ইতিহাসে আর্সেনিক



প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধযুগে আর্সেনিকের আকরিক সমূহের নানান ব্যবহার হত। রিয়েলগারের ভারতীয় নাম ছিল মানশিলা আর অর্পিমেণ্টের হরিতালম্। মন:শিলা বা মানসশিলা থেকে বাংলায় প্রচলিত মনছাল কথাটি এসেছে। চরক সংহিতা-য় আলা বা হরিতালমের দেহের ভিতরের ও বাইরের ঘা’-তে দেবার বিধান আছে।

ভূমিকা


মানুষের চিরন্তন স্বাভাবিক কৌতুহলই তাকে তার পরিবেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীজাত পদার্থ, শিলা, মৃত্তিকা, আকাশ, বাতাস, রোদ, বৃষ্টি, আগুন প্রভৃতি সব কিছু নিয়েই অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে তার যেমন খাদ্যদ্রব্যের ভাণ্ডার ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে অসুখ-বিসুখ নিরাময়, নিবারণ, শক্রবিনাশ, শস্য সুরক্ষা প্রভৃতির নানারকম বেশি কার্যকর, অকার্যকর, এমনকী বিষময় অভিজ্ঞতাও মানব সমাজকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যারা চরম মূল্য দিয়েছিল মানব ইতিহাস তাদের ভুলে গেছে। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া সফল, ব্যর্থ সব অভিজ্ঞতাই কিন্তু মানব জাতির মূল্যবান অর্জন, যা তাদের আরও ভালভাবে চলতে সাহায্য করেছে। আধুনিক যুগের আগে পর্যন্ত পদার্থের গঠন ও ধর্ম সম্বন্ধে কোনও বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত ধারণা ছিল না। প্রাচীন কালে ও মধ্যযুগে সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘজীবন ও রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য নানারকম (বোধ হয় সবরকম) দ্রব্যাদির সঙ্গে জাদু, ভূতপ্রেত, জ্যোতিষীবিদ্যা, কিমিয়া বিদ্যা সবই ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছে।

কালক্রমে ভ্রান্তবিশ্বাস, অবান্তর আচার-আচরণ, অকার্যকর বা ক্ষতিকর দ্রব্যাদি ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বিবর্তিত হয়ে জন্ম নিয়েছে আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞান, যা চমত্কার কার্যকর, যা মানুষকে দিতে সক্ষম সুস্থ সবল দীর্ঘজীবন। রোগসৃষ্টির প্রকৃত কারণের মধ্যে অন্যতম জীবাণু, ভাইরাস, প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার বিঘ্নসমূহ এবং নিরাময়ের জন্য রাসায়নিক ঔষধ চিকিত্সা পৃথিবীর কোথাও ছিল না, সম্ভবই ছিল না। মজার কথা, সভ্যতার প্রথম কার্যকর রাসায়নিক ওষুধ এসেছে আর্সেনিক থেকেই, তবে আজ তা অচল। আর্সেনিক নিয়ে মোহগ্রস্ত মানুষ নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছে। দীর্ঘকাল মোহগ্রস্ত থাকার কারণ মানবদেহে আর্সেনিকের ক্রিয়াফল - বিশেষ করে স্বল্পমাত্রায়, যা প্রকাশিত হতে সময় লাগে এবং তা কুফল না সুফল বোঝা সহজসাধ্য ছিল না। আর্সেনিকের দীর্ঘকাল ব্যাপক প্রয়োগের অভিজ্ঞতা রসায়ন, বিষবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। মানবদেহে আর্সেনিক বিষ হিসাবে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।

আর্সেনিকঃ প্রাচীন কালে


আর্সেনিক মৌলটি স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতিতে বিরল। এর দু’টি প্রধান আকরিকের রং ও বিরলতার জন্যেই বোধহয় প্রাচীন মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এই দু’টি লোহিত বর্ণের রিয়েলগার ও সোনালি রঙ-এর অর্পিমেণ্ট।

গ্রিক আর্সেনিকাম (যার অর্থ হল শক্তিশালী) থেকে আর্সেনিক কথাটি এসেছে। অর্পিমেণ্ট এসেছে “অরাম পিগমেণ্টাম” বা সোনালি রং থেকে। প্রাচীন কালে বা মধ্যযুগে যেহেতু আধুনিক মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ সম্পর্কিত ধারণাই ছিল না, তাই সাদা আর্সেনিক (অর্থাত আর্সেনিয়াস অকসাইড), রিয়েলগার ও অর্পিমেণ্টের পারস্পরিক সম্পর্কও অজানা ছিল। তবে কিমিয়াবিদ বা অপরাসায়নিকরা ও চিকিত্সকরা ব্যবহার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বুঝে ফেলেছিলেন এদের মধ্যে সম্পর্ক আছে এবং পারস্পরিক রূপান্তরও করা যায়। আর্সেনিক যে একটি মৌলিক পদার্থ তা সম্ভবত প্রথম বোঝেন অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস (1193-1280)।

অর্পিমেণ্টের সোনালি রঙের মোহে আর্সেনিক থেকে সোনা তৈরির আশায় অনেকেই বহু পরিশ্রম, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যর্থও হয়েছেন, বিষক্রান্তও হয়েছেন। ভূত প্রেত থেকে আর্সেনিক জীবিত মানুষ ও মৃতদেহ রক্ষা করে এমন ধারণা সুপ্রাচীন। মিশরের ফ্যারাও তুতেনখামেনের মমিতে ছোট একটি ব্যাগে অর্পিমেণ্ট বাঁধা আছে। রসুনের গন্ধ যেহেতু আর্সেনিকের মতো, তাই ভূত তাড়ানোর সুনাম রসুনও কিঞ্চিত পেয়ে গেছে।

আজ আমরা জানি, তামা, টিন, জিঙ্ক, সোনা প্রভৃতি লৌহেতর আকরিকে আর্সেনিক থাকে। ঐসব ধাতু নিষ্কাশনে তাপ দিয়ে খনিজ জারণের সময় উদ্বায়ী আর্সেনিক (আর্সেনিয়াস অকসাইড ) চুল্লির চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যেত, কিছু উপরে জমে থাকত কঠিন সাদা গুঁড়ো হিসেবে। কৌতুহলী মানুষ তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়োগ করেছে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে ধাতু নিষ্কাশন চুল্লিজাত এই আর্সেনিক স্যানডারাক নামে বাজারে পাওয়া যেত। এটাই বাংলায় শঙ্খবিষ বা সেঁকোবিষ নামে পরিচিত। এর ব্যবহার, তার ফলাফল রসায়ন ও চিকিত্সা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আছে। প্রাসঙ্গিক কিছু বিবরণ এখানে দেওয়া হল।

প্রাচ্য দেশে


খনি থেকে আর্সেনিক ও তামা, লেড প্রভৃতি প্রাচীন ধাতু নিষ্কাশনে যারা কাজ করত তাদের নানারকম পেশাগত রোগ হত। এর মধ্যে প্রধান ছিল হাত ও পায়ের পেশীক্ষয়, স্নায়বিক ও শারীরিক দৌর্বল্য ইত্যাদি।

এই কারিগরদের আগুন ও প্রযুক্তির পৌরাণিক পালক দেবতা হিপাস্টাস ও পরবর্তী রোমান যুগের অনুরূপ দেবতা ভালকান ছিলেন খোঁড়া ও শীর্ণ। এই দেবতার সৃষ্টির সঙ্গে ধাতু কারিগরদের পেশাগত রোগের সম্পর্ক আছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তামা, লেড প্রভৃতির খনিজের তাপ জারণে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত আর্সেনিক ও লেড ধোঁয়ার সঙ্গে অবশ্যই বেরিয়ে আসত, যাতে কারিগররা আক্রান্ত হত। গ্রিস ও রোমে ক্রীতদাসদের দিয়েই এইসব অস্বাস্থ্যকর কাজ করানো হত। অ্যারিস্তোতল বলেছেন, স্যানডারাক ঘোড়াসহ মালবাহী পশুদের মেরে ফেলে। রোমান সিনিয়র প্লিনি (খ্রিস্টীয় প্রথম শতক) আর্সেনিকের নানা সদগুণের মুগ্ধ বর্ণনা করে গেছেন। হিপোক্রেটিস চিকিত্সায় আর্সেনিকের প্রয়োগ-বিধি দিয়ে গেছেন 430 খ্রিস্টপূর্বাব্দে ।

প্রাচীন চিন দেশে রিয়েলগারের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। ধারণা ছিল, রিয়েলগার পুরুষালী (yang) অর্পিমেণ্ট মেয়েলি (yin) । 1600 খ্রিস্টাব্দের চিনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়ায় আর্সেনিকের নানা বিষগুণের বিবরণ আছে। সাবেকি চিনা চিকিত্সার আজও যা কিছু প্রচলিত আছে, তাতে আর্সেনিক, মার্কারি প্রায়ই থাকে।

মধ্যযুগে ইওরোপীয় নবজাগরণের কালে সুইজারল্যাণ্ডের “বিদ্রোহী” প্যারাসেলসাস (1493-1541) গ্রিক-রোমান গ্যালেনের (129-200 AD) দীর্ঘকালব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিত্সাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন চিন্তা, নতুন পদ্ধতি ও নতুন দ্রব্যাদির প্রচলন করেন। চিকিত্সায় তিনি আর্সেনিকের গুরুত্ব বাড়ান, তাঁর অন্যতম এক ধারণা ছিল লঘুকরণে (ডাইলিউশন) বিষ ওষুধ হয়ে যায়। অর্থাত বেশিমাত্রায় আর্সেনিক বিষ, কম মাত্রায় তা ওষুধ।

মধ্যযুগে এশিয়া, ইওরোপের সবদেশেই বহুলোক কৃত্রিমভাবে সোনা তৈরির উপায় সন্ধান করত। সোনালি অর্পিমেণ্ট থেকেই তা করা যাবে, এমন আশায় অনেকেই পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতেন। অনেকে আবার সর্বরোগহর ওষুধ (elixir) আর্সেনিক থেকেই আসবে এমন আশাতেও কাজ করতেন। তবে এরা সবাই ব্যর্থ হয়েছিলেন, হবেনও যে তা আজকের বিজ্ঞানের আলোয় সহজবোধ্য। তাহলেও কিন্তু তাঁদের কাজের ফলে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছিল।

প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধযুগে আর্সেনিকের আকরিক সমূহের নানান ব্যবহার হত। রিয়েলগারের ভারতীয় নাম ছিল মানশিলা আর অর্পিমেণ্টের হরিতালম্। মন:শিলা বা মানসশিলা থেকে বাংলায় প্রচলিত মনছাল কথাটি এসেছে। চরক সংহিতা-য় আলা বা হরিতালমের দেহের ভিতরের ও বাইরের ঘা’তে দেবার বিধান আছে। মানসশিলার ওষুধিগুণ সম্পর্কে বলা হতঃ গায়ের রঙ উজ্জ্বল করে, মেদ কমায়, কোষ্ঠ পরিষ্কার করে, শরীর উষ্ণ ও স্নিগ্ধ রাখে, হাঁপানি-সর্দি-কাশি কমায়, বিষক্রিয়া নাশ করে, অশরীর কুপ্রভাব নিবারণ করে। হরিতালম বাযু, কফ কমায়, বিষ নাশ করে, ভূতপ্রেতও নিবারণ করে। স্ত্রীলোকের মাসিক স্রাব বন্ধ করে, কুষ্ঠ নিরাময় ও ক্ষুধাবৃদ্ধি করে। “রসজলনিধি” গ্রন্থে হরিতালম ও মানসশিলার কিছু দোষের কথাও আছে।

বর্ণিত দোষের মধ্যে আছে : বায়ুবৃদ্ধি, আয়ুহ্রাস করা, চামড়া ফোলা, ঘা হওয়া আর কখনও পঙ্গুত্ব আনা। তবে এসবের জন্যে হরিতালমের অশুদ্ধিকেই দায়ী করা হয়। শুদ্ধিকরণের ব্যবস্থাও দেওয়া আছে। যৌন উদ্দীপক হিসাবে আর্সেনিকের ব্যাপক ব্যবহার ভারত সহ প্রাচীন সভ্যতার সর্বত্রই প্রচলিত ছিল। পুত্র সন্তানের আশায় গর্ভসঞ্চারের প্রথমদিকে অনেক ভারতীয় স্ত্রীলোক গোপনে আর্সেনিক খেত।

মধ্যযুগে


মধ্যযুগে আরবদেশগুলি ছিল বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিত্সা বিদ্যার উর্বরভূমি। অষ্টম শতকে গেবের অর্পিমেণ্ট পুড়িয়ে সাদা আর্সেনিক পেয়েছিলেন। আভিসেন্না (980-1038) বুঝেছিলেন সাদা, হলুদ ও লাল আর্সেনিক সমজাতীয়। আরবীয় চিকিত্সকরা হাঁপানি, ফুসফুসের অসুখ, ত্বকের অসুখ, শরীরের ভিতরের ও বাইরের ঘা প্রভৃতির জন্য এবং ডায়ারিয়ার জন্য চুন ও আফিমের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতেন। আভিসেন্না মধু ও অন্যান্য অনুপানের সঙ্গে ত্বক ও ফুসফুসের রোগে ব্যবহার করতেন। এই সময় থেকে প্লেগেও আর্সেনিকের প্রয়োগ হতে থাকে।

মধ্যযুগে ইওরোপীয় নবজাগরণের কালে সুইজারল্যাণ্ডের “বিদ্রোহী” প্যারাসেলসাস (1493-1541) গ্রিক-রোমান গ্যালেনের (129-200 AD) দীর্ঘকালব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিত্সাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন চিন্তা, নতুন পদ্ধতি ও নতুন দ্রব্যাদির প্রচলন করেন। চিকিত্সায় তিনি আর্সেনিকের গুরুত্ব বাড়ান, তাঁর অন্যতম এক ধারণা ছিল লঘুকরণে (ডাইলিউশন) বিষ ওষুধ হয়ে যায়। অর্থাত বেশিমাত্রায় আর্সেনিক বিষ, কম মাত্রায় তা ওষুধ। তিনি আর্সেনিক ছাড়াও আফিম, মার্কারি, লেড, কপার সালফেট ইত্যাদি চিকিত্সার ব্যবহার আনলেন। প্যারাসেলসাস স্যানডারাক (As2O3) ও সল্ট পিটার মিশিয়ে উত্তপ্ত করে প্রাপ্ত পদার্থকে ওষুধ হিসাবে ব্যাপক প্রয়োগ করেন। ইতালিতে বিরিনগুচিও (1540) সুস্পষ্ট ভাবে বলেন একটি আর্সেনিক সাদা আর একটি সুন্দর স্বর্ণালী।

প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading