অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের ক্রিয়াকর্মে বিপর্যয়


ক্রনিক আর্সেনিক বিষণে ডায়াবেটিস ( টাইপ 2 ), হৃতপিন্ড সম্পর্কিত সংবহন-তান্ত্রিক গোলযোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অসুগঠিত মস্তিষ্ক, স্মৃতি হ্রাস, বিঘ্নিত প্রজনন ইত্যাদি ঘটে থাকে। এসবের পিছনে দেহাভ্যন্তরস্থ রাসায়নিক বার্তাবাহক হরমোনের ক্রিয়াকর্মে আর্সেনিক অজ্ঞাতপূর্ব, এখনো অস্পষ্ট এক অভিনব ক্রিয়াবিধিতে প্রয়োজনীয় সংকেত বা বার্তা পৌঁছানো ব্যর্থ করার ফলে উপযুক্ত জিন সক্রিয় হতে পারে না, যার ফলে নানারকম দৈহিক বিকৃতি ও অসুখ - বিসুখ সৃষ্টি হয়।

জীবদেহে, বিশেষ করে মানুষসহ উচ্চবর্গের জীবসমূহে কোটি কোটি নানা ধরনের কোষেদের স্বনির্দিষ্ট ক্রিয়াকর্ম সঠিক ভাবে সময়মতো, প্রয়োজনমতো সম্পাদন করে থাকে বলেই জীব প্রজনন, বৃদ্ধি, বিকাশ, কর্ম ও জীবযাত্রা নির্বাহ করতে পারে। তার জন্যে জীবদেহে সৃষ্টি হয়েছে সংকেত বা বার্তা আদান - প্রদানের চমত্কার জটিল বিরাট এক ব্যবস্থা। তার ভিত্তি হল অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহ নিঃসৃত প্রাণ রাসায়নিক বার্তা পরিবহন ব্যবস্থা ও স্নায়ুতন্ত্রীয় সংযোগ ব্যবস্থা। স্নায়ুতন্ত্রীয় সংকেত আদান - প্রাদান তড়িত তাড়িত, দ্রুতপ্রসারী, স্বল্পস্থায়ী, স্বল্পপ্রসারী, স্থানিক ও কালমাত্রায় সীমাবদ্ধ। আর রাসায়নিক যোগযোগ সারা দেহব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী ও ধীরপ্রসারী। জীবদেহের চমত্কার জটিল এই ব্যবস্থার ভিত্তি হল দেহে উত্পন্ন নানারকম রাসায়নিক অণুসমূহ, যাদের আনবিক গঠনের মধ্যেই বার্তা নিহিত থাকে। রাসায়নিক সংযোগ মাধ্যম এই জৈব অণুসমূহ নানারকম অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহ থেকে উত্পন্ন হয়ে রক্তবাহিত হয়ে দেহের সর্বত্র কোষে কোষে বার্তা বহন করে নিয়ে যায় এবং কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত জিন সেই অনুযায়ী প্রোটিন উত্পাদন বা অন্যান্য ব্যবস্থাদি নেয়।

অন্তগ্রন্থি নিঃসৃত প্রাণ–রাসায়নিক সমূহের, বিশেষ করে গ্লুকোকর্টিকয়েড স্টেরয়েড হরমোনের ক্রিয়াকর্মে বিঘ্ন ঘটার ফলে যে সব রোগ-ব্যধি ও শারীরিক অসুস্থতা ঘটে তা হল প্রজননে গোলযোগ, ইমিউনিটি তথা অনাক্রম্যতার ক্ষতি, কয়েক ধরনের ক্যানসার, পুরুষাঙ্গের জন্মগত বিকৃতি বা অস্বাভাবিকত্ব, স্নায়ুতন্ত্রীয় গোলযোগ, মনোসংযোগে অসুবিধা, হ্রস্বিত বুদ্ধ্যাঙ্ক, স্মৃতি হ্রাস, পুরুষাঙ্গের শুক্রাণু হ্রাস, অল্পবয়সি মেয়েদের বয়সের আগেই যৌবনোদ্ভেদ।

ক্রনিক আর্সেনিক বিষণে ডায়াবেটিস ( টাইপ 2 ), হৃতপিন্ড সম্পর্কিত সংবহন-তান্ত্রিক গোলযোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অসুগঠিত মস্তিষ্ক, স্মৃতি হ্রাস, বিঘ্নিত প্রজনন ইত্যাদি ঘটে থাকে। এসবের পিছনে দেহাভ্যন্তরস্থ রাসায়নিক বার্তাবাহক হরমোনের ক্রিয়াকর্মে আর্সেনিক অজ্ঞাতপূর্ব, এখনো অস্পষ্ট এক অভিনব ক্রিয়াবিধিতে প্রয়োজনীয় সংকেত বা বার্তা পৌঁছানো ব্যর্থ করার ফলে উপযুক্ত জিন সক্রিয় হতে পারে না, যার ফলে নানারকম দৈহিক বিকৃতি ও অসুখ - বিসুখ সৃষ্টি হয়। অন্তগ্রন্থি বিঘ্নক হিসাবে আর্সেনিকের সক্রিয়তা সাম্প্রতিক আবিষ্কার। ইতিপূর্বে কিছু পরিবেশ দূষকের ( যথা পেস্টিসাইড অবশেষ, ডাই অকসিন, পিসিবি প্রভৃতির ) অন্তগ্রন্থি বিঘ্নক ভূমিকা দেখা গেছে। কিন্তু ধাতুসমূহের মধ্যে আর্সেনিকই প্রথম আবিষ্কৃত অন্তগ্রন্থি বিঘ্নক। তবে তার ক্রিয়াবিধি, যতদূর জানা গেছে, প্রথমোক্তদের থেকে ভিন্নতর।

স্টেরয়েডীয় গ্লুকোকর্টিকয়েড হরমোন ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেশন, টেস্টোস্টেরন যে জাতীয়, সেই জাতীয়। এটি অ্যাড্রিনাল কর্টেকস থেকে উত্পন্ন এবং হজম, বিপাক, বৃদ্ধি, প্রজনন, লবণাদির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। গ্লুকোকর্টিকয়েড স্টেরয়েড ভ্রূণের বিকাশ, রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ, রক্ত নালীর কাজ, ত্বক ও ফুসফুসের বিকাশ, কয়েক জাতের ক্যানসার নিবারণ, ক্ষতিগ্রস্ত ডি.এন.এ. মেরামত ইত্যাদি করে থাকে। বেশিমাত্রার আর্সেনিক কোষ মৃত্যু ঘটায়, আর স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিকে কম ক্ষতি, বেশিমাত্রার আর্সেনিকে বেশি ক্ষতি। জলে দশ পিপিবি মাত্রার কম আর্সেনিকেও যথেষ্ট ক্ষতি হয়, যার অনিবার্য ফলশ্রুতি উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে সুগার বৃদ্ধি এবং হ্রাসপ্রাপ্ত বুদ্ধাঙ্ক।

হরমোনের স্বাভাবিক ক্রিয়াবিধিতে দেখা যায় হরমোন কোনও গ্রাহক অণুর সঙ্গে তালা, চাবির মতো বা সেতু বন্ধন করে যতুযৌগ গঠন করে কোষ নিউক্লিয়াসে ঢুকে ডি.এন.এ.-তে যথাযথ স্থানে সংলগ্ন হয়ে সংকেত দেয়। তারই ফলে ডি.এন.এ. তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে জীবদেহকে ঠিক রাখে। আর্সেনিক যুতযৌগ গঠনে বিঘ্ন ঘটায় না, কিন্তু হরমোন - গ্রাহক যুতযৌগে গ্রাহকের ভিন্নতর স্থানে সংলগ্ন হয়ে সংকেত পৌঁছানো আটকে দেয়, যার ফলে প্রয়োজনীয় জিন সক্রিয় হয়ে তার উপযুক্ত কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তে সুগার বাড়ে, রক্তচাপ বাড়ে ও অন্যান্য নানা অসুস্থতা দেখা দেয়।

অন্যান্য অন্তগ্রন্থি বিঘ্নককে গ্রাহক, অন্তর্জাত হরমোন বলে ভুল করে তার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে দেহজ সঠিক হরমোনের ক্রিয়া ব্যাহত করে। যেমন ডাই ইথাইল স্টিলবেস্টেরল ( DES ) একটি সিন্থেটিক স্টেরয়েড, যা গবাদি পশু ও মানুষের গর্ভপাত আটকানোর জন্য গত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ব্যবহার হত। গবাদি পশুদের ওজন বাড়ানোর জন্যেও এর ব্যবহার ছিল। এখন তা নিষিদ্ধ। নানাজাতের পরিবেশ দূষক অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের ক্রিয়াকর্মে বিঘ্ন ঘটিয়ে অদৃশ্যভাবে চুপিসাড়ে কেমন ক্ষতি করতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে নীচে ডিইএসের পরিবেশীয় প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করা হল।

- মানুষের গর্ভপাত আটকানোর ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে ঐসব মায়েদের, মেয়েদের যোনিতে ক্যানসার হয়। আর ছেলেদের প্রজনন ক্ষমতা বিঘ্নিত হয় ও বীর্যে শুক্রাণু সংখ্যা হ্রাস হয়।

- নিম্ন কলম্বিয়া নদীতে উদবিড়াল বা ভোঁদড়রা বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, কারণ পুরুষাঙ্গ ছোট হওয়ায় তারা যৌন সঙ্গমে ব্যর্থ।

- অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের ক্রিয়াকর্ম বিঘ্নিত হওয়ায় একজাতের অ্যালিগেটর কুমির প্রজননে ব্যর্থ হচ্ছে।

- পুরুষাঙ্গে স্ত্রী হরমোন বাড়ছে।

- পাখিদের ডিমের খোলা এত পাতলা হচ্ছে যে তা থেকে আর বাচ্চা হতে পারছে না, পরিবেশে ডিডিটির ফলে যা হচ্ছিল।

পরিবেশীয় আর্সেনিকের জীবদেহে অন্তগ্রন্থিসমূহের ক্রিয়াকর্মে বিঘ্ন ঘটানোর পরিবেশীয় কুফল এখনও অনুদঘটিত।

As (V) - এর বিষক্রিয়া


অজৈব আর্সেনেট (V) এবং ফসফটের আয়নিক ও ইলেকট্রনিক গঠন সদৃশ হওয়ায় ( isosteric and isoelectric) অনুঘটক এনজাইম ও নিউক্লিওটাইডসমূহের এক বা একাধিক ফসফেটের স্থানে আর্সেনেট (V) সহজেই প্রতিস্থাপিত বা প্রবিষ্ট হয়ে যে এস্টারজাতীয় রাসায়নিক উত্পন্ন করে তারা স্বাভাবিকভাবেই কম সুস্থিত জলীয় দ্রবণে সহজেই দ্রুত বিয়োজিত হয়ে যায়। গ্লাইকোলিসিসের ক্ষেত্রে গ্লিসারলে ফসফেটের জায়গায় আর্সেনেট ঢুকে পড়ায় ATP উত্পন্ন কম হয়। আবার ADP থেকে ATP হওয়ার সময়ে সাকসিনেটের উপস্থিতিতে মাইটোকন্ড্রিয়ায় ADP আর্সেনেট হলে তা সহজেই আর্দ্র - বিশ্লেষিত হয়ে যায়, যা কিন্তু ATP-র ক্ষেত্রে হয় না। জীবদেহে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আর্সেনেট এস্টারসমূহের জলীয় বিয়োজনকে আর্সেনোলিসিস বলে সুগার থেকে প্রাণ রাসায়নিক ক্রমবিয়োজন ও ফসফেট সংযুক্তির মাধ্যমে শক্তি আধার এটিপি (ATP) উত্পন্ন হওয়ায় জারণ-ফসফোরিলেশনের সংযুক্ত বিক্রিয়াগুলিতে বিচ্ছেদ ঘটায়। ফলে সুগার থেকে ATP উত্পন্ন হওয়া সম্ভব হয় না। তার ফলে খাদ্য থেকে শক্তি সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যায়, শারীরিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে মৃত্যু অনিবার্য হয়।

আর্সেনেটে (V) আবার অন্য ভাবেও বিক্রিয়া করে। জীবদেহে As (V) নানারকম এনজাইমের প্রভাব As (III), MMAv, DMAv, DMAIII-তে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যাদের মধ্যে As (III), MMAIII, DMAIII বিষাক্ততর এবং তাদের বিষক্রিয়া বিধিও ভিন্ন রকম।

As (III) - এর বিষক্রিয়া বিধি


As (III) সহজে সালফারের সঙ্গে শক্ত রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। As (III) তাই সালফহাইড্রিল (-SH) গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া করে কিলেট উত্পন্ন করে। As (III) এবং -SH গ্রপ কয়েকটি প্রোটিন ( যাতে সিস্টেইন প্রভৃতি থাকে ) ও এনজাইমদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। যেমন, লিপোঅ্যামাইড আর্সেনাইট বা অরগ্যানো আর্সেনিক্যালের সঙ্গে সহজেই সুস্থিত শক্ত রাসায়নিক বন্ধন উত্পন্ন করে। লিপোঅ্যামাইড ঘটিত এনজাইমসমূহ ( বিশেষ করে পাইরুভেট ডিহাইড্রোজিনেস ও আলফা-কিটো-গ্লুটারেট ডিহাইড্রোজিনেস ) নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ফলে শ্বসন বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়।

অরগ্যানো আর্সেনিক্যালসমূহ মানুষ থেকে জীবাণু সমূহের ওপর অধিক বিষক্রিয়া করে, কারণ মনে হয় জীবাণুদের এনজাইমসমূহ মনুষ্য এনজাইমসমূহ থেকে অধিক সহজে এই আর্সেনিক যৌগ সমূহের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। একটি মাত্র অরগ্যানিক-মূলক সমন্বিত আর্সেনিক্যাল দুটি থায়োল (-SH) গ্রপের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, আর দুটি মূলক সমন্বিত আর্সেনিক্যাল একটিমাত্র থায়োল গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া করে। আর্সেনিক বিষণ বা আর্সেনিক যুক্ত রাসায়নিক যুদ্ধান্ত্রে আক্রান্ত মানুষকে ব্রিটিশ অ্যাণ্টিলিউসাইট (BAL) দিয়ে চিকিত্সা করে দেহ থেকে আর্সেনিক সরানো যায়।

এনজাইম সমূহের এই ধরণের রাসায়নিক সক্রিয়তার পার্থক্য হেতুই শতবর্ষ আগে পল আর্লিক প্রবর্তিত (1907) সিফিলিসের জন্য স্যালভারসান বা আর্সফেনামাইন এবং ট্রিপানোসোমিয়াসিসের জন্য ট্রিপার্সামাইড আর পরবর্তীকালে আমাশয়ের জন্য কার্বারসোন সফল হতে পেরেছিল।

সম্প্রতি এটা দেখানো হয়েছে যে As(III) গ্লুকোকর্টিকয়েড রিসেপটরের সঙ্গে অন্তঃক্রিয়া করে। রক্তের Ph 7 এর বেশি এবং আর্সেনাস অ্যাসিডের pK 9.2 হওয়ার জন্য অবিয়োজিত আর্সেনাস অ্যাসিড অ্যাকুয়া - গ্লিসারল পোরিনের মাধ্যমে দেহকোষে ঢোকে।

দেহকোষে প্রবিষ্ট আর্সেনিক খাদ্যনালিতে সহজেই শোষিত হয়ে রক্তের প্রটিনের সালফহাইড্রিল গ্রপের সঙ্গে বাঁধা পড়ে যায়। কম বা মাঝারি ডোজের অজৈব আর্সেনিকের দেহে স্থিতিকাল প্রায় চার দিন। প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় MMAv ও DMAv এ রূপান্তরিত দ্রুত প্রস্রবের সঙ্গে দেহ থেকে নিষ্কান্ত হয়ে দেহকে রক্ষা করে।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder. First Published in July 2006


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading