আর্সেনিক পরিচিতি


সবচেয়ে সুপরিচিত আর্সেনিক হল আর্সেনিয়াস অকসাইড, বাংলায় সেঁকোবিষ বা শঙ্খবিষ, হিন্দিতে সম্বুলক্ষার, শঙ্খীয় সম্বুল, সংস্কৃতে সবলক্ষার, চিনে পী-সঙ নামে পরিচিত এবং ভারত সহ প্রাচীন সভ্যতার সব দেশেই বহুকাল ধরে ওষুধ, আত্মহত্যা ও পরহত্যার জন্য ব্যবহৃত (suicide and homicide agent) হত।

আর্সেনিক একটি মৌলিক পদার্থ, রাসায়নিক প্রকৃতি বিচারে যা একটি ধাতুকল্প (metalloid), অর্থাত এর রাসায়নিক ও ভৌতিক ধর্মে ধাতুর মতো গুণাবলী যেমন কিছু দেখা যায়, তেমনি অধাতুর কিছু বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা যায়। তবে অধাতু থেকে এতে ধাতব ধর্মই যেন একটু বেশি। পাঠকের সম্ভাব্য বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য আগেই বলে রাখা ভাল যে, আর্সেনিক যৌগাদির নামকরণে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে সামান্য ভেদ দেখা যায়। আর্সেনিকের আলোচনায় নামের চেয়ে ফর্মূলার সুবিধা ও গুরুত্বই বেশি।

আর্সেনিকের রাসায়নিক প্রতীক হল AS, পারমাণবিক গুরুত্ব 74.92, পরমাণু ক্রমাঙ্ক 33, পর্যায় সারণীর 15 নম্বর (পুরানো V-B) গ্রুপে ফসফরাসের ঠিক নীচেই এর অবস্থান। ফলে ফসফরাসের রাসায়নিক ধর্মের সঙ্গে আর্সেনিকের রাসায়নিক ধর্মের সাদৃশ্য দেখা যায়।

প্রকৃতিতে আর্সেনিকের একটি মাত্র আইসোটোপই (monoisotopic) পাওয়া যায়। ভূপৃষ্ঠে আর্সেনিকের প্রাচুর্য মাত্র 1.8 পিপিএম (গড়ে কেজি প্রতি 2 মিগ্রা, প্রায় 2x10-4%)। প্রাচুর্য বিচারে এর অবস্থান 20 নম্বর স্থানে এবং একে সামান্য বা কণামাত্রিক উত্পাদন (trace element) বলা হয়। পদার্থ যেহেতু অবিনশ্বর তাই আর্সেনিক সৃষ্টির প্রথম থেকেই পৃথিবীতে আছে, এবং থাকবেও। প্রকৃতি ও পরিবেশে ক্রমাগত তার রূপান্তর ঘটে, এক রাসায়নিক অবস্থা থেকে ভিন্ন অবস্থায়, অর্থাত তার অবস্থান বদলায় স্থানে কালে। ‘আর্সেনিক’, এই কথাটি দিয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনায় শুধু এই মৌলিক পদার্থ ছাড়াও আর্সেনিকের সবরকম যৌগিক পদার্থকেই বোঝায়, তা সেই যৌগ আর্সেনিকের অকসাইড সালফাইডের মতো অজৈব, জৈব বা জৈবধাতব যে রকমই হোক না কেন, যে রকম ভাবেই তারা সৃষ্ট হোক না কেন। সবচেয়ে সুপরিচিত আর্সেনিক হল আর্সেনিয়াস অকসাইড, বাংলায় সেঁকোবিষ বা শঙ্খবিষ, হিন্দিতে সম্বুলক্ষার, শঙ্খীয় সম্বুল, সংস্কৃতে সবলক্ষার, চিনে পী-সঙ নামে পরিচিত এবং ভারত সহ প্রাচীন সভ্যতার সব দেশেই বহুকাল ধরে ওষুধ, আত্মহত্যা ও পরহত্যার জন্য ব্যবহৃত (suicide and homicide agent) হত। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইওরোপে এর নাম ছিল স্যানডারাক (sandarach)।

 

আর্সেনিকের জারণস্তর চারটি

-3

0

+3

+5

এইভাবেও এরা নির্দেশিত হয়

As (III)

Aso

As(III)

As(v)

 

মৌলিক পদার্থ হিসাবে স্বাভাবিক আর্সেনিক (Aso) পৃথিবীতে বিরল। ইওরোপের হার্জ পর্বত ও জাপানে সামান্য পাওয়া গেছে। পরিবেশ ও জীবজগতে আর্সেনিক প্রধানত As(III) ও As(v) হিসাবেই থাকে এবং তারাই সবিশেষে গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান আলোচনায়। বিজারক পরিবেশে আর্সেনিক As(III) হিসেবেই বেশি থাকে। আর জারক পরিবেশে As(v) হিসাবে।

অত্যধিক বিজারক পরিবেশে, বিশেষ করে ছত্রাক ও নানান জীবাণুর প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ায় বহু আর্সেনিক ঘটিত পদার্থে আর্সেনিক As(-III) অবস্থায় চলে যায়। সেই অবস্থায় আর্সেনিক যৌগ ভয়ঙ্কর বিষ। এরা উদ্বায়ী এবং প্রকৃতিতে উত্পন্ন হয়। অজৈব As(III) (যা ভূগর্ভ জলে বেশ কিছু থাকে), As(V) এর থেকে অধিক বিষ।As(III)-এর রাসায়নিকগুলিকে আর্সেনাইট বলে, আর As(V) এর রাসায়নিককে আর্সেনেট বলে।

জারণ - বিজারণ পরিবেশীয় অবস্থার পরিবর্তনে, আনুষঙ্গিক অম্লতা - ক্ষারকীয়তা (pH) অনুযায়ী এবং/ অথবা জীবাণুসমূহের প্রকৃতি ও উপস্থিতির মাত্রা অনুযায়ী নির্ভর করে As(III) ও As(V) এর পারস্পরিক অনুপাত। As(III) ও As(As(V) এর রূপান্তর সহজ ও স্বাভাবিক। তবে বিক্রিয়ার গতি (kinetics) অনুঘটকের অনুপস্থিতিতে ধীর। বাংলার ভূগর্ভ জলে অজৈব As(III) ও As(v) দুইই পাওয়া যায়। প্রায় সমান সমান অনুপাতে। As(III) পাওয়া যায় কিছু পরিমাণে।

রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া সর্বব্যাপী


এক মৌলের পরমাণু অন্য এক বা একাধিক মৌলের পরমাণুর সঙ্গে নানাপ্রকার রাসায়নিক বন্ধনীর মাধ্যমে বিচিত্র নানান পদার্থের অণু সৃষ্টি করে, যাদের প্রত্যেকের ধর্ম বা গুণাগুণ ভিন্ন ভিন্ন। পদার্থের যেহেতু ধ্বংস বা বিনাশ নেই, তাই অবিরাম ঘটে চলে তাদের রূপান্তর, এক পদার্থ থেকে ভিন্নতর পদার্থে পরিবর্তন। রাসায়নিক বিক্রিয়াজাত পদার্থের এই রূপান্তর জড়জগত জীবজগত সর্বত্রই প্রতিনিয়ত ঘটে চলে, জলে স্থলে বাতাসে, জীবদেহে সর্বত্র, এমনকী মহাকাশেও। রাসায়নিক বিক্রিয়া নানাপ্রকার। তার মধ্যে প্রধান হল জারণ-বিজারণ আর অম্ল-ক্ষারক প্রশমন।

জারণ- যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনও পরমাণু বা আয়ন ইলেকট্রন বর্জন করে তাকে জারণ বলে।

বিজারণ- যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনও পরমাণু বা আয়ন ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাকে বিজারণ বলে।

জারক- কোনও জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ায় যে পদার্থটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাকে জারকদ্রব্য বলে।

বিজারক- কোনও জারণ - বিজারণ বিক্রিয়ায় যে পদার্থটি ইলেকট্রন বর্জন করে তাকে বিজারক দ্রব্য বলে। জারণ-বিজারণ একই সঙ্গে ঘটে অর্থাত কোনও পদার্থের জারণ হলে অন্য কোনও পদার্থের বিজারণ হতেই হবে, কারণ ইলেকট্রনের মুক্তাবস্থায় কোনও দীর্ঘস্থায়ী স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পরিবেশে থাকতে পারে না। নিম্নলিখিতভাবে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া দেখানো যেতে পারে।

(জারকদ্রব্য)1,+ (বিজারকদ্রব্য)2 ⇄ (জারকদ্রব্য) + (বিজারকদ্রব্য)14Fe(OH)3 + CH2O + 7H+ ⇄ HCO3 - + 4Fe2- + 10H2O AsO43- – H2S = S0 – AsO33- - H2Oকাঠ বা গ্যাস পুড়লে রাসায়নিক পরিবর্তন হয় ও তা থেকে তাপ উত্পন্ন হয়। কাঠে জীবাণু বা ছত্রাকের বিক্রিয়ায় কাঠপচা জীব-রসায়নিক পরিবর্তন, পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাক প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া, ওষুধ খেয়ে জীবাণু ধ্বংস করে অসুখ নিরাময় সর্বত্রই রাসায়নিক বিক্রিয়া। বাতাসের অকসিজেনের প্রবণতা অন্য পদার্থ থেকে ইলেকট্রন টেনে নিয়ে তাকে জারিত করা। তাই বাতাসকে জারণধর্মী বলা হয়।

অম্ল-ক্ষার প্রশমন বিক্রিয়ায় আম্লিক পদার্থের প্রোটন (H+ আয়ন) ক্ষারীয় হাইড্রক্সিল মূলক (OH-) বা অক্সাইড আয়নের (O2) সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে লবণ ও জল উত্পন্ন করে।

অম্ল + ক্ষার ⇄ লবণ + জল
কোনও কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জারণ-বিজারণ ও অম্ল-ক্ষার প্রশমন একই সঙ্গে হয়ে থাকে। যথা :
আর্সেনেট + প্রোটন + ইলেকট্রন ⇄ আর্সেনাইট + জল

রসায়নের ভাষায় : AsO43- + 2H+ + 2e- ⇄ AsO33- + H2O

আর্সেনেটের As5+ বা As(V) দুটি ইলেকট্রন টেনে নিয়ে As3+ বা As(III) -তে বিজারিত হয়। উপরোক্ত রাসায়নিক সমীকরণটি অসম্পূর্ণ, কারণ সেখানে ইলেকট্রনদাতা উহ্য। তাই একে অর্ধ-বিক্রিয়া বলে।

As(v) + 2e- ⇄ As(III)

ইলেকট্রনদাতা বিজারকদ্রব্য বহু কিছুই হতে পারে, যথা:
AsO43- + 2H+ + S2- ⇄ AsO33- + H2O + S0

আর সালফাইডের সাথে বিক্রিয়া করে অদ্রাব্য আর্সেনিয়াস সালফাইড উত্পন্ন হয়।

2AsO33- + 3S2-+ 12H+ ⇄ As2S3 ↓ + 6H2O (↓চিহ্ন অধঃক্ষেপণ নির্দেশ করে)

মানবদেহে As(V) বিজারিত হয়ে As(III) হয়, তেমনি As(III)ও জারিত হয়ে As(v)হয়। কোনও মিথাইলদাতা অণু থেকে মিথাইল মূলক (CH3) সংযুক্ত হলে বৃহত্তম অণু মনোমিথাইল আর্সোনিক অ্যাসিড [CH3AsO(OH)2] । সংক্ষেপে MMA, হয়ে থাকে। এই বিক্রিয়াকে মিথাইল সংযোজন বা জীবমিথাইলেশন বলে। আবার কিছু ছত্রাক আর্সেনেটকে বিজারিত করে আর্সেনাইটে, এমনকী আর্সাইনেও পরিবর্তিত করতে পারে। লক্ষণীয় As5+ থেকে আর্সাইনে (As3-) রূপান্তরে আটটি ইলেকট্রন স্থানান্তরের দুরুহ কাজ ছত্রাকের কিছু এনজাইম করে থাকে।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading