঞ্চলকে, বেছে নেওয়া হয়েছে এ জন্য। বিদ্যাধরীর নোনা জল থেকে বাঁচতে, চারধারে উঠেছে বাঁধ। চালু হয়েছে ধাপা রেল – সার্কুলার রোডের রাজাবাজার থেকে ধাপার মাঠ। ধাপার রেল লাইনের দুই পাশে আবর্জনা ঢালা হয়েছে। জমি হতে থেকেছে উঁচু। তখন রেল লাইন তুলে নিয়ে ওই উঁচু জমির পরে, আবার পাতা হয়েছে লাইন। এভাবে ময়লা আবর্জনার উঁচু জমির মাঝে মাঝে থেকে গেছে নীচু খালের মতন অংশ-আগেকার রেল লাইনের জায়গা।
সুন্দর চাষের ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে। ময়লা ফেলার হলদে লরীগুলো স্তূপ করে ময়লা ফেলে চলে যায়। সেগুলোকে তারপর সমান করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। লাগানো হয় শাক সবজি। জলের অভাব নেই – কিছু দূর অন্তর একটা করে কলকাতার নোংরা জলের খাল বয়ে যাচ্ছে খেতের মধ্যে দিয়েই। আর ওই জমিই সোনা ফলাচ্ছে।
আর কলকাতা শহরের অর্থাত ময়লা আবর্জনার ওপরই চাষ হচ্ছে, শহরের নোংরা জল দিয়েই। ময়লাও মাটিতে পরিণত হচ্ছে, কলকাতা টাটকা সবজি পাচ্ছে। একই জিনিস বারবার ব্যবহার হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কম। ধরা যাক ফুলকপির কথা। রান্নার সময় ডাঁটাগুলো ফেলে দিচ্ছি। সেগুলো জঞ্জালের সঙ্গে মিশে লরিতে করে ধাপায় গিয়ে পড়ছে। সেগুলোই পচে, সার হয়ে, নতুন তাজা ফুলকপি তৈরী করছে। ফলে রাসায়নিক সারের প্রয়োজনই হচ্ছে না। যে সার তৈরীতে লাগে কোটি কোটি টাকার কারখানা। পৃথিবীর বুক চিরে ওপড়াতে হয় লক্ষ লক্ষ টন খনিজ। বছর বছর সার লাগাতে অপচয় হয় অর্থ, প্রকৃতির রসদ। বাড়তি বোঝা হিসেবে জোটে জীবন নাশকারী পরিবেশ দূষণ।
এই প্রসঙ্গে একজন ভেড়ি শ্রমিকের মন্তব্য -
‘‘এখানকার মানুষজন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে শিখেছে। আর এই ভেড়ি অঞ্চলে আমরা নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে চলার হিসেবটাও শিখছি। ঝিলমিলের ধারে নলবন - তারপরের যে পাঁচটা ভেড়ি গায়ে গা লাগিয়ে আছে। সুকান্তনগর, আট নং, সর্দার, চকের ভেড়ি আর নারকেলতলা - তার মধ্যে সর্দার ভেড়ি বাদে বাকি চারটেতেই এখন চলছে ভেড়ি শ্রমিক সমবায়। কেউই এখনও সরকারের স্বীকৃতি পায়নি ঠিকই - কিন্তু বেশ ভালই চলছে। 25 থেকে 35 টাকা রোজ পেয়েও সমবায়তে কিছু টাকা জমেছে মাত্র কয়েক মাসেই। এই ভেড়ির মালিকরা চাষ বন্ধ করে ফেলে রেখেছিলো - কোথাও লাভ নেই দেখিয়ে, কোথাও শরিকী মামলা দেখিয়ে। আসলে ওসব বাজে কথা, এসব প্রোমোটারদের কাছে বিক্রী করার তাল।’’
মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগে এক বন্ধু অর্থনীতিবিদ -এর কথা। তিনি বলছিলেন -এ অঞ্চল সম্পর্কে যতটুকু জানি তাতে এই জলাভূমিকে সোনার খনি বলা চলে। যদি উন্নয়নের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেওয়া হয়, এ অঞ্চলে যদি সমবায় ভিত্তিতে মাছ, হাঁস, সবজি চাষ চালানো যায়, তাহলে উঠে আসবে প্রচুর লাভ।
রাজনীতি কোন পথে …
‘‘যা হয়েছে, হয়েছে। এরপর আর এক ইঞ্চি জলাভূমিও নষ্ট হতে দেব না। আমরা খুব ভালো করেই বুঝি পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমি কত দামী - এখানকার মানুষের স্বার্থে - কলকাতার মানুষের স্বার্থে।’’ এ বক্তব্য একজনের নয় - বেশ কয়েকজন বামফ্রণ্ট সরকারের মন্ত্রীর। 1989 সালে হাজার দশেক জলাভূমির মানুষের মিটিং -এ দাঁড়িয়ে তাঁরা সজোরে এ কথা বলে গেছেন। মিটিং -এর বিষয় ছিল “পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সংরক্ষণ।”
অথচ সেই সরকারই আজ এই জলাভূমি বুজিয়ে বসত গড়ার আর ট্রেড সেণ্টার গড়ার ঢালাও অনুমতি দিয়ে ছিল। স্থানীয় মানুষের প্রশ্ন তাই-কিভাবে হয়েছে এ সব।
ব্যবসায়ী সাধন দত্ত -র সাধের প্রকল্প ‘ওয়ার্লড ট্রেড সেণ্টার।’ আশা ছিল গঙ্গার ধারে গড়বেন। জমি পাননি। তাই নজর পড়েছে জলাতে। সাধনবাবু পরিবেশ সচেতন। তাই সবুজ আর জলঘেরা মনোরম পরিবেশে গড়তে চাইছেন ট্রেডিং কমপ্লেক্স, পাঁচতারা হোটেল। বিদ্যুত কেন্দ্র, প্রমোদ উদ্যান - মানে মিনি আধুনিক শহর।
শোনা যাচ্ছে সরকার ঝিলমিল লাগোয়া এক হাজার পাঁত শত (1500) একর অর্থাত চার হাজার পাঁত শত (4500) বিঘে জলা বুজিয়ে তৈরী করবেন তিন লক্ষ মানুষের থাকার জন্য বাড়ি। তারই একটু পুব দিকে 137 একর জলাভূমির উপর তৈরী হবে ওয়ার্লড ট্রেড সেণ্টার। তাছাড়া জমির দালালরা তো আছেই। শয়ে শয়ে বিঘা জমি ইতি মধ্যেই বিক্রি করেছে মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের কাছে। যে জমির মাইল খানেকের মধ্যে পায়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই এখনও। স্থানীয় মানুষ, মন্ত্রী আমলার দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে মরছেন। সবাই বলছেন -‘দেখেছি’। তাই এদের প্রশ্ন -‘আর কতদিন ধরে এরা দেখবেন? – এ কোন ধরণের রাজনীতি?’
হাত বদল আর রূপ বদল
মেছো ভেড়ি থেকে বসত বাড়ি হচ্ছে তিন ভাবে। কোনো কোনো জায়গায় ভেড়ি মালিকরা সোজা প্রোমোটারদের কাছে জলাভূমি বিক্রী করছে। জমির দলিল-এ জলাভূমি প্রথমে হচ্ছে ধানজমি, তারপর বস্তু জমি। ওই অঞ্চলের ‘পার্টি’ হোলো পাহারাদার। দ্বিতীয় কায়দা একটু অন্যরকম। ‘পার্টির’ নেতৃত্বে ভেড়ি শ্রমিকদের দিয়ে ফ্ল্যাগ পুঁতে ভেড়ি দখল হচ্ছে - জল বার করে দিয়ে মাছ লুঠ হচ্ছে। তারপর ‘শুকনো ভেড়ি’ শ্রমিকদের ধান-জমি বলে বিলি করা হচ্ছে। শেষে সেই ধান-জমির জন্য শ্রমিক কৃষকদের কিছু পাইয়ে, জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রোমোটারদের হাতে।
প্রমোটার না আজকের মগ। - কথাটা খুব চালু জলা এলাকায়। ইতিহাসে দেখেছি আগে পুর্ব দিকে থেকে নৌকো করে জল বেয়ে আসত মগেরা। দমদমার উঁচু ঢিবিতে নৌকো বাঁধত। তারপর শুরু হত লুটপাট আজকের মগেরা আসছে পশ্চিম থেকে পূবে। – জলাটাকেই লুঠ করতে।
আর তৃতীয় কায়দায় ‘পার্টিও’ নেই প্রোমোটারও নেই নাটকের স্টেজে। চালু ভেড়িগুলো রাজ্য সরকারের মত্স্য দপ্তর ‘উন্নয়ন ও জনস্বার্থে’ হাতে তুলে নিচ্ছে। তারপর কয়েক বছর চালিয়ে সরকারী নগর উন্নয়ন দপ্তরকে দিয়ে দিচ্ছে। সরকারী আবাসন গড়ার জন্য।
জলাভূমির মানুষেরা কি বলছেন
এঁদের সাথে ঘোরাঘুরি করে কথাবার্তা বলে বুঝেছি - উচ্ছেদের আতঙ্ক নিয়ে আর দিন কাটাতে চাইছেন না এঁরা। সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের কথা ভাবছেন। পথে বিস্তর বাধা জানেন। তবুও সংকল্প - জলাভূমি এঁরা বাঁচাবেনই। নিজেদের স্বার্থেই বাঁচাবেন। তাঁদের বিশ্বাস সরকার যদি কিছু নাও করেন তো নিজেদের শ্রমের ফসল দিয়েই স্থানীয় এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁরা নিজেরাই নিতে পারেন। শুধু তাঁদের অনুরোধ বারে বারে তাঁদের ওপর এমন হামলাবাজী বন্ধ হোক। শহর কলকাতার অন্যান্য চাষের এলাকায় একর প্রতি একজন শ্রমিকের সারা বছরের কর্ম সংস্থান তথা অন্ন সংস্থান হয় না। এখানে তা সম্ভব হয়েছে। ময়লা জলে মাছ চাষের পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।
মানুষের উদ্দেশ্যে তাঁদের বক্তব্য কলকাতার পূর্ব প্রান্তে তাঁদের অবস্থান শহর কলকাতার পক্ষেও কম উপকারী নয়। ফলে তাঁদেরও সমর্থন তাঁরা পাবেন আশা রাখেন।