অনুপম মিশ্র (১৯৪৬-২০১৬)
অনুপম মিশ্র (১৯৪৬-২০১৬)

একটি সৌন্দর্যময় পথচলা

Published on
2 min read

অনুপম মিশ্র (১৯৪৬-২০১৬)

তারপর আড়াই দশক ধরে দেখতে থাকব এক আশ্চর্য মানুষকে, যিনি আমাদের শেখালেন দেশ কাকে বলে, কাকে বলে দেশের পরিবেশ। বললেন, এই যে লক্ষ লক্ষ পুকুর ছিল এদেশে, কোথা থেকে এল সেগুলো? কি করে টিকে রইল পাঁচ সাতশ এমনকী হাজার বছর? আমরা যারা কেবল ভেবেছি ‘সমাজকে সচেতন করা’ ‘সমাজকে শিক্ষিত করে তোলা’র কথা, তাদেরকে লেখার পর লেখায় শেখালেন সমাজকে দেখার নিয়ম। অজস্র উদাহরণ দিয়ে শিখিয়েছেন কিভাবে এ দেশের প্রাচীন মানুষরা নিজেদের পরিপার্শ্বের উপযোগী কৃষি করেছেন, সযত্ন ব্যবস্থা করেছেন জলের। ‘সমাজ নিজেই করেছে সেসব। কোন প্ল্যানিং কমিশান, বাজেট, প্রপোজাল কিংবা টেন্ডার ডাকার দরকার হয়নি, বিশেষ বিশেষ দিন ঠিক করে, উৎসব করে সমাজ নিজের পুকুর সাফ করেছে, বেড়া বেঁধেছে ক্ষেতের, যেখানে বছরে মাত্র তিনশ মিলিলিটার বৃষ্টি হয়, সেখানেও জলের অভাব ঘটেনি। নদীর মুখ আটকে দূরের শহরে জল আনবার দরকার হয় নি, একবছর অনাবৃষ্টি হলে পরের বছর ট্রেনে করে জল পাঠাতে হয় নি কারণ সমাজ নিজে নিজের প্রয়োজন পূরণের নিয়ম মানত।’ আর, কোন অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নয়, এই জীবন যাপনের অসংখ্য উদাহরণ অনুপম নিজে খুঁজে বার করেছিলেন বছরের পর বছর নিরলস পরিশ্রম করে।

রাজস্থানের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হিমালয়ের গাড়োয়াল, উত্তর বিহার থেকে কর্ণাটক- নিজে গিয়েছেন, দেখেছেন, কথা বলেছেন মানুষজনের সঙ্গে। তাঁর সেই দেখার ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে গভীর কোন অর্থ। খুব আগ্রহী ছিলেন আমাদের এই বাংলা সম্পর্কেও। বিশেষ করে বিরভূম বাঁকুড়া পুরুলিয়া আর সুন্দরবন নিয়ে ছিলেন উৎসুক। বাংলার জল সংস্কৃতি, বাংলার জলসাধনের বৈচিত্র নিয়ে আরো বেশি করে জানা মনস্থ করেছিলেন। ঠিক ছিল একবার সুন্দরবন যাওয়া। তাঁর বাবা, হিন্দির খ্যাতনামা কবি শ্রী ভবানীপ্রসাদ মিশ্র শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। হয়তো তাঁর দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। সহজ সৌন্দর্যবোধের সেই উত্তরাধিকার অনুপম মিশ্রের স্বভাবের অংশ হয়ে তাঁকে এক লক্ষণীয় বিশিষ্টতা দিয়েছিল। সেই সৌন্দর্যবোধ থেকে অনুপম সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলেন ভবানীপ্রসাদ মিশ্রের সময়কার পত্রিকা ‘গান্ধীপথ’। চটি ছোট্ট একটি বিশেষ ভাবনার পত্রিকা যে কতো সুন্দর হতে পারে বিষয় আর সজ্জা, উভয় দিক থেকে, যেকোন সম্পাদকের কাছে তা এক শিক্ষার বিষয়। কেবল দৃশ্য নয়, সাহিত্যগুণের ক্ষেত্রে, কেবল সাহিত্যগুণ নয়, দেখনদারীর ক্ষেত্রেও। এই ছোট পত্রিকাটি যেন সম্পাদকের স্বপ্ন।অসহনীয় রোগ যন্ত্রণার মধ্যেও তিলতিল করে লেখা জোগাড় করেছেন, অনুবাদ আর সম্পাদনা করেছেন।

অনুপমের বইগুলি, হমারা পর্যাবরণ ছাড়াও ‘রাজস্থান কী রজতবুঁদে’, ‘আজ ভী খরে হ্যয় তালাব’ ‘সাফ মাথে কা সমাজ’ অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মনি, ভেনিস, মরক্কোসহ নানা জায়গার ভাষায়। এবং সে সব এলাকায় কিছু কিছু করে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তাঁর নির্দেশিত পথে জলের কাজ করার।

কিন্তু জলের কাজই প্রধান নয়, তাঁর কাছে প্রধান ছিল অনাড়ম্বর, সত্যময় এবং যুক্তিপূর্ণ জীবনযাপনের আদর্শ। কোন জিনিস অপচয় না করাই যে প্রকৃত পরিবেশচর্চা, এ বিষয়ে তিনি খুব নিশ্চিত এবং যারা এমনকি অল্প সময়ের জন্যও তাঁর কাছাকাছি হয়েছে, এই কথা তাদের মনেও কিছু না কিছু নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে অনুপম মিশ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এবং পরে একজন মানুষের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হওয়া প্রায় স্বতঃসিদ্ধ কারণ তাঁর নিজের কথা ও কাজের আন্তরিকতা এবং সততা যে কোন মানুষকেই প্রভাবিত করত।

সারাদেশে কতো যে নিঃশব্দে কাজ করতে থাকা জনকে তিনি খুঁজে বার করেছেন, খুঁজে বার করেছেন হারিয়ে ফেলা কতো সুন্দর সামাজিক প্রথা আর তার অর্থ, তার আর ইয়ত্তা নেই। এই ছত্তর সিং, সচ্চিদানন্দ ভারতী, লক্ষ্মণ সিং, ফারহাদ, দিলীপ চিঞ্চলকর, গোপীনাথ জী, নিরুপমা অধিকারীদের মত অগণিত জন নিশ্চয়ই আরো বেশি চেষ্টা করবেন সেই আগে খেয়াল-না-করা ভাবনা অনুযায়ী সত্য ও নম্রতার পথে চলতে কারণ গত সোমবার, ঊনিশে ডিসেম্বর, মাত্র ৬৮বছর বয়সে, অনুপম মিশ্রকে হরণ করে নিল ক্যানসার যখন তিনি আরও অনেক কাজের কথা ভাবছিলেন।

संबंधित कहानियां

No stories found.
India Water Portal - Hindi
hindi.indiawaterportal.org