জল ও অন্নের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক

16 Feb 2017
0 mins read

পণ্ডিত জিঞ্জাসা করলেন, ‘সবচেয়ে বড় তপস্যা কী’? সহজ-সরল গোয়ালা উত্তর দেয়, ‘আঁখ রো তপ ভালো’ l চোখের তপস্যাই সব থেকে বড় l নিজের চারপাশের পৃথিবীটাকে ঠিকভাবে অনুভব করা, আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটু একটু করে তৈরি হওয়া জীবনের প্রতি এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি-র সাবধনাই ইহলোক থেকে পরলোক পর্যন্ত মানুষের বেঁচে থাকাটুকু সহজ ও সাবলীল করে দেয় l চোখের এই তপস্যা মরুভূমিতে জলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার অন্ন জোগানোরও এক বিরল সাধনা করেছে l এই সাধনারই ফল খডিন l

লুনির মতো দু-একটা নদী বাদ দিলে মরুভূমিতে বারো মাসের নিত্যবহ নদী নেই বললেই চলে l মরুভূমির নদীগুলি কোনো একটা স্থানে জন্ম নেয়, কিছুটা পথ এগিয়ে যায়, তারপর আবার মরুভূমিতেই কোথায় যেন বিলীন হয়ে যায় l চোখের তপস্যা অবশ্য এই নদীগুলির প্রবাহ পথকেই পরম যত্নে পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি স্থান খুঁজে নেয়, যেখানে তার জল ধারাকে আটকে ফেলা সম্ভব l

এরকম সব জায়গাতেই তৈরি হয়েছে খডিন l খডিন হল এক ধরনের অস্থায়ী পুকুর l দুই দিকে মাটির পাড় তুলে তৃতীয় দিকে পাথরের মজবুত দেওয়াল অর্থাত্ চাদর তৈরী করে দেওয়া হয় l খডিনের পাড়কে বলে ধোরা l ধোরার দৈর্ঘ্য নির্ভর করে খডিনে কতটা জল আসবে তার ওপর। কোনো কোনো খডিন পাঁচ-সাত কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বর্ষার নদীর প্রবাহকে এই খডিনে বেঁধে ফলার পরও যদি দেখা যায় আরও আসছে, তখন ঐ উদ্বৃত্ত জল পাথরের চাদর পেরিয়ে নির্দিষ্ট পথে দ্বিতীয়, এমনকী তৃতীয় খডিনকে ভরিয়ে চলে। খডিনে বিশ্রাম নিতে নিতে নদী ক্রমশ শুকিয়ে আসে। সঙ্গে খডিনের মাটিও একটু একটু করে ধীরে ধীরে আর্দ্র হয়। মাটির ভেতর এই আর্দ্রতা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আর্দ্রতার ওপর ভরসা করেই খডিনে গম প্রভৃতি শষ্য বুনে দেওয়া হয়। মরুভূমিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তাতে এখানে গম ফলানো সম্ভব ছিল না। তবে কয়েকশো বছর আগে এখানে অনেক জায়গাতেই, বিশেষ করে জয়সলমেরে এত খডিন তৈরি হয়েছিল যে, জেলার একটা অঞ্চলের পুরোনো নামই হয়ে যায় খডিন।

খডিন তৈরির কৃতিত্ব পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের। কোন এক সময় এরা পালি অঞ্চল থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। পালিওয়ালদের কল্যাণেই জয়সলমের রাজ্য আনাজপত্রে ভরে ওঠে। এ অঞ্চলে পালিওয়ারা চুরাশিটি গ্রামে বসতি স্থাপন করে। প্রতিটি গ্রামই যথেষ্ট সুন্দর ও ব্যবস্থাসম্মত। লুডোর ছকের মত সাজানো ডাইনে-বাঁয়ে দীর্ঘ ও প্রশস্ত রাস্তাঘাট, পাথরের তৈরি সার সার সুন্দর ঘর, বসতি অঞ্চলের বাইরে পাঁচ-দশটা নাডি, দু-চারটে বড় বড় পুকুর এবং যতদূর চোখ যায়, আদিগন্ত দীর্ঘ খডিনের ভেতর ঢেউ তোলা ফসল। গ্রামগুলিতে স্বাবলম্বন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা এতটাই অনায়াস ছিল যে, দুর্ভিক্ষও এখানে এসে আনাজের তলায় চাপা পড়ে যেত।

এই স্বাবলম্বন গ্রামগুলিকে অহংকারী করেনি, তবে এতটাই আত্মসম্মান সচেতন করেছিল যে, কোনো এক সময় রাজার এক মন্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ বাঁধায় পুরো চুরাশিটি গ্রামের মানুষই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। চুরাশিটি গ্রামের এক সম্মেলন হয় এবং সেখানে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে বহু বছরের পরিশ্রমে তৈরী বাড়ি, ঘর, পুকুর, খডিন, নাডি ইত্যাদি যেখানে যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই ফেলে রেখে সমস্ত গ্রাম খালি করে সকলে মিলে অন্য কোথাও চলে যায়।

সেই সময়কার তৈরি অধিকাংশ খডিনগুলিতে এখনও গম চাষ হয়। ভালো বর্ষা হলে, অর্থাত্ যতটুকু বর্ষা জয়সলমেরে স্বাভাবিকভাবে হয়, সেটুকু হলেই খডিনগুলি এক মন গমে পনের মণ ফিরিয়ে দেয়। প্রতিটি খডিনের বাইরে পাথরের তৈরি রামকোঠা পাওয়া যায়। এগুলিকে করাইও বলে। করাই-এর ব্যাস হয় পনেরো হাত এবং উচ্চতা দশ হাত। ঝাড়াই হওয়ার পর গম চলে যায় গমের জায়গায় আর খোসা-ভূসি প্রভৃতি জমা করা হয় এই করাইগুলিতে একটা করাইয়ে একশো মণ পর্যন্ত ভুসি রাখা যায়। ভুসিকে এখানে বলে সুকলা।

পুকুরের মতো খডিনেরও নাম দেওয়া হয়। এমনকী পুকুরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো খডিনেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। যেমন, ধোরা হল পাড়। ধোরা আর পাথরের চাদরকে যুক্ত করে যে মজবুত বাঁধ, সেই অর্ধবৃত্তাকার অঙ্গটির নাম হল পাখা। জলের বেগ কমিয়ে তার আঘাত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এটি অর্ধ বৃত্তাকার করা হয়। দুটি পাখা, একটি চাদর এবং অতিরিক্ত জল বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেষ্টা-সব কিছুই তৈরি করা হয় যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে। বারোমাস নিত্যবহ না হলেও চার মাসের অর্থাত্ বর্ষার নদীগুলিরও বেগ এমন প্রবল হয় যে, অল্প একটু অসাবধানতাই পুরো খডিন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

সমাজ বহু খডিন তৈরি করেছে। তবে কিছু প্রাকৃতিক খডিনও পাওয়া যায়। মরুভূমিতে এমন কিছু ভূমিরূপ আছে, যেখানে তিন দিক উঁচু হওয়ায় চতুর্থ দিক থেকে বয়ে আসা জল প্রাকৃতিক ভাবেই আটকে পড়ে। একে বলে দেবী বাঁধ। চলিত ভাষায় এটাই পরিণত হয়েছে দই বাঁধ-এ, আর কোথাও কোথাও কোন এক নিয়মবশ একে দই বাঁধ জায়গা বলা হতে থাকে।

খডিন ও দই বাঁধের স্থান চার মাস জীবিত নদীগুলির জলে পুষ্ট হয়। আবার চলমান নদী এখানে ওখানে বাঁক নেয়। এই সব বাঁকে জলের আঘাতে মাটি ধুয়ে গিয়ে ছোট ছোট ডোবা তৈরি হয়, যেখানে নদী শুকিয়ে যাবার পরেও কিছু সময় পর্যন্ত জল জমে থাকে। এই জায়গাগুলিকে এখানে ভে বলে। পরবর্তীকালে রেজানি পানি পাওয়ার জন্য এই ভেগুলি ব্যবহার করা হয়। খেতের নিচু অংশেও কোথাও কোথাও জল জমে থাকে। একে ডহর, ডহরি বা ডৈর বলা হয়।

এরকম ডহরের সংখ্যা কয়েক শত। এসব স্থানে পালর পানি জমা হয়ে পরে ক্রমে রেজানি পানি -তে রূপান্তরিত হয়। এর পরিমাণ কম হোক বা বেশি সেটা বিন্দুমাত্রও ভাবনার বিষয় নয়। বর্ষার রজত বিন্দু চার হাত পরিমাণ ডহরেই পাওয়া যাক অথবা চার মাইল ব্যাপী খডিনে, দু-ক্ষেত্রেই তাকে সংগ্রহ করা হবে। কুঁই, পার, টাঁকা, নাডি, তলাই, তালাব কুণ্ড, সরোবর, বেরে, খডিন, দইবাঁধ জায়গা, ডহর এবং ভে-গুলি এই রজত বিন্দুতেই ভরে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য হয়তো শুকিয়ে যায়, কিন্তু কখনই মরে না।

এ সবই চোখের তপস্যায় লিখিত জল ও অন্নের অমর বন্ধন, অমর কাহিনী।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading