আর্সেনিকের পরিবেশ রসায়ন


ভূমিকা
জীবদেহ একটা জটিল রাসায়নিক ফ্যকটরি, অবশ্য শুধু জটিল না বলে বলা যায় জটিল চমত্কার রাসায়নিক ফ্যকটরি। জীবের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যাপ্ত তার ভিতর অবিরাম ঘটে চলে বিচিত্র নানা রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া। রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়ায় উত্পন্ন পদার্থসমূহ জীবের পুষ্টি ও শক্তি সরবরাহ করে, অবশ্য সঞ্চয়ও করে কিছু। দেহের ভিতরকার প্রাণ - রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে জীবনের সমাপ্তি, বিক্রিয়াসমূহের সামান্য হেরফেরেই অসুস্থতা। জীবদেহের রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া চরম বিচারে জিন প্রেরিত সংকেত সমূহেই ঘটে থাকে। আর্সেনিক জীবদেহের অত্যাবশ্যকীয় বিক্রিয়া সমূহকেই বিঘ্নিত করে থাকে...। মানুষ তথা সমগ্র জীবজগতে, জল, বাতাস ও মাটিতে আর্সেনিকের প্রভাব নির্ভর করে তার রাসায়নিক প্রজাতিসমূহের প্রকৃতির ওপর, যা আবার চরম বিচার নির্ভরশীল আর্সেনিক মৌলটির পারমাণবিক গঠন, বিশেষ করে তার ইলেকট্রন গঠন বিন্যাসের ওপর। পর্যায় সারণির একই স্তম্ভে নাইট্রোজেন ফসফরাসের ঠিক নীচেই হল আর্সেনিকের অবস্থান। বলা হয়ে থাকে নাইট্রজেন ও ফসফরাস জীবদেহে অত্যাবশ্যক, কিন্তু আর্সেনিক জীবদেহে অত্যাবশ্যক তো নয়ই এমনকি আবশ্যকও নয়, আর্সেনিক জীবদেহে, অন্তত মনুষ্যদেহে বিষ। মৌলদ্বয়ের পারমাণবিক সাদৃশ্যহেতু ফসফেট ও আর্সেনেট রাসায়নিক ভাবে সদৃশ, ইলেকট্রনিক ও আণবিক গঠনে সদৃশ হওয়ায় জীবকোষের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আর্সেনিক দেহকোষে ঢুকে পড়ে খাদ্য, পানীয় বা বাতাস মাধ্যমে। কিন্তু ফসফরাসের সঙ্গে আর্সেনিকের যে সামান্য বৈসাদৃশ্য আছে, তার জন্যই দেহাভ্যস্তরে আর্সেনিকের কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, তা থেকে উত্পন্ন পদার্থসমূহ জীবদেহের প্রাণ - রাসায়নিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শুধু ক্ষতি করেই শেষ হয় না তার কাজ, তাকে অসুস্থ করে, এমনকী মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।

রসায়ন বিজ্ঞান থেকে দেখা যায় ফসফরাসের তুলনায় আর্সেনিক অপেক্ষাকৃত সহজে As (V) থেকে As (III) -তে বিজারিত হয় ; আবার As (III) -এর জারণে As (V) -এর উত্পাদনও অপেক্ষাকৃত সহজই। দুটো দুভাবে দেহের প্রাণ - রাসায়নিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ; As (III) প্রোটিন ও এনজাইমের সালফহাইড্রিল (-SH) গ্রুপের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তার কার্যকারিতা নষ্ট করে, আর আর্সেনেট As (V) দেহ কোষের নিইক্লিওটাইডে ফসফেটের জায়গায় ঢুকে পড়ে আর্সেনোলাইসিস ঘটিয়ে জীবকে অসুস্থ বা মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে। দেহে যে রাসায়নিক পরিবেশে থাকে সেখানে ফসফেটের P (V) এর সহজ বিজারণ হয়ে P (III) হতে পারে না ; কোনও এনজাইমের কার্যকারিতাও নষ্ট করতে পারে না। তাই ফসফরাস হল পুষ্টি, আর অন্যদিকে আর্সেনিক হল বিষ।

জীবদেহ একটা জটিল রাসায়নিক ফ্যকটরি, অবশ্য শুধু জটিল না বলে বলা যায় জটিল চমত্কার রাসায়নিক ফ্যকটরি। জীবের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যাপ্ত তার ভিতর অবিরাম ঘটে চলে বিচিত্র নানা রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া। রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়ায় উত্পন্ন পদার্থসমূহ জীবের পুষ্টি ও শক্তি সরবরাহ করে, অবশ্য সঞ্চয়ও করে কিছু। দেহের ভিতরকার প্রাণ - রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে জীবনের সমাপ্তি, বিক্রিয়াসমূহের সামান্য হেরফেরেই অসুস্থতা। জীবদেহের রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়া চরম বিচারে জিন প্রেরিত সংকেত সমূহেই ঘটে থাকে। আর্সেনিক জীবদেহের অত্যাবশ্যকীয় বিক্রিয়া সমূহকেই বিঘ্নিত করে থাকে।

দেহাভ্যন্তরের বস্তু সমূহের গুরুত্বপূর্ণ তিন ভাগ হল জেনোম (genome) -জিন ও তত্সম্পর্কিত যৌগসমূহ, প্রোটিওম (proteome) - প্রোটিন ও এনজাইমসমূহ আর, মেটালোম (metallome)- ধাতু ও অধাতব পদার্থসমূহ, যারা অত্যল্প মাত্রায় প্রাণ - রাসায়নিক ক্রিয়াকর্মে সহায়তা বা অনুঘটকীয় কাজ করে জীবদেহে অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে। আর্সেনিক তার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের জন্য জীবদেহের প্রাণ - রাসায়নিক ক্রিয়াকর্মে কোনও ভাবেই কাজ করতে পারে না। তাই জীবনের সৃষ্টি ও বিবর্তনে মৌলসমূহের প্রাকৃতিক নির্বাচনে (Natural Selection of the Chemical Elements) আর্সেনিক স্থান পেতে পারেনি।

প্রাণহীন আদিম পৃথিবীতে বহমান জলতলে অজৈব কিছু পদার্থের বিশেষ সন্নিবেশেই সৃষ্টি হয়েছিল আদ্যপ্রাণ, যা পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ও ভূরাসায়নিক বিবর্তনের দীর্ঘপথ ধরে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। জীববিবর্তনের সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই জীবসমূহের প্রাণ - রাসায়নিক ব্যবস্থা সমূহেরও বিবর্তন ঘটেছে। জীবের অভ্যন্তরীণ প্রাণ - রাসায়নিক ফ্যাকটরি হয়েছে উন্নততর, জটিলতর। কালক্রমে নতুন নতুন মৌল সমূহেরও অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে যারা অনুঘটকীয় ও অন্যান্য ভূমিকা পালন করে জীবযন্ত্রকে সচল ও পরিবর্তিত পরিবেশের উপযোগী করে কর্মক্ষম রেখেছে। প্রথম প্রাণ যেসব রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ছিল প্রাচুর্য (যেমন জল ), সহজলভ্যতা, রাসায়নিক সক্রিয়তা, রাসায়নিক বন্ধনশক্তি, উত্পন্ন যৌগাদির সুস্থিতি (thermodynamic and kinetic stability) যাদের একাণু বা মনোমারগুলি সরলরৈখিক ভাবে জুড়ে জুড়ে নানা জাতের বড় বড় বহু আণবিক বা পলিমার সহজেই উত্পন্ন হয়। জীবজগতে আজও শতসহস্র কোটি বিভিন্ন ধরনের প্রাণ - রাসায়নিক অণু ( বায়োমলিকুল) আছে, যারা সামান্য কয়েকটি মৌলিক পদার্থের (যথা কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার ) সমন্বয়ে উত্পন্ন। এত কোটি কোটি জৈব বহু আণবিক (বায়োপলিমার) হাজারখানেকের কম মনোমার (একাণু) থেকে বিভিন্ন রকম বিন্যাস ও সংযুক্তির (permutations and combinations) মাধ্যমে উত্পন্ন। আবার এই হাজার খানেক একাণু মাত্র ডজন দুয়েক মৌল নিয়ে তৈরি। জীবনের এইসব সাংগঠনিক উপাদান সমগ্র জীবজগতে প্রায় একই। তাদের প্রাণ - রাসায়নিক ব্যবস্থাসমূহেও যথেষ্ট মিল, কোষ উপাদান ও জিনসঙ্কেত (জেনেটিক কোড) সর্বত্র প্রায় একইরকম।

জীবদেহে আবশ্যকীয়তা অনুসারে মৌলসমূহকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায় (শতাংশে, ভিজা ওজন)

 

বৃহত পুষ্টি

স্বল্প পুষ্টি

কণা পুষ্টি

কোথাও কোথাও প্রয়োজন

প্রয়োজন     প্রশ্নজনক

হাইড্রজেন (62.8)

অক্সিজেন (25.4)

কার্বন (9.4 )

নাইট্রোজেন (1.4)

           99.0

           

সোডিয়াম

পটাশিয়াম

ক্যালসিয়াম

ম্যাগনেসিয়াম

ফসফরাস  

সালফার                       

ক্লোরিন

0.9          

ম্যাঙ্গানিজ

আয়রন

কোবাল্ট

নিকেল

কপার

জিঙ্ক

মলিবডেনাম

টাংস্টেন                             বোরন                            সিলিকন                        সেলেনিয়াম                          0.1

            

ভ্যানাডিয়াম

ক্রোমিয়াম

ফ্লোরিন

আয়োডিন

আর্সেনিক

টিন

ব্রোমিন

 

আর্সেনিকের রসায়ন থেকে বোঝা সম্ভব কোন অম্ল - ক্ষারকীয়তা (pH), কোন জারণ - বিজারণ পরিবেশ ( pE বা Eh) আর্সেনিকের কোন রকম রাসায়নিক প্রজাতি উত্পন্ন হয়, জীবদেহে তাদের কিরকম বিক্রিয়া সম্ভব, মাটিতে বা জলের সেডিমেণ্টে কতকাল কতটা আবদ্ধ থাকতে সক্ষম, কতটা কিভাবে তারা জীবলভ্য ও কৃষি ফসলে প্রবেশে সক্ষম, এইসব বুঝতে আর্সেনিকের রসায়ন প্রয়োজন। তাই আর্সেনিক রসায়নের প্রাথমিক পরিচিতি ও তারই সামান্য বিস্তারন হল।

রাসায়নিক প্রজাতি


কোনও একটি মৌলের অনেক যৌগ থাকতে পারে। তাদের প্রত্যেকের ভৌতিক, রাসায়নিক ধর্মাবলী এবং পরিবেশ ও জীবদেহে ক্রিয়া - বিক্রিয়া বিভিন্ন রকম। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বা পরিবেশীয় অবস্থাভেদে পারস্পরিক রূপান্তর ঘটে। এদের এক একটি রূপকে রাসায়নিক প্রজাতি বলে। যেমন কার্বন মনোকসাইড (CO) বিষ, কার্বন ডাই অকসাইড (CO2) বিষ নয়। তাদের অন্যান্য ধর্মেও বিপুল পার্থক্য। পরিবেশ, ইকোসিস্টেম, উদ্ভিদ, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গাদিতে আর্সেনিকের বিভিন্ন রাসায়নিক প্রজাতির ক্রিয়া - বিক্রিয়া বিভিন্ন। যেমন, উদ্বায়ী আসাইন গ্যাস (AsH3) মারাত্মক বিষ, স্বল্প মাত্রায়ও তাত্ক্ষণিক মৃত্যু অনিবার্য। আর্সেনাইট [ As (III) ] তাত্ক্ষণিক মৃত্যু না ঘটালেও যথেষ্ট বিষ। আর্সেনেটের [ As (V) ] বিষক্রিয়া অপেক্ষাকৃত কম হলেও তা যথেষ্ট ক্ষতিকর। দেহাভ্যন্তরে আবার As (V) প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ায় As (III)- তে পরিণত হতে পারে ও শারীরিক অসুস্থতা বাড়তে পারে। আর বহু জৈব আর্সেনিক ( যেমন আর্সেনোবিটেন, আর্সেনোকলিন) যা মাছ, নানারকম জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদে সমধিক বিদ্যমান, তা অপেক্ষাকৃত নির্দোষ।

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading