গ্লোবাল ফোরাম


50,000 উচ্চ কঠস্বর রাজপথের মিছিল থেকে জানতে চাইছে তাদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে পরিবেশ সম্মেলনের সার্থকতা কি? তারা ধিক্কার জানাচ্ছে আমেরিকাকে, বিশ্ব-ব্যাংককে। সরকারী সম্মেলন নিয়ে প্রচন্ড অসন্তোষ Global Forum -এর প্রতিনিধিদের মধ্যে। তাঁরা বলেছেন- লক্ষ রয়ে গেল দূরে সুযোগ গেল হারিয়ে।

বিশ্বের এ যাবত অনুষ্ঠিত বৃহত্তম বেসরকারী সংগঠনগুলির সম্মেলন Global Forum- এ যোগ দিয়েছে 2000 এর অধিক সংস্থার প্রতিনিধি। বিশাল তাদের বৈচিত্র্য। আনন্দমার্গী ছিল। ব্রহ্মকুমারী ছিল। ছিল আমাজন অববাহিকার আদিবাসীরা। ছিল নিরামিষ ভোজীদের সংগঠন। ছিল নব্য ম্যালথস মতবাদীরা। ছিল নারীমুক্তি নিয়ে সংগ্রামে রত সংগঠন। ছিল শিশু-কল্যাণ নিয়ে চিন্তা করে এমন সংস্থা। আরো কত! বৈচিত্র্যের নেই শেষ। আমাদের দেশ থেকে যে সব সংগঠন গিয়েছিল তার মধ্যে একটি হচ্ছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী চিমন ভাই প্যাটেলের মদত পুষ্ট। নেতৃত্ব দিতে উপস্থিত ছিলেন গুজরাট রাজ্য সরকারের বড় আমলা জি. সি. প্যাটেল। আমলা মহাশেয়র সাথে গিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর গৃহিণী। এঁদের কাজ ছিল Global Forum- এর কাছে বুঝিয়ে বলা কেন নর্মদা প্রকল্প সঠিক। এখানে যেমন কড়া ভাষণ তেমনি আছে মিঠে সংগীতের মুর্চ্ছনা। আছে কৃত্রিম জীবন বৃক্ষ বিরাট বিরাট গাছের পাতার কাট-আটটে উত্কীর্ণ – পৃথিবীর সন্তান আমরা। গ্রহটাকে হবে বাঁচাতে। বিরাট এক ক্রশ পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক নিঃসঙ্গী মানুষ। বিপন্ন ধরণীর প্রতীক যেন।

উত্তরের সংগঠনগুলি দেখা গেল অনেক সংগঠিত। নিজের নিজের দেশের সরকারের সাথে সাক্ষাত করে কাজ হাসিল করতে চেষ্টা করছেন। প্রত্যহ কাগজে বিবৃতি দিচ্ছেন। তুলনায় দক্ষিণের সংগঠনগুলি কিছুটা ম্লান। জাপানী সংগঠনগুলির মত আমাদের দেশের সংগঠনগুলি ভাবছে আরো প্রস্তুতি নিয়ে এলে ভাল হত। ভার্জিনিয়ার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে এসেছেন রীতা ক্রীজেক। কৃষি উন্নয়ন তাঁর সংগঠনের বিষয়। নানা সংগঠনের সাথে আলোচনা চালাচ্ছেন তাঁর বিষয় নিয়ে। তাঁর বক্তব্য – কৃষি প্রন্নায়নের ক্ষেত্র রিও সেণ্ট্রো থেকে শেখার কিছু নেই, আছে আমাদের এই Global Forum এ বরং। প্রচন্ড বাস্ততা মহিলা শিবিরে। তাঁরাও বুঝেছেন একথা যে UNCED -এর Eco -92র বাগড়শ্বর তাঁদের কোন কাজে আসবে না। খোদ ওয়াশিংটেন অফ কালার। তিনি বললেন – ওঁদের (আমেরিকার অন্যান্য সংগঠনের) নীতি আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পক্ষে ক্ষতিকর।

হঠাত সবাইকে অবাক করে দিয়ে Global Forum-এ উপস্থিত হলেন মার্কিন প্রেসিডেণ্ট জর্জ বুশ। দীর্ঘ সময় কাটালেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে। হৃত গর্বের পুনরুদ্ধারের চেষ্টায়। কিন্তু সংগঠনগুলি তার উপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হল।

এর আগে এসেছিলেন এ্যাল গোরে। সঙ্গে এসেছেন মার্কিন সেনেটররা। Global Forum-এ দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইলেন মার্কিন মুলুকের আদিবাসীদের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য। স্বীকার করলেন আদিম সংস্কৃতি থেকে কিছু শিক্ষণীয় আছে।

Global Forum -এ এলেন পূর্বতন সোবিয়েত প্রধান মিথাইল গর্বাচভ। তিনি সম্মতি দিয়েছেন International Green Cross নামের সংগঠনের সভাপতি হতে। এই সংগঠন নানাভাবে প্রকৃতি-পরিবেশ বাঁচাতে আগ্রহী। তাঁরা তৈরী করবেন Shock Troop বা আঘাত বাহিনী, যার কাজ হবে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবেশগত দুর্ঘটনার ফলে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

Global Forum -এ মজার এক ঘটনা ঘটে গেল দশই জুন। বসুন্ধরা সম্মেলনে নিকৃষ্টতম কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া হল। পুরস্কার পেলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যদি আরব এবং জন মেজরের দেশ। ওদিক থরথর করে কেঁপে উঠছে ব্রাজিলের রাজধানী। 50,000 উচ্চ কঠস্বর রাজপথের মিছিল থেকে জানতে চাইছে তাদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে পরিবেশ সম্মেলনের সার্থকতা কি? তারা ধিক্কার জানাচ্ছে আমেরিকাকে, বিশ্ব-ব্যাংককে। সরকারী সম্মেলন নিয়ে প্রচন্ড অসন্তোষ Global Forum -এর প্রতিনিধিদের মধ্যে। তাঁরা বলেছেন-

লক্ষ রয়ে গেল দূরে
সুযোগ গেল হারিয়ে।

উত্তরের সঙ্গে দাক্ষিণের মন Global Forum এও ঘটেছে। এখানে এনে অনেক পর্য্যবেক্ষক লক্ষ্য করেছেন সংগঠনগুলির এক মহাদেশগত পার্থক্য, কর্মতত্পতার ক্ষেত্রে। তাঁরা বলেছেন - Global Forum-এ এসে

আফ্রিকার মানুষেরা দেখেছেন
এশিয়ার মানুষেরা শুনেছেন
ল্যাটিন আমেরিকার মানুষেরা কথা বলেছেন।
ইয়োরোপ আমেরিকার মানুষেরা কথা বলেছেন।

অরণ্য এটি খুব সরলীকৃত এক রসিকতা। যাই হোক এটা দাবী করা হয়েছে যে নির্দিষ্ট ফলাফল চাক্ষুষ করা না গেলেও অগ্রগতি হয়েছে এবং তা যথেষ্ট।

অরণ্য Global Forum এর প্রধান উদ্যোক্তা Warren Lindar বলেন- বেসরকারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা যেন নিকৃষ্টতর জীব। রাষ্ট্র-প্রধানদের নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। তবে তা নিয়ে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি হয়েছে। 35000 ব্রাজিল পুলিশ আর 100 জন রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তাকর্মী মিলে বাস্তবিক দুর্ভেদ্য দূর্গের মধ্যে রেখেছিল রাষ্ট্রনেতাদের। দিনের আলোর মত এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছে, ফ্রেমিগো পার্কের চিন্তাধারা রিওসেণ্ট্রোর নিরাপত্তার প্রাচীন লঙ্ঘন করতে পারেনি। তবে একটি বিষয় স্বীকার করতে হবে. Global Forum-এ মহিলাদের বিরাট এক জয় হয়েছে। সরকারী সম্মেলনে গ্রহণ করা হয়েছে এজেন্ডা 21। সেই কর্মসূচীর 24 নং অধ্যায় নারী উন্নয়ন কেন্দ্রিক। এটি নিয়ে Global Forum-এ প্রচন্ড বিতর্ক হয় এবং নারী-প্রতিনিধিদের জয়ের সূচনা হয়। কর্মসূচী-21 সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তাঁদের প্রস্তাবিত নতুন 6 দফা কর্মসূচীতে। ওগুলি মূল কর্মসূচীতে আগে ছিল না। এগুলি সংক্ষেপে এই রকম।

1) দক্ষিণের ঋণ উত্তরকে মকুর করতে হবে। এতে যেন দক্ষিণের দরিদ্র-সমাজ উপকৃত হয়।
2) নারীকল্যাণ ও পরিবেশ উন্নয়নের জন্য যে ঋণ বিশ্বব্যাংকে ও আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার দেবে, তাতে কোন শর্ত আরোপ করা চলবে না।
3) মহাকাশকে সামরিকক্ষেত্রের বাইরে রাখতে হবে। রাসায়নিক, জৈব ও পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা ও প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। বর্জ্যপদার্থ দ্বারা পরিবেশ বিনষ্ট করা চলবে না।
৪) বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তার প্রয়োগ যেন মানুষ, জীবজন্তু ও পরিবেশের ক্ষতি না করে।
5) জৈবিক আশা-আকাক্ষা ও মাতৃত্বের ক্ষেত্রে নারী স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা চলবে না।
6) কর্কটরোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন দূষণকারী বস্তু থেকে আবহাওয়াকে মুক্ত করতে হবে।

Global Forum যদিও ছিল মাঝে মাঝে উত্তপ্ত, বয়ে গিয়েছিল বিতর্কের ঝড় তবুও 30 টি চুক্তি হয়েছে। অরণ্য পরিবেশ ও উন্নয়ন ভিত্তিক সেই সব চুক্তি। বহু পরিবেশগত দিক আছে সেই সব চুক্তিতে। যেমন জীব-বৈচিত্র্য, অরণ্য সৃজন শক্তি, পরিবেশ বিজ্ঞান শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা। আছে উন্নয়নের দিকও। যেমন বিকল্প অর্থনীতির মডেল, নগরায়ণ এবং সমরব্যবস্থা।

এ ছাড়াও Global Forum- এ বেসরকারী সংগঠনগুলি মিলে তৈরী করেছে বিশ্বদলিল (Earth Charter) –মূলতঃ যা হচ্ছে আটটি গৃহীত নীতির সমাহার। সংক্ষেপে সেগুলি-

1) বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রের সংহতির প্রতি নজর রাখতে হবে।
2) পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতি সমূহের মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে মৌলিক পরিবেশগত দিককে।
3) উত্পাদন ও ভোগ্যবস্তু ব্যবহারে অসহনশীল (Unsustainable) নীতি পরিহার করতে হবে।
4) পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রণালী ও বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় সীমানার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
5) সামরিক শক্তির ব্যবস্থাপনা ব্যবহার ও বিরোধের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক চাপ প্রত্যাহার করতে হবে।
6) পরিবেশের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও তার সমস্যা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করতে হবে এবং তাতে যেন সংশিষ্ট জনগণকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়।
7) উত্তরের দেশগুলি দক্ষিণের দেশগুলির কাছে পরিবেশ ঋণে আবদ্ধ। অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
8) পুরুষ- শাসিত সমাজের পরিবর্তে আমরা চাই এমন এক সমাজ যেখানে মানবিক ও পরিবেশগত কল্যাণে নারী পুরুষ উভয়েরই অবদান থাকবে।
সবশেষে বলা হয়েছে আমরা বুঝতে পেরেছি যে পৃথিবীর জীবন মন্ডলের উপর অত্যাচার এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে আর নীরব থাকা উচিত হবে না।

Source: “VIGYAN – O - VIGYANKARMI” A bi - monthly magazine, March - June 1992, P 252 Lake Town, Block A, Calcutta – 700 089
( বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক দ্বিমাসিক পত্রিকা, মার্চ - জুন ১৯৯২, P 252 লেক টাউন, ব্লক A, কলিকাতা – 700 089)


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading