বাংলার আর্সেনিকের ইতিবৃত্ত


নলকূপের জলের আর্সেনিক থেকে আর্সেনিক রোগের প্রথম আবিষ্কার পশ্চিমবঙ্গে 1982 সালে, বাংলাদেশে 1984-তে আবিষ্কারক ডঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা (1930), কলকাতার ট্রপিক্যাল স্কুল অফ মেডিসিনের চর্মরোগের বিভাগীয় প্রধান।

নলকূপের জলের আর্সেনিক থেকে আর্সেনিক রোগের প্রথম আবিষ্কার পশ্চিমবঙ্গে 1982 সালে, বাংলাদেশে 1984-তে আবিষ্কারক ডঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা (1930), কলকাতার ট্রপিক্যাল স্কুল অফ মেডিসিনের চর্মরোগের বিভাগীয় প্রধান। ১৯৮২-র জুলাই মাসে হাসপাতালের বহির্বিভাগে একদিন রোগী দেখতে তিনি বারাসতের গঙ্গাপুর গ্রামের হালদার পাড়ার অলক সরকার (19) নামে একটি রোগী পেলেন যার চামড়ার রং অজ্ঞাত কারণে কালো হয়ে যাচ্ছিল। রোগীর ইতিবৃত্ত থেকে তিনি জানতে পারলেন, অলক আগেও ট্রপিক্যলে এসেছিলেন ঐ রোগ লক্ষণ নিয়ে এবং অন্য ডাক্তাররা অ্যাডিসনস ডিজিজ (Addison’s disease) বলে তার অসুখ সাব্যস্ত করেছিলেন। অন্যান্য লক্ষণাদি (যথা দুর্বলতা, কম রক্তচাপ) বিচার বিবেচনা করে ডাক্তার সাহা অন্য ডাক্তারদের নিদানের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। ভালভাবে সময় নিয়ে নিজের ঘরে দেখবার জন্য অলককে আবারও একদিন আসতে বললেন। দ্বিতীয় রোগী অলকের ভাই রতন সরকার। তার চামড়ায় কালো রং চাড়াও হাতের তালুতে দুটি গুটি অনুভব করলেন। একই রোগীর ক্ষেত্রে মেলানোসিস ও কেরাটেসিসের সমন্বয় তাঁকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলল। আর সব সম্ভাব্য রোগের কারণ বাদ দিয়ে মনে এল বহুকাল আগের ডাক্তারি বই-এ পড়া ক্রনিক আর্সেনিক বিষণের কথা।

এই রোগী দুজনকে আবার আসতে বলা হলেও তারা অনেকদিন এল না। তিনমাস পরে একদিন ফিরে এসে তারা জানাল যে, বাবার অসুখের জন্য তারা আসতে পারেনি। তার বাবাকে লিভার ক্যান্সার সন্দেহে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবশেষে নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী ডাক্তার সাহা একদিন গঙ্গাপুরে রতন, অলকদের বাড়িতে গেলেন। সেই বাড়িতে তিনি ডিফিউজ ও স্পটেড মেলানোসিস এবং স্পটেড কেরাটোসিস- এর আরও দুজন রোগীকে পেলেন। অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর সন্দেহ গেল নলকূপের জলে। তিনি জানতে পারলেন যাদের নিজস্ব টিউবওয়েল আছে, তাদের বাড়িতে এইরকম কোনও রোগলক্ষণ নেই। সরকার বাড়ির লোকেরা যে টিউবওয়েলের জল খান, সেই টিউবওয়েল থেকে অন্য যেসব বাড়িতে জল যেত সেসব বাড়ির লোকেদেরও কারও কারও দেহে মেলানোসিস ও কেরাটোসিস দেখতে পেলেন। ডঃ সাহার সন্দেহ ঘনীভূত হল, তিনি ঐসব কলের জলের স্যাম্পল হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বললেন।

1982-র সেপ্টেম্বরে বাবুলাল তরফদার (20) নামে আর একজন রোগী মুখ ছাড়া দেহের প্রায় সর্বত্র চর্মবিকৃতি নিয়ে ট্রপিক্যালের বহির্বিভাগে এল। হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে তার চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হল, যাতে পালাতে না পারে। 9 মাস তাকে ভর্তি করে বহু কষ্টে সংগ্রহ করা BLA ওষুধে চিকিত্সা করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। আর্সেনিক রোগের নতুন ওষুধগুলি (যেমন DMPS, DMSA) তখনও বাজারে আসেনি। বাবুলালের ছোটভাই নন্দলাল তরফদারকেও (15) একই রোগলক্ষণে ভর্তি করে একইরকম চিকিত্সা করেছিলেন।

টিউবওয়েলের জলের যে দশটি স্যাম্পল ডঃ সাহা গঙ্গাপুর থেকে পেলেন সেগুলো নিয়ে এ-দরজা ও-দরজা ঘোরার পর অল ইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যাণ্ড পাবলিক হেলথের (AIIHPH) এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ কে চক্রবর্তীর দ্বারস্থ হলেন জলের আর্সেনিক পরিমাপের জন্য। কলের জলে আর্সেনিক পরিমাপের প্রস্তাব শুনে সকলেই হাসলেন, অনেকে মজাও করলেন। ডাক্তার সাহাকে পাগল বিবেচনা করলেন। কিন্তু কাজটা তারা করলেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের অন্য বিভাগের অধ্যাপক কে জে নাথ আর্সেনিক পরিমাপ করিয়ে দিলেন। দিন সাতেক পরে অধ্যাপক চক্রবর্তী পাশের ট্রপিকালে একদিন দৌড়ে এলেন রিপোর্ট নিয়ে। ডঃ সাহার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। কলের জলে আর্সেনিকের মাত্রা গ্রহণযোগ্য সীমার প্রায় দশগুণ বেশি, অর্থাত 500 পিপিবির বেশি। সাহা ও চক্রবর্তী দুজনেই উল্লসিত হয়ে উঠলেন।

আর্সেনিক আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগীদের নখ ও চুলে আর্সেনিক পরিমাপের জন্য ডঃ সাহা সল্টলোকে সাহা ইনস্টিটিউটের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। অনেক টাকা লাগবে শুনে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হল। তাঁর না আছে গ্রাণ্ট, না আছে কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও উত্সাহ। তখন তিনি ট্রম্বের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে নখ ও চুলের অত্যধিক পরিমাপের জন্য স্যাম্পল পাঠালেন। তাঁরা কাজটি করে মাস তিনেক পরে রিপোর্ট পাঠালেন। নখ ও চুলে অত্যধিক আর্সেনিক। রাসায়নিক পরীক্ষার পর নিউট্রন অ্যাকটিভেশন অ্যানালিসিস দিয়ে আর্সেনিকের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হল।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading