জল নিয়ে কিছু কথা


কলকাতায় পঁচাত্তোর থেকে নব্বই ফুট জলস্তর নেমে গেছে। তারা আরও বলেন, সেজন্য এখন থেকেই সকলকে সতর্ক হতে হবে। যেমন খুশি মাটির তলা থেকে জল তোলা হচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। শুধু বৃষ্টির জলকে পুরোপুরি ব্যবহার করে আমরা আমাদের সমস্ত সমস্যা ও চাহিদা মেটাতে সক্ষম, এরকম উদাহরণের অভাব নেই।

বসন্ত গোপ। জীবিকী, কুয়ো খোঁড়া। বসন্ত কখন থেকে কুয়ো খুড়ছে, বছরে বা মাসে তার হিসেব জানে না সে। যে বিসেবটা সে দিয়ে থাকে সেটা এরকম ‘প্রথম দিকে যে বাবুদের কুয়ো খুড়েছি তারা এখন প্রায় কেউই নেই, তাদের ছেলেদেরও অনেকে এখন অবসর নিয়েছে তাদের তাকরী জীবন থেকে।’ এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে – আগে যে পাড়াতে আঠারো, কুড়ি ফুট গভীরতায় জল পাওয়া যেত, এখন সেখানে নামেত হচ্ছে চল্লিশ থেকে ষাট ফুট। প্রথম দিকের খোঁড়া কুয়োগুলি আবার ফিরে কুড়ি, তিরিশ ফুট গভীর করতে হচ্ছে। কোন পাড়ায় বা চল্লিশ ফুটেরও বেশি। পুরুলিয়া জেলার ছোট্ট একটি গ্রামের এই দিনমজুর ব্যক্তিটি যে সত্য উপলব্ধি করেছে বেশ কিছু বছর আগে থেকেই সমস্ত দেশবাসী সেই সত্যের মুখোমুখি।

কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী বিজয়া চক্রবর্তী রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন ১৯৮২ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ও জেলাগুলিতে জলস্তর চার মিটারেরও বেশি নেমে গেছে। তিনি জানান গত কুড়ি বছরে উত্তর প্রদেশের ৩৯টি জেলা, রাজস্থানের ২৭টি জেলা, মধ্যপ্রদেশের ৩৩টি, মহারাষ্ট্রের ২৫টি, উড়িষ্যার ২১টি, তামিলনাড়ুর ১৮টি, পাঞ্জাবের ১১রটি, পশ্চিমবঙ্গের ৮টি, ছত্রিশগড়ের ৮টি, দিল্লির ৬টি, কেরালার ৮টি, আসামের ৪টি, ঝাড়খণ্ডের ৩টি, ত্রিপুরার ২টি ও বিহারের ১টি জেলার জলস্তর চার মিটারেরও বেশি নেমে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে সল্টলেকে সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০০২ ছাব্বিশে এপ্রিল এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, - গত পঁচিশ বছরে কলকাতায় পঁচাত্তোর থেকে নব্বই ফুট জলস্তর নেমে গেছে। তারা আরও বলেন, সেজন্য এখন থেকেই সকলকে সতর্ক হতে হবে। যেমন খুশি মাটির তলা থেকে জল তোলা হচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। পানীয় জল সরবরাহের অন্য কোনো উপায় বার করতে হবে।

ফিরে আবার বৃষ্টির জলের কথাই ভাবতে হবে। ভারতবর্ষে অতি প্রচীন কল থেকেই কৃষি ও প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে রাখার বিভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন ছিল। জলচক্রে বৃষ্টি হচ্ছে প্রথম অবস্থা, তাই বৃষ্টিই হচ্ছে জলের উত্স। কিন্তু অতি প্রচীন কাল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্য ঔপনিবেশিক পর্বে ভাঙতে শুরু করে। তাই চেরাপুঞ্জিতে বছরে গড় পাঁচশো থেকে এক হাজার সেন্টিমিটার বৃষ্টি হওয়ার পর সেখানেও পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে। ভারতবর্ষের ব্শিরভাগ জায়গাতেই যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি হয়। কিন্তু তার প্রায় আশি ভাগই তিন মাসের মধ্যেই বর্শিত হয়ে যায়, এবং তা সংগ্রহ করে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার ফলে বয়ে চেল যায়। তাই বৃষ্টি হওয়াটাই বড় কথা নয়।

পশ্চিবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের পশ্চিমাংশ প্রভৃতি যে জায়গাগুলি খরাপ্রবণ বলে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলিরও যদি আমরা বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে এখানে যতটা পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তা যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে কৃষি বা গৃহস্থালি কোনো কাজেই জলের অভাব হওয়ার কথা নয়।

সরকার অবশ্য খরা সমস্যার সমাধানে বিরাট এক পরিকল্পনাকে রূপ দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। বলা হচ্ছে দেশের সব নদীকে খাল কেটে জুড়ে সেই জল পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের খরা এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। প্রাকৃতিকভাবে উত্পন্ন হয়ে নদী স্বভাবিকভাবে যে গতিপথ দিয়ে বয়ে চলেছে তা ব্যহত হলে স্বাভাবিকতাও ব্যহত হবে এটা সাধারণ কথা কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্যে এর প্রভাব কতটা পড়বে। এই হস্তক্ষেপ আমাদের অস্তিতের মুলেই আঘাত হানতে চলেছে না তো? সরকার সমগ্র পরিকল্পনাটি জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট করুক। প্রকৃতির স্বভাবিক কার্যকলাপে মানুষ তার উন্নতিকল্পে এর আগেও হস্তক্ষেপ করেছে কিন্তু জল সমস্যায় আধুনিক প্রযুক্তি যে কাজে লাগছে না, বিগত দশকগুলিতে এটা আমরা সকলেই আনুভব করেছি। আথচ শুধু বৃষ্টির জলকে পুরোপুরি ব্যবহার করে আমরা আমাদের সমস্ত সমস্যা ও চাহিদা মেটাতে সক্ষম, এরকম উদাহরণের অভাব নেই।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading