একটি পুকুরের কাহিনী


অদ্ভুত ঘটনা l পাশাপশি গ্রাম বিজয়ডি l সেখানে কিন্তু দুর্দশা এতদূর গড়ায়নি l কারণ সেখানে রয়েছে পূর্বপুরুষের একটা বড় পুকুর l কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই পুকুরটিকে যেটি একটি গ্রামকে জীবন দান করেছে l

একটি পুকুরের কাহিনী আবার একটি না-পুকুরেরও কাহিনী l একটি মেয়ের জীবন কাহিনীতে আকৃষ্ট হয়ে আমি ২০০১-এর ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর গ্রামে যাই l গ্রামের নাম ডাকাকেন্দু, জেলা পুরুলিয়া l এখানে সময়টা উল্লেখযোগ্য, ফেব্রুয়ারী মাস অর্থাত চাষী তাঁর সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলেছেন l এতেই চলবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত l কেননা বোরো চাষ পুরুলিয়াতে হয় না বললেই চলে, এই অঞ্চলে তো নয়ই l কিন্তু আগামী ডিসেম্বর তো অনেক দূর, এই ফেব্রুয়ারীতেই ডাকাকেন্দু জনহীন l গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় আশি ভাগ মানুষ ১৯৯৮, ৯৯ ও ২০০০-এর খরায় করো ঘরে খাবার নেই এক দানাও l পর পর ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে l যাঁদের ঘরে দরজাও নেই তাঁরা দুয়ারে কাঁটা গেঁথে রেখে চলে গেছেন l ঐ জনহীন প্রান্তরে কোথাও বসে রয়েছেন একজন অন্ধ বৃদ্ধ, কোথাও বা পোলিওতে দু-পা অক্ষম হয়ে যাওয়া যুবক l গ্রামে কয়েক ঘর চাকুরিজীবি রয়েছেন l আর ওরই মধ্যে যাঁদের একটু চাষ হয়েছে, তাঁদেরই ভরসায় এই পঙ্গু মানুষগুলোকে ফেলে সকলে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন কাজের সন্ধানে l সাধারণভাবেই পুরুলিয়ার কিছু মানুষ বছরে দুবার(আমন ও বোরো) চাষের কাজে বর্ধমান চলে যানl যখন তাঁরা আমন ধান কাটতে যান, তখন পৌষ সংক্রান্তির আগে গ্রামে ফেরেন l কেননা পুরুলিয়ার গ্রাম্য জীবনে প্রধান উত্সব হল টুসু l এবার তারা টুসুতেও ফেরেননি l উত্সব হবে কিভাবে l সাধারণ দিনের খাহারও তো ঘরে নেই l

অদ্ভুত ঘটনা l পাশাপশি গ্রাম বিজয়ডি l সেখানে কিন্তু দুর্দশা এতদূর গড়ায়নি l কারণ সেখানে রয়েছে পূর্বপুরুষের একটা বড় পুকুর l ফিরে আসি একটি পুকুর ও দুটি গ্রামের পরিস্থিতির অনুভব নিয়ে l কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই পুকুরটিকে যেটি একটি গ্রামকে জীবন দান করেছে l পুরো ঘটনাটা বলি শ্যাম অবিনাশজীকে l তিনি আমার হাতে দেন অনুপম মিশ্রজীর লেখা বই ‘আজ ভি খরে হ্যায় তালাব’l এর আগেও তিনি পুরুলিয়ার সাহেব বাঁধ প্রসঙ্গে এই বইটির কথা বলেছিলেন l পড়া হয়ে ওঠেনি l এবার আর অপেক্ষা করি না l পড়ে ফেলি l অভিভূত হই l অনুভব করি বইটির প্রয়োজনীয়তা l আর মনে মনে অনুপমজীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আওড়াই ‘আজও পুকুরই খাঁটি’, ‘আজও পুকুর আমাদের’ l

অনুপমজী তাঁর বইয়ে লিখেই দিয়েছেন, ‘এই বইয়ের বিষয়বস্তু যেকোনও ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে’ l তবুও অনুবাদ করার বাসনা জানিয়ে চিঠি লিখি l দ্রুত উত্তর পাই l বই পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম, চিঠি পড়ে মুগ্ধ হলাম l অনুপমজী বলেন- ‘জলের কাজ ভালবাসার কাজ’, আর তাঁর এই মনোভাব থেকেই বইটি একটি আন্দোলনের ভূমিকা নিতে পেরেছে l ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুবাদ তো হয়েইছে, পুকুর সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় l বর্তমান জল সমস্যায় অন্যতম উত্কৃষ্ট উপাদান বোধ হয় পুকুর-ই l যদিও এখন পুকুর বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে এই দৃশ্য সুলভ, পুকুর খোঁড়া হচ্ছে এই দৃশ্যের তুলনায় l অথচ ভারতে হাজার হাজার বছর এই পুকুরই সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে বৃষ্টর জল ধরে রেখে l ভূগর্ভস্থ জলস্তরও বজায় রেখেছিল এই পুকুর-ই l এই ব্যবস্থা ছিল আমাদের সমাজসিদ্ধ ও স্বয়ংসিদ্ধ l অনুপমজীর বইয়ে এই সমাজের সৌরভ ছড়িয়ে রয়েছে পাতায় পাতায় l ভাষা বৈশিষ্ট্যের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য l

অনুপুমজীর সহৃদয় অকৃপন সহযোগিতা ছাড়াও এই অনুবাদে সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছি অনেকের l বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করা মাত্রই এঁকে দিয়েছেন প্রচ্ছদ l খাঁটি সোনায় তৈরী পুকুরের কাহিনীর, খাঁটি সোনায় তৈরী এই প্রচ্ছদ সত্যি এক পরশ l এই প্রাপ্তি আমাদের সকলের l বর্ষীয়ান ভূগোলবিদ্ অধ্যাপক সুনীল কুমার মুন্সী শত ব্যস্ততার মধ্যেও লিখে দিয়েছেন প্রস্তাবনা l সুনীল কুমার মুন্সীর উদারতা ও সহযোগিতা আলাদাভাবে উল্লেখের দাবী রাখে l পাঁচুগোপাল দত্তর পুন্যি পুকুরের আলপনায় ফোল্ডার তৈরী করিয়ে আমরা অনুবাদের পথ চলা শুরু করি l প্রুফ দেখায় সহযোগিতা করেছেন অদ্রীশ বিশ্বাস ও সুরজিত সুলেখাপুত্র l যোগাযোগ প্রচার ও অনবরত মানসিক উত্সাহ দিয়ে কাজের গতি অব্যাহত রেখেছিলেন সমর বাগচী l বর্ষীয়ান এই মানুষটির সারল্য আমায় মুগ্ধ করেছে l শ্যাম অবিনাশ সম্পর্কে একটি কথাই বলা যায়, তিনি ছাড়া এই অনুবাদ আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না l এ ছাড়াও সহযোগিতা করেছেন সুবোধ বসু রায়, সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ, নির্মল হালদার, রাউল পুষ্প, সুনীল মাহাত, জয়া মিত্র, মণিদীপা, সীমা বাগ l

অধ্যায়ের শেষে পাদটীকাগুলি মূল বইয়ে নেই l বাঙ্গালী ও বাংলার পাঠকদের সুবিধার্থে এই সংযোজন করা হল l আপনার এলাকার পুকুরের সঙ্গে যদি এই বইয়ের কোন প্রকার সম্পর্ক আছে বলে আপনি মনে করেন অথবা আপনি আপনার এলাকার পুকুর নিয়ে কিছু ভেবেছেন যা বলতে চান তা আমাদের জানালে ভালো লাগবে l

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading