আর্সেনিক ও গুপ্তহত্যা


চিন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস, রোম, ইওরোপ সর্বত্রই আর্সনিক প্রয়োগে শত্রুবিনাশ বা “পথের কাঁটা” সরিয়ে দেওয়ার বিস্তর ইতিহাস পাওয়া গেছে। কোথাও সম্পদ বা সিংহাসনের জন্য, কোথায়ও অসহ্য স্বামী বা স্ত্রীকে সরিয়ে দেবার জন্য।

সুপরিকল্পিত গুপ্ত হত্যায় আর্সেনিকের ব্যবহার সুপ্রাচীন। চিন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস, রোম, ইওরোপ সর্বত্রই আর্সনিক প্রয়োগে শত্রুবিনাশ বা “পথের কাঁটা” সরিয়ে দেওয়ার বিস্তর ইতিহাস পাওয়া গেছে। কোথাও সম্পদ বা সিংহাসনের জন্য, কোথায়ও অসহ্য স্বামী বা স্ত্রীকে সরিয়ে দেবার জন্য। সাদা আর্সেনিক বা সেঁকো বিষের সুবিধা এই যে এটি সহজলভ্য, বর্ণহীন, স্বাদগন্ধহীন এবং খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে সন্দেহ উদ্রেক না করিয়ে খাওয়ানো যায়। আর্সেনিক ধীরে ক্রিয়া করে এবং এর বিষক্রিয়ার লক্ষণ সাধারণ ভাবে জানা রোগের লক্ষণাদি থেকে চিকিত্সকরা আলাদা করে পার্থক্য করতে পারে না।

দু-একটি দৃষ্টান্ত:


রোমান শয়তান নেরো সিংহাসনের উত্তরাধিকারের পথের কাঁটা ব্রিটানিকাসকে আর্সেনিক প্রয়োগ হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। ইতিহাসে এবিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

প্রতিপক্ষকে সহজে ধীরে ধীরে দুর্বল, শক্তিহীন, বুদ্ধিবিবেচনা হ্রাস করিয়ে অবশেষে একটা “ফাইনাল ডোজ” দিলেই কাজ হাসিল। ইওরোপের দেশে দেশে আর্সেনিকের প্রয়োগ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে দীর্ঘকাল অশুভ অশান্তির কালো ছায়া ফেলেছিল এমনই যে রাজবাড়ি, অভিজাত, জমিদারদের ঘরে রাজা, ভাবীরাজা, পরিবারের কর্তারা সবসময়েই আর্সেনিকের ভয়ে ভীত থাকতেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, এমনকী পরিবারের লোকজনদেরও বিশ্বাস করতে পারতেন না।

ইতালিতে সতেরো শতকের শেষদিকে যেসব স্ত্রীলোকরা ভিন্ন স্বামী আকাঙ্খা করতেন, সিসিলির এক টোফোনো (বা লের্মোত্ত নেপালের টোফানো বা টোফানা) তাদের অ্যাকোয়া টোফানিয়া বা অ্যাকোয়েটা বা ঘাতক তেল দিত, যার কুখ্যাতি বহুদূর ছড়িয়েছিল। ফকসগ্লাভ (ডিজিটালিস)-এর নিষ্কাশিত রসের সঙ্গে আর্সেনিয়াস অকসাইড মিশিয়ে বোতলে ভরে পূণ্যাত্মার ছবি সহ সে বিক্রি করত। ঐ ওষুধ নাকি পূণ্যাত্মা নিকোলাস বারির কবর থেকে তেল বা জলের মতো চুঁইয়ে বোরোত, তার অলৌকিক গুণেই নাকি নানারকম রোগ সারত। তার চার থেকে ছয় ফোঁটাতেই কাজ হাসিল হত। 1709 সালে “রাকে” (শাস্তি দেবার যন্ত্র) চড়ানোর সময় সে কবুল করে যে 600 এর বেশি লোককে সে মেরেছে। তখন গলা টিপে তাকে মেরে ফেলা হয়। ফ্রান্সে “মৃত্যুদীপের” (ডেথ ল্যাম্পের) রমরমা ব্যবসা এক সময় চলেছিল। প্রদীপের জ্বালানি তেল ও মোমের সঙ্গে আর্সেনিক মিশিয়ে যে মৃত্যুদীপ ব্যবহার করা হত, কিছুদিন তার ধোঁয়ার সঙ্গে শ্বাস নিলে ধীর মৃত্যু অবধারিত ছিল। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গুপ্ত হত্যার জন্যে অনেক কারবার গজিয়ে উঠেছিল।

শহরাঞ্চলের সুন্দরী চৌকশ মহিলারাই ব্যবসায়ে বেশি উপার্জন করে গেছেন। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে সন্দেহজনক অনেকেই আইনী সাজা থেকে রেহাই পেয়ে যেত। 1836 সালে ফরাসি কেমিস্ট জেমস মার্শ আর্সেনিক সনাক্তকরণের রাসায়নিক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন, যা নানারূপে আজও ব্যবহৃত। তিনি মাইকেল ফ্যারাডের সঙ্গে কাজ করতেন। এতে একদিকে যেমন আর্সেনিকের গুপ্তহত্যা কমল, তেমনি অন্যদিকে রসায়ন ও বিষবিজ্ঞান উন্নত হল। এরপরেও আর্সেনিক ব্যবহার করে গুপ্তহত্যা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, না ইওরোপে, না অন্যত্র। যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশের বিখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা, যা বাংলার ঘরে ঘরে বহুকাল মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়েছিল। ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালের রাজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের 1909 সালের এপ্রিল মাসে দার্জিলিঙে মৃত্যু হয়। তাঁর শবদাহের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে। অথচ তার পরে মৃত মানুষের পুনরাবির্ভাব ও সিংহাসনের দাবি প্রভৃতি নিয়ে বহু মামলা মোকদ্দমা হয়, বিলেতের প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত তা যায়। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের অসুখের লক্ষণাবলী আর্সেনিক বিষণের লক্ষণাবালীর সঙ্গে মিলে যায়। আজও সন্দেহ থেকেই গেছে রানি ডাক্তারের সঙ্গে যোগসাজসে আর্সেনিক প্রয়োগে স্বামীকে হত্যা করিয়েছিল কিনা।

অস্ট্রলিয়ার আদিবাসীদের ব্রিটিশরা খাবার দিত আর্সেনিক মিশিয়ে


অস্ট্রেলিয়ার ম্যানিং নদী উপত্যকায় অর্ধাহার ও অনাহার-ক্লিষ্ট আদিবাসীদের 1840- এর দশকের শেষদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা ঐক্য নীতির প্রয়োগ করে আর্সেনিক যুক্ত খাবার উপহার দিত। ইওরোপীয়দের বড় হওয়া ও পৃথিবী বিজয়ের এটি আর একটি দৃষ্টান্ত।

প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading