বিষ হল ওষুধ আশ্চর্য রূপান্তরের অর্থনীতি-রাজনীতি
ফ্লোরাইড একটি পদার্থ, যা অবিনশ্বর। তার সৃষ্টিও নেই, বিনাশও নেই। আমেরিকার ফসফেট শিল্পেও আছে প্রকাণ্ড রকম ফ্লোরাইড বর্জ্য নিষ্পত্তির সমস্যা। বিভিন্ন শিল্পে ও পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় ফ্লোরাইডের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে কারখানার ভেতর ও বাইরের পরিবেশে ফ্লোরাইড বিষণের সম্ভাবনা বাড়ছিল। ফ্লোরাইড বিষণের রির্পোটও আসছিল। ইউরোপে কাজ রোহেলমের মতো বিজ্ঞানীর গবেষণা ফ্লোরাইড বিষণের ফলে অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিসের ভয়াবহ চিত্র উন্মেচিত করেছিল।সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধারম্ভ অবধি যে ফ্লোরাইড সর্বত্র বিষ হিসেবে পরিগণিত ছিল, সেটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধশেষে 1945 সাল থেকে, সীমিত মানুষের পক্ষে হিতকারী হয়ে গেল। এক শ্রেণির বিজ্ঞানীর বৌদ্ধিক সমর্থনও পেল। সেই রহস্যর কিনারা শেষ পর্যন্ত হয়েছে 1994 সালের পরে, বিল ক্লিণ্টিনের আমলে গোপন সরকারি নথিপত্র প্রকাশ্যে আসার ও কয়েকজন গবেষকের অনুসন্ধানের পর। যা জানা গিয়েছে তা একটি জমজমাট থ্রিলার ছবির বিষয়বস্তু হতে পারে। কিন্তু রহস্যের সমাধান বলার আগে শিল্পীয় ফ্লোরাইড দূষণ সম্পর্ক দু-একটি কথা।
শিল্পীয় ফ্লোরাইড দূষণ
ফ্লোরাইড শুধু পানীয় জলের মাধ্যমেই মানুষের ক্ষতি করে না। কয়লাতেও অল্প মাত্রায় ফ্লোরাইড থাকে। কোনো কোনো এলাকায় কয়লায় ফ্লোরাইডের মাত্রা অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি থাকে। প্রচুর কয়লা পুড়লে সেই ফ্লোরাইড ব্যাপক বায়ু দূষণের কারণ হয়। ফসফেট শিল্প ফ্লোরাইড দূষণের বড়ো উত্স। ফসফেট সারে দূষক ফ্লোরাইড থাকে। এই রাসায়নিক শিল্পের কাঁচা মাল ক্যালশিয়াম হাইড্রক্সিফসফেট বা অ্যাপেটাইটে প্রায় তিন শতাংশ ( 300 % )-এর মতো ফ্লোরঅ্যাপেটাইট (fluorapatite) থাকে। এই সার কারখানা থেকে নির্গত ফ্লোরাইড বায়ু দূষণ করে। কৃষিক্ষেত্রে প্রদত্ত ফসফেট সার জমিতে ফ্লোরাইড দূষণ ছড়ায়।
অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান আকরিক হল বক্সাইট। এর থেকে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশনের জন্য লাগে ক্রায়োলাইট, যা হল সোডিয়াম অ্যালুমিনিয়াম ফ্লোরাইড। এটি আসে গ্রিনল্যন্ড থেকে। আর পরমাণু জ্বালানির জন্য প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের মধ্যে ইউরেনিয়াম - 238 ও ইউরেনিয়াম - 235 কে আলাদা করতে বিপুল পরিমাণে ফ্লোরিন এবং / অথবা হাইড্রজেন ফ্লোরাইড লাগে। প্রথমে ইউরেনিয়ামের সঙ্গে ফ্লোরিনকে রাসায়নিকভাবে যুক্ত করে তৈরি হয় ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড। এরপর গ্যাসীয় ডিফিশন বা সেণ্ট্রিফিউজ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইউরেনিয়াম - 235 সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইডকে আলাদা করা হয়। আর এটাই হল পরমাণু শিল্পের জ্বালানি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বিভিন্ন শিল্পে ফ্লোরাইডের ব্যবহার রয়েছে। তাই আধুনিক শিল্প নির্ভর সব দেশেই শিল্পীয় ফ্লোরাইড দূষণের কম বেশি সমস্যা রয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শিল্পীয় ফ্লোরাইড দূষণের সমস্যাটি অনেক বেশি প্রবল। কারণ বৃহত্তম শিল্পীয় ফ্লোরাইড দূষক হল অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশন শিল্প ও নিউক্লিয়ার ফুয়েল প্রস্তুতি শিল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি হল ওই দুটি শিল্প। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফসফেট শিল্পও পৃথিবীর অন্যতম বৃহত।
বর্জ্য নিষ্পত্তি সমস্যা ও পরিবেশীয় উদ্বেগ নিরসনের অভিনব পদ্ধতি -
উপরোক্ত দুই শিল্পের বৃহত্তম সমস্যা হল বিপুল পরিমাণে উত্পন্ন বিষাক্ত ফ্লোরাইড বর্জ্য নিষ্পত্তি। ফ্লোরাইড একটি পদার্থ, যা অবিনশ্বর। তার সৃষ্টিও নেই, বিনাশও নেই। আমেরিকার ফসফেট শিল্পেও আছে প্রকাণ্ড রকম ফ্লোরাইড বর্জ্য নিষ্পত্তির সমস্যা। বিভিন্ন শিল্পে ও পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় ফ্লোরাইডের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে কারখানার ভেতর ও বাইরের পরিবেশে ফ্লোরাইড বিষণের সম্ভাবনা বাড়ছিল। ফ্লোরাইড বিষণের রির্পোটও আসছিল। ইউরোপে কাজ রোহেলমের মতো বিজ্ঞানীর গবেষণা ফ্লোরাইড বিষণের ফলে অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিসের ভয়াবহ চিত্র উন্মেচিত করেছিল।
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ও কর্পোরেট দুনিয়ার যোগসাজসে দুটি জিনিস করা হল।
1. বর্জ্য নিষ্পত্তি সমস্যার সমাধানের এক অপূর্ব পদ্ধতির উদ্ভাবন হল – ফ্লোরাইড পানীয় জলে মিশিয় দাও। সব ফ্লোরাইড (প্রায় 99 শতাংশ ) মানুষের হাড়ে জমবে। মৃত্যুর পর সব ফ্লোরাইড কবরে চির সমাহিত থাকবে।
2. ফ্লোরাইড ভীতি কাটানোর জন্য ও বিষাক্ত শিল্প বর্জ্য নিষ্পত্তির অভিনব প্রযুক্তি প্রচলনের জন্য আমেরিকা সহ পৃথিবীর জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে হয়েছে, বিচারকেও বিকৃত করতে হয়েছে । পানীয় জলের সঙ্গে ফ্লোরাইডকে টুথপেস্ট ও শিশুদের ভিটামিন ট্যাবলেটে দিয়ে ফ্লোরাইডের পূর্বেকার ভীতি কাটিয়ে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যকে চুলোয় দিয়ে তৈরি হয়েছে ভুরি ভুরি মিথ্যা তথ্য বিতরণের (disinformation) রাষ্ট্রীয় - কর্পোরেট ব্যবস্থা।না, এটা কোনো গাঁজাখুরি চক্রান্ত তত্ত্ব নয়। রীতিমতো দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে, বৈজ্ঞানিক - ঐতিহাসিক খানতল্লাশি চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পনীতি, চিকিত্সা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যনীতির একটি অজানা অন্ধকার অধ্যায়কে দিনের আলোয় নিয়ে আসা।
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: society for direct initiative for social and health action (disha) 20 / 4, Shil Lane, Kolkata – 7000 015, written by Prof. Manindra Narayan Majumder