অন্য বসুন্ধরা বৈঠক


Global Forum-এ যোগ দিতে আসা 12000 প্রতিনিধি ব্রাজিলের প্রশাসনের কাছে প্রথমেই এমন এক আপ্যায়ন পেয়েছে যাকে মনোরম বলা চলে না। কলুষিত পৃথিবীর প্রতীক হিসাবে স্থানীয় এক জঞ্জালের ডোবা থেকে তুলে আনা প্রচুর আবর্জনা দিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘‘Garbage Planet’’ বসুন্ধরা সম্মেলনের রাস্তায়। স্থানীয় পুলিশ তা অনুমোদন করে নি। 164 টি দেশের মানুষকে সেই সব আবর্জনা আবার সেই পূর্বের স্থানে রেখে আসতে হয়েছে।

তখন কোষ্ট - রিকার সমুদ্রতট থেকে আদিবাসীদের হঠিয়ে দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এক মনোরম পর্যটন আবাস। মালিক হচ্ছেন কানাডাবাসী এক কোটিপতি। নাম মরিস ষ্ট্রং। হ্যাঁ ইনিই সেই মহানুভব ব্যক্তি যিনি UNCED-এর সাধারণ সম্পাদক পদে বৃত হয়েছিলেন। সুতরাং রিও -সেণ্ট্রোর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এঁর ও এঁদের সম - পর্যায়ের মানুষদের প্রকৃতি - পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ বা তাকে কলুষমুক্ত রাখার হাজার পরিকল্পনা যে নির্ভেজাল এক ভন্ডামী তা বুঝতে আর বাকি থাকে না। যে কমল নাথ বসুন্ধরা বৈঠকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির প্রতিনিধিদের মধ্যে নিজেকে সেরা প্রতিপন্ন করার জন্য আসরে অসি আস্ফালন করে এলেন তাঁর দেশে কি ঘটছে? মধ্য প্রদেশের বস্তার জেলার পরিবেশ আন্দোলনের প্রবীণ নেতা শ্রীব্রহ্মদেব শর্মাকে গলায় জুতোর মালা পরিয়ে উলঙ্গ করে জগদ্দলপূর শহরের রাজপথে ঘোরানো হয়েছিল। খবর কি পর্য্যাবরণ ভবনে পৌঁছায় নি? হায় কমলনাথ! লেবু কচলে কি হবে, লাভ নেই। বরং চলুন এবার যাওয়া যাক পার্কে। হ্যাঁ, ফ্রেমিগো পার্কে।

মঙ্গলবার, জুন 1992 । দ্বিতীয় দিন। দক্ষিণ অতলান্তিকের শীতল বাতাস গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। হাজার হাজার বৃদ্ধ – যুবা - শিশু অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। এজেণ্ট 007 খ্যাত চিত্রতারকা রজার মূর ঐ তো দাঁড়িয়ে। ঐ যে দেখা যাচ্ছে সাদা পাল। অতলান্তিকের বাতাসে কেমন ভেসে আসছে গেইয়া। গ্রীক পূরাণ বলে গেইয়া হচ্ছেন দেবী – এই পৃথিবীর দেবী। গেইয়া যাত্রা শুরু করেছিল আজ থেকে দুই বছর আগে। নরওয়ে থেকে। মোট 17000 মাইল সামুদ্রিক জলযাত্রা করে গেইয়া, পৃথিবীর দেবী আজ পৌঁছে গেল রিওতে। সবে মিলে 30টি বন্দরে নোঙর ফেলেছে। এনেছে চিঠি। হাজার হাজার শিশুর, ছোটোর দাবী, বাঁচাতে হবে গ্রহটাকে। তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কচি কচি হাতগুলোতে লাটাই। আকাশ ছেয়ে গেল রঙীন ঘুড়িতে। গেইয়ার পিঞ্জরে শিহরণ। গেইয়ার মাথার উপরে উড়ছে হেলিকপটার। সতর্ক এবং উদ্বিগ্ন।

1200 পরিবেশ প্রেমীর উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্নাত হয়ে গেইয়া নোঙর ফেললো। তীরে আগে থেকেই নির্মিত হয়েছিল এক কৃত্রিম বৃক্ষ – জীবন বৃক্ষ তার নাম। গেইয়ার সংগ্রহ করে আনা শিশুদের লেখা চিঠি ঝুলিয়ে দেওয়টা হলো জীবন বৃক্ষে। সে চিঠি বুকের ভাষায় একটু কান পাতা যাক। বড়োরা বসছে পরিবেশ নিয়ে বিশ্ব - সম্মেলনে। বড়োদের কাছে প্রার্থনা করছে শিশুরা। মনে যেন থাকে বাঁচাতে হবে অরণ্য। বাতাসে যেন না ছড়ায় বিষ। সুন্দর পৃথিবীর বক্ষের স্পন্দনটি থামিয়ে দিও না। আমাদেরকে শুধু দেখলে হবে না – শুনতে হবে আমাদের কথা। রিওর সমুদ্রতটে অষ্ট্রেলিয়া থেকে। কেনেডী বলছে, যে সব যৌবন 25 অতিক্রম করে নি, সারা বিশ্বে তাদের সংখ্যা দুশ কোটি। আর পনেরর নিচে আছে ভাবলে অবাক লাগে এমন কিশোর - কিশোরী সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। কাজেই তোমাদেরকে শুনতে হবে আমাদের কথা।

আমরা মানব - সমাজের যৌবন। আমাদের চোখ মানব - সমাজের চোখ। আমাদের বক্ষে কান পেতে অনেক কথা শুনতে পায় মানব - সমাজ। কি ব্যাপার? ওখানে কি হচ্ছে? বেলুন। 40 ফুট লম্বা। গায়ে তার লেখা – ‘‘আশার বিন্দু’’। দু বছর ধরে ঘুরে বেড়াবে নানা দেশের আকাশে। 1972 সালে ষ্টকহোমে বসেছিল প্রথম বিশ্ব - পরিবেশ সম্মেলন। 20 বছর পরে আবার বসছে তা রিও - ডি - জেনেইরো শহরে। সরকারী এই বিশ্ব - সম্মেলনের আয়োজন করেছে জাতিসংঘের United Nations Conference on Environment & Development সংক্ষেপে UNCED। অন্য একটি নামও আছে এই সম্মেলনের – EW – 92 । যাই হোক সরকারী এই সম্মেলনের পাশাপাশি বসছে Global Forum-বেসরকারী সংগঠন দর, যাদের কর্মসূচী পরিবেশ - ভিত্তিক বা মানব কল্যানভিত্তিক তাদেরই জন্য এই আয়োজন। সরকারী অনুষ্ঠানের স্থান রিও সেণ্ট্রো। এঁদের অনুষ্ঠানের স্থান ফ্লেমিংগো পার্ক। দক্ষিণ আটলাণ্টিকের সমুদ্রতট ব্রাজিলের পূর্ব উপকূলে অবস্থান এই জায়গাটির। সেই Global Forum- এর প্রাক, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চিহ্নিত হয়ে গেল পৃথিবীর দেবীর নামাঙ্কিত জাহাজ গেইয়ার আগমনে। আর এই গেইয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে এত কান্ড।

Global Forum-এ যোগ দিতে আসা 12000 প্রতিনিধি ব্রাজিলের প্রশাসনের কাছে প্রথমেই এমন এক আপ্যায়ন পেয়েছে যাকে মনোরম বলা চলে না। কলুষিত পৃথিবীর প্রতীক হিসাবে স্থানীয় এক জঞ্জালের ডোবা থেকে তুলে আনা প্রচুর আবর্জনা দিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘‘Garbage Planet’’ বসুন্ধরা সম্মেলনের রাস্তায়। স্থানীয় পুলিশ তা অনুমোদন করে নি। 164 টি দেশের মানুষকে সেই সব আবর্জনা আবার সেই পূর্বের স্থানে রেখে আসতে হয়েছে। 3 -রা জুন সারারাত ধরে উত্সব। Global Forum -এর উদবোধনী অনুষ্ঠান। মহিলারাও রাত জেগে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। World Wide Fund for Nature (WWF) আকাশে উড়িয়ে দিল বিশাল বেলুন। তার গায়ে লেখা ‘‘কাজ চাই, গরম গরম কথা নয়’’।

এক কান্ড চলছে। পয়সা আসছে কোথা থেকে? কত তার পরিমাণ? দিচ্ছে Global Forum। মোট 11 মিলিয়ন অর্থাত 1 কোটি 10 লক্ষ মার্কিন ডলার। 4 ঠা জুন যখন রিও সেষ্ট্রোতে চলছে রাজনীতির লড়াই, তখন ফ্রেমিংগো পার্কে প্রচন্ড অর্থাভাব। ঠিকাদার এসে হুঁসিয়ারী দিচ্ছে। তাঁর দাবী 48 ঘণ্টার মধ্যে দেনা শোধ করতে হবে। ইতিপূর্বেই 2 মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেনা হয়ে গেছে। তার উপর ঠিকাদারের হাতে রসিদ 11.6 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। প্রধান সংগঠন Warren Linder মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। ব্যাকুল আবেদন সাংবাদিকদের কাছেও। এক মহিলা উদ্যোক্তা নিজের মাথায় টুপি খুলে অর্থ সংগ্রহে নামলেন। উল্টানো টুপিতে কিছু পড়ল বটে। গুণে দেখা গেল মাত্র 20 মার্কিন ডলার। তবে প্রতিশ্রুতি এলো অনেক। 6 -ই জুন ঘটলো আর এক ভয়ানক ব্যাপার। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অনেক সংগঠন ব্রাজিলের পুলিশের কাছে অভিযোগ করল যে ওয়ারেন লিনডার তার নিজের সংগঠন Centre for our Common Future কে গোপনে দিয়েছেন মোট 1.7 মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিরত প্রধান সংগঠন জানালেন – ‘পরীক্ষা করে হিসাব-নিকাশ দেওয়া হবে। নিজের সংগঠনের জন্য কিছুই হাতাই নি। প্রতিটি সেণ্ট খরচ হয়েছে Global Forum- এর কাজে’। সমস্যা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। UNDP -র প্রধান William Draper এবং Maurice Strong আর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনা হলো। ফল হলো না। অবশেষে বহু চেষ্টায় অর্থ সংগ্রহ হয়েছে এবং উদ্বৃত্ত হয়েছে কিছু। সেই উদ্বৃত্ত অর্থে ফ্লেমিংগো পার্কে বসান হবে সবুজ ঘাস।

Source: “VIGYAN – O - VIGYANKARMI” A bi - monthly magazine, March - June 1992, P 252 Lake Town, Block A, Calcutta – 700 089
( বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক দ্বি- মাসিক পত্রিকা, মার্চ - জুন ১৯৯২, P 252 লেক টাউন, ব্লক A, কলিকাতা – 700 089)


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading