জীবদেহে ফ্লোরাইডের বিষক্রিয়া


ফ্লোরাইডের আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়নি


শিশুদের বাড়ের সময় অধিক ফ্লোরাইড বিষণ হলে কোলাজেন ধাত্র অ-সুগঠিত হয় এবং হাতে পায়ে বিকৃতি আনে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে এসবের নানারকম নাম আছে। এইগুলিই হল ফ্লোরোসিসের তাক লাগানো বহির্লক্ষণ, যাকে স্কেলিটাল বা অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস বলে।জীবদেহে, অন্ততঃ মানুষসহ অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদেহে, ফ্লোরাইডের আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়নি। জীবদেহে সর্বত্র ফ্লোরিন অপ্রয়োজনীয়ই শুধু নয়, ক্ষতিকারক। রসায়নের ধারণা থেকে এটা সুস্পষ্ট। আগে দাঁত ও হাড় বিষয়ে দু-একটি কথা বলে নেওয়া সমীচীন হবে বলে আমার মনে হয়।

কোলাজেন একধরনের তন্তুময় প্রোটিন, প্রাণীদেহেই যার আধিক্য। শরীরের প্রায় 30 শতাংশ প্রোটিনই হল কোলাজেন। প্রায় 25 রকমের কোলাজেনের সন্ধান জানা গেছে। কোলাজেন চামড়া, দাঁত, অস্থি, টেন্ডন, কার্টিলেজ ও পেশিসমূহকে বন্ধনযুক্ত ও যথাস্থানে দৃঢ়বদ্ধ রাখে।

প্রাণীদেহের অস্থিপঞ্জর মূলত কোলাজেন জাতীয় প্রোটিন (90 শতাংশ) দিয়ে তৈরি, যার সাথে সামান্য পরিমাণে ক্যালশিয়াম হাইড্রক্সিফসফেট (Calcium Hydroxyphosphate) ও ক্যালশিয়াম কার্বোনেট (Calcium Carbonate) মণিকীকৃত (mineralized) বা শিলীভূত (calcified) থাকে। ওইসব মণিকীকৃত কোলাজেন উজ্বল মসৃণ দন্ত ও অস্থিকলা উত্পন্ন করে। মানুষের দাঁতেরও বেশ খানিকটাই প্রোটিন। হাতি, জলহস্তী, সিন্ধুঘোটক তিমি, হাঙরের দাঁতও অনুরূপ। গণ্ডারের শিং মণিকীকৃত কেরটিন - জাতীয় প্রোটিন। মৃতদেহ পোড়ালে হাড় ও দাঁতসমূহের জৈব উপাদানগুলিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ফ্লোরাইড ও দাঁত


উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা বোঝা যায় না ফ্লোরাইড কী করে দাঁতের ক্ষয় ( যার ফলে ক্যাভিটি হয় ) প্রতিরোধ করতে পারে। এর একটা সম্ভাব্য রাসায়নিক অপযুক্তি এইরকম হতে পারে -

খাদ্যবস্তুর অবশিষ্টাংশের পচনে মুখে জৈব অ্যাসিড উত্পন্ন হলে তার হাইড্রোজেন আয়ন দাঁতের মণিকীকৃত ক্যালশিয়াম হাইড্রক্সিফসফেটের সাথে বিক্রিয়া করে দাঁতের ক্ষয় ও গর্ত সৃষ্টি করতে পারে। তাই টুথপেস্ট বা ফ্লোরিনঘটিত জলের ফ্লোরাইড দিয়ে দাঁতের হাইড্রক্সিফসফেটের হাইড্রক্সিল মূলককে প্রতিস্থাপিত করতে পারলে উত্পন্ন হবে ক্যালশিয়াম ফ্লোরোফসফেট। তখন আর খাদ্যবস্তুর পচন - উদ্ভূত অ্যাসিড তার সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে দাঁতের গর্ত সৃষ্টি করতে পারবে না।

এই যুক্তি অপযুক্তি। কারণ হাইড্রক্সিফসফেটের রাসায়নিক পরিবর্তনে বরং দাঁতের মণিকীকৃত গঠন বিঘ্নিত হয়ে তার উপর অ্যাসিডের সক্রিয়তা বাড়িয়ে দেবে। ফ্লোরাউডের হাইড্রোজেন - বন্ধন ক্ষমতা খুব বেশি। এর ফলে ফ্লোরাইড প্রটিন ও এনজাইম সমূহের গৌণ, প্রগৌণ, প্রপ্রগৌণ (secondary, tertiary, quaternary ) আণবিক গঠন অবিন্যস্ত করে দেয়। এর ফলে দাঁতের কোলাজেন ধাত্র ( matrix ) সুসংগঠিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। এর ফলে ক্যালশিয়াম কার্বোনেট ও ক্যালশিয়াম হাইড্রক্সিফসফেট সমূহের মণিকীভবন সন্তোষজনক হতে পারে না। ফলে তার স্বাভাবিক সুন্দর মসৃণ ঈষদচ্ছতা (translucence) হারিয়ে দাঁত মটলড হয়ে যায়। ফ্লোরোসিসের অন্যতম কুফল তাই দন্ত বিকৃতি, দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া ও পড়ে যাওয়া।

অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস


হাড়ের বেশির ভাগটাই হল কোলাজেন জাতীয় প্রটিন, যার সামান্য ক্যালশিয়াম হাইড্রক্সিফসফেট ও ক্যালশিয়াম কার্বোনেট মণিকীকৃত থাকে। ফ্লোরাইড ও হাইড্রক্সাইড মূলক (F & OH) দুটির ইলেক্ট্রনিক সজ্জা সৃদশ এবং তাদের ব্যাসার্ধও প্রায় সমান। ফলে ফ্লোরাইড সহজেই হাইড্রক্সাইড মূলককে সরিয়ে হাড়ের হাইড্রক্সিফসফেটে ঢুকে পড়ে নিম্নলিখিত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্যালশিয়াম ফ্লোরোফসফেট উত্পন্ন করে।

দেহে প্রবিষ্ট ফ্লোরাইডের অনেকটাই মলমূত্র, ঘামের মাধ্যমে দেহ থেকে নিষ্কাশিত হয়ে বেরিয়ে যায়। বাকি ফ্লোরাইডের প্রায় 99 শতাংশ উপরোক্ত সমীকরণ অনুসারে অস্থিপঞ্জরে স্থায়ীভাবে ক্রমসঞ্চিত হতে থাকে। তার ফলে হাড়গুলি ভঙ্গুর হয়ে যায়। শিশুদের বাড়ের সময় অধিক ফ্লোরাইড বিষণ হলে কোলাজেন ধাত্র অ-সুগঠিত হয় এবং হাতে পায়ে বিকৃতি আনে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে এসবের নানারকম নাম আছে। এইগুলিই হল ফ্লোরোসিসের তাক লাগানো বহির্লক্ষণ, যাকে স্কেলিটাল বা অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস বলে।

ক্রনিক ফ্লোরোসিস ফ্লোরাইড কঙ্কাল বা অস্থিপঞ্জরে ক্রমসঞ্চিত হয়। ফলে সব হাড়, টেন্ডন, কোমালাস্থি ( কার্টিলেজ ) ইত্যাদির নমনীয়তা কমে গিয়ে ভঙ্গুরতা বাড়ে। বেশি বয়সে অল্প আঘাতে হিপ ফ্র্যাকচার (hip fracture) ফ্লোরোসিসের আর একটি ভয়ংকর অবদান।

মেরুদণ্ড ও অন্যান্য অস্থির চার পাশে নির্দোষ সরু সরু প্রক্ষেপ ঘটে চলে যাকে exostosis বলে। এ সবের ফলে ঘাড়ে, পিঠে, গাঁটে ব্যথা হয়। অনেকে ঘাড় ও শিরদাঁড়া আগের মতো ঘোরাতেই পারেন না। অনেকের পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায় যাকে সাধারণভাবে কুব্জত্ব বা কাইফোসিস (kyphosis) মনে হয়। ফ্লোরোসিস বেশি হলে সামান্য নড়াচড়াতেই খুব ব্যথা হয়। শল্য চিকিত্সাতেও প্রায়ই নিরাময় হয় না।

স্কেলিটাল বা অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে ধীরে কিন্তু অনিবার্যভাবে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়।

শরীরের অন্য অংশের ফ্লোরোসিস


আমরা আগেও বলেছি যে Skeletal বা অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস ছাড়াও শরীরের অন্য অংশে ফ্লোরাইডজনিত ব্যাপক অপক্রিয়া ঘটে। একে Non-skeletal fluorosis বলা হয়। আবার কখনো কখনো Pre-skeletal fluorosis-ও বলা হয়, কারণ অনেক সময় অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস প্রকট হওয়ায় আগেই শরীরের অন্য অংশে ফ্লোরাইডের অপক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

আমরা দেখেছি যে ফ্লোরাইডের হাইড্রোজেন - বন্ধন ক্ষমতা খুব বেশি। এর ফলে দাঁত ও হাড়ের কোলাজেন ধাত্র অবিন্যস্ত ও বিকৃত হয়ে যায়। কিন্তু ফ্লোরাইডের উচ্চ হাইড্রজেন বন্ধন ক্ষমতার জন্য শুধু প্রটিন ও এনজাইমের আণবিক গঠন সমূহই বিপর্যস্ত হয় তাই নয়, ডিএনএ-র হাইড্রজেন বন্ধনীও কিছু ভাঙে। ডিএনএ ভাঙার হার যদি মেরামতির হারের থেকে বেশি হয়, তবে জেনেটিক ক্ষতি মারাত্মক হতে পারে।

জটিল লবণ (complex salt) উত্পন্ন করবার উচ্চ ক্ষমতার ফলে ফ্লোরাইড তামা, দস্তা, ক্যালশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি আয়নের সাথে শক্ত রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, জীবদেহে রাসায়নিক বিক্রিয়া সমূহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে, শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকর্ম নানাভাবে ব্যহত করার মাধ্যমে নানারকম দৈহিক অসুস্থতা ঘটায়।

মনে রাখা যেতে পারে যে প্রণরসায়ন মূলতঃ ‘মেটাল কিলেট’ (metal chelate) –এর রসায়ন। ধাতব আয়নগুলি প্রাণীদেহের রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্লোরাইড জীবদেহের মুক্ত কপার আয়নকে জটিল শক্ত রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ করে বহু এনজাইমের কার্যকারিতা ক্ষুন্ন করে। রক্ত থেকে ক্যালশিয়ামকে শক্ত রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ করে সরিয়ে নেওয়ার ফলে হাইপোক্যালসিমিয়া বা ক্যালশিয়ামের অভাব হয়। ক্যালশিয়ামের অভাবে স্নায়ুতন্ত্র ঠিকমত কাজ করতে পারে না। এ সবের ফল মারাত্মক।

তাই, দাঁতের ও হাড়ের ফ্লোরাইড বিষক্রিয়ার বোধগম্য ও দৃষ্টিগ্রাহ্য লক্ষণাবলি (clinical symptoms) হিমশৈলের চূড়া মাত্র। বহির্লক্ষণ না থাকলেও Non-skeletal fluorosis শরীরের ভিতরে জীবরাসায়নিক ব্যবস্থাসমূহকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে বিস্তর রোগব্যধি ও দৈহিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে চলে, যার লক্ষণাবলি প্রকাশ পায় দীর্ঘ সময় ধরে। ক্রনিক ফ্লোরাইড বিষণের জন্য যেসব লক্ষণাবলি, সেগুলি না জানার ফলে আমাদের ডাক্তাররা সেগুলিকে স্পন্ডেলাইটিস, আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওম্যালেশিয়া প্রভৃতি রোগ সন্দেহ করে ভুল অনুসন্ধান, ভুল চিকিত্সা করে যান। ফলে, রোগীদের ব্যথাবেদনা উপশমের বদলে তারা বিভিন্নভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হন। অথচ ফ্লোরাইডমুক্ত জল বা খাবার দিতে পারলে তারা যে দ্রুত রোগলক্ষণ মুক্ত হতে পারেন, তা অনেক সময়ই দেখা গেছে। এটাও মনে রাখা কর্তব্য যে, সব মানুষ ফ্লোরাইড বা আর্সেনিকে সমান ভাবে সুবেদী (sensitive) নন। যে মাত্রায় ফ্লোরাইড বা আর্সেনিকে কেউ কেউ ভীষণভাবে কাহিল হয়ে পড়েন, সেই একই মাত্রায় আবার অন্য কারুর তেমন কিছু হয় না।

এইসব জটিল বিষয়সমূহের বিশদ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সুতরাং জীবদেহে ফ্লোরাইডের কুপ্রভাবের এখানেই ইতি টানছি।

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: society for direct initiative for social and health action (Disha) 20 / 4, Shil Lane, Kolkata – 7000 015, written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading