আর্সেনিক পীড়িত মানুষজনের বর্তমান ও ভবিষ্যত ভাবনা


ইতিমধ্যেই যে হাজার হাজার টন আর্সেনিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত জলের মাধ্যমে ক্রমাগত ছড়াচ্ছে, এখন একেবারে তা বন্ধ করা গেলেও (যা প্রায় অসম্ভব), তার সুদূরপ্রসারী কু-প্রভাব আগামী বহু শতক ধরে বাঙালী জাতিকে বয়ে চলতেই হবে। এই আচমকা ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জে এ-এদেশের মানুষ যেভাবে সাড়া দেবে তাই তার ভবিষ্যত নির্ধারিত করবে।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের আর্সেনিক পীড়িত মানুষজনের বর্তমান ও ভবিষ্যত ভাবনাই এই লেখার মূল অনুপ্রেরণা। জনস্বাস্থ্য ও কৃষির প্রয়োজনে বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে ভূগর্ভ-জল উত্তোলন হচ্ছে, তার থেকে উঠে আসা আর্সেনিক মানুষজন সহ উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু – সবার ওপরেই যে বিষময় প্রভাব ফেলছে, সে বিষয়ে সকলেই আজ অল্পবিস্তর জানেন আলোচনা, সংবাদ মাধ্যম প্রভৃতির সূত্রে। আর্সেনিক পীড়িত মানুষজন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনসাধারণ অস্বাস্থ্য ও যন্ত্রণার মধ্যে মর্মে মর্মে আর্সেনিক উপলব্ধি করেছেন। আর শহরাঞ্চলের শিক্ষিত স্বচ্ছল মানুষজন অন্তত বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারটা খানিকটা বুঝছেন। তবু অনেকেরই অনেক কিছুই আজও অজানা, মনে অনেকেরই নানা প্রশ্ন, নানা সংশয়। ইতিমধ্যেই যে হাজার হাজার টন আর্সেনিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত জলের মাধ্যমে ক্রমাগত ছড়াচ্ছে, এখন একেবারে তা বন্ধ করা গেলেও (যা প্রায় অসম্ভব), তার সুদূরপ্রসারী কু-প্রভাব আগামী বহু শতক ধরে বাঙালী জাতিকে বয়ে চলতেই হবে। এই আচমকা ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জে এ-এদেশের মানুষ যেভাবে সাড়া দেবে তাই তার ভবিষ্যত নির্ধারিত করবে।

অথচ বিগত দু-দশকে নিবেদিত কিছু বিজ্ঞানী ও সংবাদ মাধ্যমের সুপ্রয়াস সত্ত্বেও সরকার থেকে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত সবাই আশ্চর্যভাবে আজও উদাসীন। কারণ সম্ভবত পরিবেশীয় আর্সেনিক বিষণ এসেছে নিঃশব্দে, চুপিসারে ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা, চের্নোবিল পরমাণু চুল্লি দুর্ঘটনা বা সাম্প্রতিক সুনামিতে যে চমক আছে, নাটকীয়তা আছে, ধীর নিঃশব্দ আর্সেনিক বিষণে সেরকম চমক নেই। অথচ ইত্তরোপ আমেরিকার বহু বিশেষজ্ঞের সুচিন্তিত অভিমত, বাংলার এই আর্সেনিক বিষণ মানুষের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম পরিবেশ বিপর্যয়। সব দেশেই কি এমন হয়? ১৯৫০-এর দশকে ডিডিটি-র নিঃশব্দ ধীর মারণ তাণ্ডব পরিবেশ ও জীবজগতে যে সর্বনাশ করেছিল, তা নিয়ে মহীয়সী রাচেল কারসনের “নীরব বসন্ত” (Silent Spring, ১৯৬২) বইটি আমেরিকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের এমন নাড়া দিয়েছিল যে মানব পরিবেশ নিয়ে বিরাট বিপ্লব হয়ে গিয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে। সেই বিপ্লব আজও অব্যাহত।

আর্সেনিক সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যে রকম আবশ্যক, তেমনি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই সমস্যাটি সবদিকে দিয়ে বোঝা ও বোঝানো দুরূহ।

আর্সেনিক বিষণের কিছু নমুনা-


1. বিষের রাজা আর্সেনিক অন্য সব পদার্থ বা বিষ থেকে মনুষ্য ইতিহাসকে বেশি প্রভাবিত করেছে।
- জেরোম ও নূয়াণ্ড, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা।

2. বাংলাদেশের আর্সেনিক গণবিষণ সর্বকালের সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর গণবিষণ, যার কাছে ভূপাল গ্যাস দির্ঘটনা বা চের্নোবিল পরমাণুচুল্লি বিস্ফোরণ নেহাতই ছেলেখেলা। পরিবেশে বর্ধিত আর্সেনিককে তেজস্ক্রিয় দূষণের মতোই গণ্য করতে হবে।
- রিচার্ড উইলসন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যালান স্মিথ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

3. প্রতি 15 মিনিটে বাংলাদেশে এখন একজন করে মানুষের আর্সেনিকে মৃত্যু হচ্ছে।

4. 200 থেকে 300 মিলিগ্রাম আর্সেনাস অকসাইড একটা মানুষকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। মালদহের একিট গ্রামীণ পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প থেকে প্রতিবছর 148 কেজির মতো আর্সেনিক উঠছে। উত্তর 24 পরগণার দেগঙ্গা থানার অন্তর্গত 201 বর্গকিমি অঞ্চলে সেচের ভূগর্ভজলে প্রতিবছর 3,200 নলকূপ থেকে 6.4 টন আর্সেনিক উঠছে।
- দীপঙ্কর চক্রবর্তী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

5. সেচের ফলে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা লবণে মাটির লবণাক্ততা বাড়ায় সুমেরীয় ও সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবছর দুই বাংলায় হাজার হাজার টন ভূগর্ভ জলবাহিত আর্সেনিক বিষ ক্ষেতে ছড়ানোতে বাংলা ও বাঙালি কি বাঁচবে?

6. সম্রাট নেপোলিয়নকে কি আর্সেনিক খাইয়ে মারা হয়েছিল, না সেণ্ট হেলেনার আর্দ্র উষ্ঞ আবহাওয়ায় দেওয়ালচিত্রের আর্সেনিকঘটিত রঙে ছত্রাকের বিক্রিয়ায় উত্পন্ন আর্সাইন বিষণে মৃত্যু হয়েছিল? না অন্য কিছু?

7. ভ্যাম্পায়ার ড্রাকুলার লোককথার মূলে কি অস্ট্রিয়ার আর্সেনিকের অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী আর্সেনিক ভোক্তাদের কবরস্থ মৃতদেহ, না দেহে প্রবিষ্ট আর্সেনিকের পরফাইরিন বিপাকে বিঘ্ন ঘটানো থেকে উত্পন্ন বীভত্স পরফাইরিয়া রোগাক্রান্ত মানুষের চেহারা ও আচার-আচরণ?

8. 1950 এর দশকে স্লোভাকিয়ার নোভাকি তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্গত ফ্লাইঅ্যাশের আর্সেনিকে বায়ুর অনুকুলে 30 কিমি দূর পর্যন্ত মৌমাছিদের সর্বনাশ, শুয়োর, গবাদি পশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অতিরিক্ত গর্ভপাত, কম ওজনের শিশুর জন্ম ও জন্মগত অসুখবৃদ্ধি দায়ী প্রমাণিত হয়।

9. বাংলাদেশের ঢাকার কাছাকাছি আড়াইহাজার অঞ্চলে 10 বছর বয়সি শিশুদের ওপর বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে ক্রনিক আর্সেনিক বিষণে শিশুদের মেধা ও শেখবার ক্ষমতা কম হয়, যদিও অন্য কোন দিকে ঐ সব শিশুদের বিশেষ অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয় না।
- কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইল ভাসারম্যানের নেতৃত্বাধীন গবেষকদ (2004)।

10. থাইল্যাণ্ডের নাকোর্ন সিরি থামারাট প্রদেশের রনপিবুন জেলায় 6 থেকে 9 বছরের ওপর বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে চুলের আর্সেনিক ভারের সাথে শিশুদের গড় বুদ্ধ্যঙ্ক (IQ) লক্ষণীয়ভাবে কমে।
- শিরিপিটায়া কুনকিট ও সহকর্মীবৃন্দ, ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে 1998 সালে অনুষ্টিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক আর্সেনিক সম্মেলন।

11. যেসব দেশের মানুষজন উঁচুমাত্রায় আর্সেনিকে উন্মুক্ত, কি করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে সেইসব দেশের সরকারকে সর্বাগ্রে আমি এই পরামর্শই দেব তাঁরা অন্তত গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের জন্য কম আর্সেনিকযুক্ত জলের ব্যবস্থা যেন করেন।
- আমেরিকার বিশিষ্ট ইনঅরগ্যানিক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ মাইকেল ওয়াকেস, 2004।

12. ভূগর্ভ অ্যাকুইফারে মাঝে মাঝে মাত্রায় কিছু রাসায়নিক ইনজেকশন করে উত্সভূমেই আর্সেনিককে সমাধিস্থকরণ বাস্তয়নের পথে।

13. বাংলার পুকুর, জলাশয় ও নদীসমূহের জল সাধারণভাবে আর্সেনিকমুক্ত হওয়ায় তা শোধন করে পানীয়জল হিসেবে সরবরাহ করলে আর্সেনিক সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। চাষের জন্যও এইসব জল ব্যবহার্য। পুকুরে জল কমে গেলে ভূগর্ভ জলোত্তোলন করে পুকুরে দুদিন রেখে দিলেই জল আর্সেনিকমুক্ত হবে। তাতে কিছু লোহার জাল রেখে দিলে উত্পন্ন মরিচা আর্সেনিক শোষণ করে জলকে দ্রুত আর্সেনিক মুক্ত করবে।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading