বাংলায় আর্সেনিক


বাংলার আর্সেনিক বিষণ ইতিহাসের বৃহত্তম পরিবেশীয় বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় বর্ধিত আর্সেনিকের দরুন যেখানে হাজার হাজার মানুষের ক্যানসার ধরা পড়েছে, বহু অকালমৃত্যুও ঘটেছে, তাকে বলা হচ্ছে তুষারশৈলের চুড়া মাত্র। 1984 সালের ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা বা 1986 সালের চের্নোবিল পরমাণু চুল্লি দুর্ঘটনা বাংলার আর্সেনিক বিষণের তুলনায় অনেক কম ভয়ঙ্কর।

খরা, বন্যা, সাইক্লোন, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দেশি বিদেশি নানারকম শোষণ ও অত্যাচারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঙালি আজও টিকে আছে। স্বাধীনতার পর ভাল বাঁচবার আশায় তারা কিছুটা এগিয়েও ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত এক দুর্ভাগ্য ছদ্মবেশে তাকে আজ এক জীবন - মরণ সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। যে জলেতে প্রাণ বাঁচে, তাই গোপনে মৃত্যুকে বক্ষে ধারণ করে নির্মল শীতল পানীয় জলরূপে বাঙালিকে সংহার করে চলেছে। দেহে একবার প্রবিষ্ট 70 থেকে 180 মিলিগ্রাম মতো আর্সেনিক যেখানে প্রাণঘাতী, সেখানে টন টন আর্সেনিক জলবাহিত হয়ে ভূগর্ভ থেকে উঠে বাংলার মানুষসহ সকল জীবজন্তু, কৃষিক্ষেতে ছড়িয়ে জীবজগত ও সমগ্র পরিবেশকেই বিষাক্ত করে তুলছে। অনিবারিত আর্সেনিক দূষিত এই ভূগর্ভ জলোত্তোলন যত চলবে, বাংলা ও বাঙালি জাতিকে বাঁচানো তত বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। কম করে হলেও আজ পশ্চিমবঙ্গে অন্ততঃ 50 লক্ষ, আর বাংলাদেশে অন্তত সাড়ে তিন কোটি মানুষ 50 পিপিবির বেশি মাত্রার আর্সেনিক বিষিত জল পান-করছেন। তাতে প্রতি 100 জনে অন্তত 1 জনের মূত্রাশয় বা ফুসফুসের মারাত্মক ক্যানসার হবেই। আর্সেনিক ঘটিত ক্যানসারের সুপ্তাবস্থা প্রায় 10 বছর। সুতরাং আগামী 10 বছরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে ক্যানসারের যে মহামারী হবে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে বছরে প্রায় 50 হাজার, আর বাংলাদেশে প্রায় 350,000 অতিরিক্ত মারাত্মক ক্যানসার হবেই। বাংলাদেশে এখনই প্রতি 15 মিনিটে একজন অর্সেনিকঘটিত ক্যানসারে মারা যাচ্ছে। আগামী 10 বছরে দুই বাংলায় চিকিত্সকদের আর্সেনিকঘটিত নানারকম অসুখ-বিসুখের মোকাবিলা করতেই হবে, যা এইডস মহামারী থেকে ভয়াবহ হবে বেশি। মাতৃগর্ভে বহু শিশুর জন্মের আগেই মৃত্যু হবে, অনেক নবজাতক জন্মগত নানা বিকৃতি নিয়ে জন্মাবে, এবং অনেকেরই বুদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যসংস্থানের জন্য যে কৃষিবিপ্লব ও ভূগর্ভজলোত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আক্ষরিক অর্থেই তা পরিবেশে বিষবিপ্লব ঘটাল।

পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি আর্সেনিক দূষণ ছিল, এখনও আছে, তাদের ইতিহাস অনুধাবনীয়। কিন্তু এশিয়ার বড় বড় নদীর সুজলা সুফলা পলল ভূমিতে, যেখানে সবচেয়ে বেশি লোকের বাস, সেই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা, ইরাবতী, মেকং, লোহিত নদীর পলল ভূমিতে জলেই আর্সেনিকের আধিক্য। সরকার, প্রশাসন ও দেশের উচ্চশ্রেণীর মানুষজন দুই বাংলাতেই এরকম একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে এখনও যথেষ্ট উদাসীন। ব্রিটেনের বিখ্যাত নেচার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে (11 অক্টোবর, 2001) লেখা হয়েছে – “(সমস্যাটিকে স্বীকার না করা ও সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায়) পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের সরকারি কর্তাব্যক্তিদের হাত ছিল; বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের চোখের সামনে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আরও একটি ভয়ঙ্কর সঙ্কটের দায়িত্ব এড়াতে তারা ব্যগ্র। 1980 এর দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁরা স্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের সতর্কতায় আমল দেননি। আবার পাশ্চাত্য বিজ্ঞানী ও তাঁদের ভারতীয় সহকর্মীরা উপমহাদেশে নিজেদের জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরা এইরকম ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংবাদ কি আরও আগে প্রকাশ করতে পারতেন না? পাশ্চাত্য ঔদভূতাত্ত্বিকদেরও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। সরকারি কর্তাব্যক্তি ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমস্যা স্বীকার কিছুটা সহজ হবে, তাতে আরও জীবনহানি কমাতে সকলে একযোগে কাজ করতে পারেন।”

সরকার ও প্রশাসনকে সক্রিয় করতে প্রয়োজন জনসচেতনতা, অর্থনীতি, গণআন্দোলন। তার জন্য আবার প্রয়োজন সমস্যাটিকে সামগ্রিকভাবে বোঝা। তাই ইতিহাস, ভূগোল থেকে সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাসায়নবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান থেকে ভূতত্ত্ব, প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশীয় আর্সেনিকের আলোচনায় এসে যায়।

বাংলায় আর্সেনিক বিষণ


দুই বাংলার আর্সেনিক চিত্র আজ ভয়াবহ। লক্ষ লক্ষ মানুষের দেহে আর্সেনিকের রোগ লক্ষণ সুস্পষ্ট। কষ্ট পাচ্ছেন তাঁরাও যাদের দেহে রোগ লক্ষণ এখনও স্পষ্ট নয়, বা দেহের ভিতরে বা বাইরে এখনও ক্যানসার দেখা যায় নি। পুরুষের কর্মশক্তি কমছে, দেহে রোগলক্ষণ বেরোনোয় মেয়েদের বিয়েরও অসুবিধা হচ্ছে, সংসারও বিনষ্ট হচ্ছে বহু স্থানে। গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষরাই ক্ষতিগ্রস্ত বেশি। কারণ, গ্রামের পরিবেশও যেমন দূষিত, তেমনি দারিদ্রের জন্য তাঁদের দেহে পুষ্টিও সন্তোষজনক নয়। আর শহরাঞ্চলের মানুষের মতো তারা শোধিত নিরাপদ পানীয় জল না পেয়ে আর্সেনিক দূষিত জলপান করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপরন্তু পরিবেশে প্রচুর ছড়ানো কীটনাশক অবশেষের সঙ্গে পরিবেশীয় আর্সেনিক সহযোগী অতিক্রিয়া (synergistic effects) করে মানুষের অসুস্থতা বাড়াচ্ছে। আর্সেনিকের সঙ্গে বিড়ি - সিগরেটের সহযোগী অতিক্রিয়ায় ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টি হয়। স্ত্রীলোকেদের বর্ধিত গর্ভপাতে, টেরাটোজেনিক বা ভ্রুণের বিকৃতি সমন্বিত কম ওজনের , কম বুদ্ধির শিশুজন্মে স্বল্পমাত্রার পরিবেশীয় আর্সেনিকের ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত। দুই বাংলার আর্সেনক বিষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ইওরোপ আমেরিকার বিজ্ঞান সংস্থাসমূহের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাংলার আর্সেনিক বিষণ ইতিহাসের বৃহত্তম পরিবেশীয় বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় বর্ধিত আর্সেনিকের দরুন যেখানে হাজার হাজার মানুষের ক্যানসার ধরা পড়েছে, বহু অকালমৃত্যুও ঘটেছে, তাকে বলা হচ্ছে তুষারশৈলের চুড়া মাত্র। 1984 সালের ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা বা 1986 সালের চের্নোবিল পরমাণু চুল্লি দুর্ঘটনা বাংলার আর্সেনিক বিষণের তুলনায় অনেক কম ভয়ঙ্কর। প্রাচীন সুমেরিয়া, ব্যবিলনীয় ও হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ সেচের ফলে ভূগর্ভ থেকে ওঠা লবণ চাষের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়া যা কালক্রমে জমির উত্পাদিকা শক্তি নষ্ট করে দেয়। ফলে ইউফ্রেটিস - টাইগ্রিসের দোয়াব অঞ্চলের উন্নত প্রাচীন সভ্যতা বিনষ্ট হয়ে যায় । লবণ তো আর্সেনিকের মতো বিষ নয়। আর্সেনিক জমির উত্পাদিকা শক্তিও যেমন হ্রাস করে, তেমনি আবার মানুষ সহ সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদেরও ক্ষতি করে, অসুস্থ করে।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading