ভূগোলে আর্সেনিক


প্রতিকূল পরিবেশে মনুষ্য বসতি সম্ভব নয়


পৃথিবীর সর্বত্র সব সময় মানুষ বাস করে না, করতে পারে না l বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝে যায় কোথায় থাকা ভাল আর কোথায় ভাল না l জনপদ গ্রাম নগর শস্যক্ষেত্র শিল্প-কর্ম সভ্যতা-সংস্কৃতি সেখানেই গড়ে ওঠে, যেখানে পরিবেশ অনুকুল আর উর্বর জমি, সুপেয় জল, গাছপালা, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি সংলগ্ন স্থানে, আবার যেখানকার জলে প্রচুর স্বাস্থ্যহানিকর খনিজ তেল, অভ্র, ফ্লোরিন, আর্সেনিক বা মাটির কাছাকাছি ইউরোনিয়াম, থোরিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকে, সে সব জায়গা মানুষ এড়িয়ে চলত যদিও আজকের দিনের মতো বৈজ্ঞানিক কারণ মানুষ জানত না l অবশ্য আজকাল এরকম খারাপ পরিবেশের কোনও কোনও জায়গাতেও মানুষ থাকতে বাধ্য হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা নিবারণ- অসাধ্য সামাজিক বৈষম্য বা অত্যাচারের শিকার হয়ে l

সেচের জলবাহিত লবণে ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস দোয়াব অঞ্চলের সুমেরিয়া, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পতন হয়েছিল l চাষজমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জলবায়ু ও নদীপথ পরিবর্তনের ফলে সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়েছিলl 1976 সালে এক কেজি মতো বিষাক্ত ডাইঅকসিন গ্যাস লিক করে যাওয়াতে ইতালির সেভেসো শহর থেকে এবং পরমাণু চুল্লি দুর্ঘটনার পর চের্নোবিল থেকে 1986 সালে লোকজনকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয় l উন্নত দেশ হলে ভূপালের ‘মিক’ – গ্যাস দুর্ঘটনার পর মনুষ্য বাসের অনুপযুক্ত বিবেচনায় শহরটি পরিত্যক্ত হত l বর্তমানে যে হারে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক ছড়াচ্ছে, তাতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকার বিরাট অঞ্চল, উন্নত দেশ হলে হয়তো মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত বিবেচিত হত l বেশি সম্ভাবনা, আগে থেকেই উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এত আর্সেনিক যুক্ত ভূগর্ভজল হতই না, অথবা আর্সেনিক নিরাকরণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হত l

জীব অলভ্য আর্সেনিক নির্দোষ


কোনও অঞ্চলের শিলা বা মৃত্তিকায় আর্সেনিক বেশি থাকলেই তা ক্ষতির কারণ হয় না, যদি না তা সহজে জলে আসে বা জীবলভ্য হয় ও খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে l পরিবেশের বিভিন্ন অংশের আর্সেনিকের মাত্রা আর জীবদেহে আর্সেনিক আগমনের মাত্রার সরাসরি সম্পর্ক ক্ষীণ l আর্সেনিকের উত্স, তার রাসায়নিক প্রজাতি ও ভৌতিক অবস্থান নির্ধারণ করে কতটা জলে আসবে বা জীবলভ্য হবে এবং মানুষ সহ অন্যান্য জীবে অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি করবে l এই মানদণ্ড বিচার করেই আর্সেনিকের ভূগোল তৈরি হওয়া উচিত l

আর্সেনিক “হটস্পট”


আর্সেনিক সনাক্তকরণ ও পরিমাপের পদ্ধতি যখন অনুদঘাটিত ছিল, তখন অজ্ঞাতসারেই মানুষ সহ অন্যান্য জীবসমূহ কম বেশি আর্সেনিক আক্রান্ত হয়েছে l যেমন আর্জেণ্টিনা বা চিলিতে l 1960-এর দশক থেকে খুব কম মাত্রায় আর্সেনিককেও অল্প খরচে অল্প সময়ে পরিমাপ যখন সম্ভব হল, তখন দেখা গেল পৃথিবীতে আর্সেনিকের কতকগুলি “হটস্পট” বা “তপ্তাঞ্চল” আছে l অনুসন্ধান পদ্ধতি যত সহজ ও সুলভ হয়েছে, অনুসন্ধান ক্ষেত্রও তত বেড়েছে l নতুন নতুন হটস্পটও আবিষ্কার হয়েছে l পৃথিবীর আর্সেনিক মানচিত্রে যেসব দেশ এখনো আসে নি (যেমন রাশিয়া), হয় সেখানে অনুসন্ধান হয় নি, অথবা পরীক্ষা / সমীক্ষার ফলাফল অপ্রকাশিত থেকেছে l

আর্সেনিকের উত্স
প্রাকৃতিক উত্সাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য


- আগ্নেয়গিরি, উষ্ণপ্রস্রবণ, গিজার প্রভৃতি ভূ-তাপীয় (geothermal) উত্স
- ক্ষয়ীভূত আর্সেনিক আকরিক
- ভূগর্ভ জল
- জীবাণু ক্রিয়াকর্ম উদ্ভুত

মনুষ্যসৃষ্ট আর্সেনিক উত্সগুলির মধ্যে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য


- খনিজ উত্তোলন ও তামা, সীসা, টিন, দস্তা, সোনা – এইসব লৌহেতর ধাতু নিষ্কাশন
- আর্সেনিক – যুক্ত ভূগর্ভ জলোত্তোলন
- আর্সেনিক সমৃদ্ধ কয়লা দহন, ( তাপবিদ্যুত কেন্দ্র বা গৃহস্থালির কাজে )
- আর্সেনিক ঘটিত পেস্টিসাইড প্রস্ত্তত ও ব্যবহার
- আর্সেনিক ঘটিত ঔষধ ব্যবহার, যেমন, ইওরোপ আমেরিকায় অতীতে বহু ব্যবহৃত ফাউলারস সলিউশন, স্যালভারসন প্রভৃতি ও চিন এবং ভারতে আগে ব্যবহৃত কিছু সনাতন চিকিত্সার ওষুধ
- সেমি কণ্ডাকটার প্রযুক্তিতে

দূষণের বিভিন্ন মাত্রাঞ্চল


উত্স বিবেচনা নিরপেক্ষ ভাবে পৃথিবীর আর্সেনিক অঞ্চলগুলিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় l

উচ্চমাত্রাঞ্চল


এইসব অঞ্চলে মনুষ্য দেহে দৈনিক এক থেকে কয়েক মিলিগ্রাম আর্সেনিক প্রবেশ করে ও তার ফলে সংক্রমণের নানা লক্ষণ ফুটে ওঠে, বা আভ্যন্তরীণ ক্যান্সার ধরা পড়ে l যেমন বাংলাদেশে, পশ্চিমবাংলা, অন্তর্মোঙ্গালিয়া, তাইওয়ান l

মাঝারি মাত্রাঞ্চল


এইসব অঞ্চলে দৈনিক 100µg থেকে 1 (এক) মিলিগ্রাম পর্যন্ত মনুষ্যদেহে প্রবেশ করে l এইসব অঞ্চলে আর্সেনিকের বহির্লক্ষণ দেখা যায় না, জানপদিক সমীক্ষায় ধরা পড়ে l যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের কিছু অঞ্চল, কানাডা, হাঙ্গেরি, কলকাতা ও ঢাকা শহর l

হ্রস্বমাত্রাঞ্চল


এইসব অঞ্চলে দৈনিক 100 µg বা তার কম আর্সেনিক মনুষ্যদেহে প্রবেশ করে, যার দীর্ঘমেয়াদি কুফল আজও অজ্ঞাত l যেমন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল l

এইরকম শ্রেণীবিভাগ সত্ত্বেও আমরা সুপরিচিত ভূগোলের ভিত্তিতেই পৃথিবীর আর্সেনিক-পীড়িত অঞ্চলগুলির পরিচয় দেবার চেষ্টা করব l

এশিয়ার আর্সেনিক অঞ্চল সমূহের মানচিত্র


এশিয়ার আর্সেনিক তপ্তাঞ্চলগুলি সাম্প্রতিক আবিষ্কৃতি কিন্তু সবিশেষে গুরুত্বপূর্ণ l এশিয়ার বড় বড় উর্বর নদী উপত্যকায় জনবসতি অত্যধিক হওয়ায় জল বাহিত আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষজন অনেক বেশি l

 

এক নজরে এশিয়ার আর্সেনিক অঞ্চল সমূহ

আক্রান্ত অঞ্চল

আক্রান্ত ভূখণ্ডের

আয়তন(বর্গ কি.মি.)

ঝুঁকিতে থাকা

জন সংখ্যা

জলে আর্সেনিক

মাত্রার বিস্তার (µg /L)

উত্স প্রকৃতি

 

বাংলাদেশ

120,000

35 মিলিয়ন

1-2300

কোয়াটার্নারি পলি -দ্বীপীয় পালল

পশ্চিমবাংলা, ভারত অন্তর্মোঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং, সাংসি, ইউনান, চিন তাইওয়ান

23,000

 

5 মিলিয়ন

 

10-3200

 

ভিয়েতনাম

নেপালের তরাই অঞ্চল

রন পিরুন, থাইল্যাণ্ড

68,000

5.6 মিলিয়ন

40-8800

কোয়ার্টার্নারি পলি হ্রদীয় পালল-সেডিমেণ্ট বদ্বীপীয় পালল

 

6,000

10,000

10-1800

 

(জলের বিকল্প ব্যবস্থায় এই সংখ্যা কমেছে)

1,000

>1 মিলিয়ন

1-3100

30,000

550,000

10-340

100

15,000

1-5000

অতীতের টিন খনিজোত্তোলন অঞ্চল-পলি,পর্বতের ক্ষয়ীভূত সঞ্চিত অধঃক্ষেপ

 

सम्पर्क


মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading