জলাশয় বাঁচানো সম্ভব


বাতাসের প্রবাহের দিকে প্রায় 30 কিমি পর্যন্ত মৌমাছিদের কলোনি সমূহ নষ্ট হয়ে গেল l শুয়োরের ফার্মেও বর্ধিত গর্ভপাতের জন্য ফার্ম সরিয়ে নিয়ে যেতে হল l গবাদি পশুদের মধ্যেও গর্ভপাত কিছু বেড়েছিল l বিদ্যুত কেন্দ্রের কর্মীদের মধ্যেও সমীক্ষা চালিয়ে হ্রাসপ্রাপ্ত জীবনকালসহ আর্সেনিকের নানা রকম অসুখ-বিসুখ দেখা গেছে l

ফাটলের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে লাভাস্রোত বেরিয়ে আসছে। যেকোনো অভিসারী পাত সীমান্তে এরকম দেখা যায়। এরই ফলে সমুদ্রের জল অত্যন্ত উষ্ণ হয়ে পরিচলন স্রোত সৃষ্টি করে, ফলে তার উপরের বাযুও উষ্ণ হয়, একদিকে নিম্নচাপ, অপরদিকে পরিচলন বায়ুস্রোত সৃষ্টি করে।

এতক্ষণে কিছুটা হলেও বোঝা গেছে নিশ্চয়ই এই এল-নিনোর কাণ্ডকারখানা। এখন, যে কথাটা মনে আসতে পারে, তা হল, এই ঘটনা যে ঘটতে চলেছে, তা আগে ভাগে বোঝার কোনো উপায় আছে কি ?

চেষ্টা চলছে। এল নিনোর মেজাজ মার্জি বোঝার জন্য 1985 সালে এক কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল, Tropical Ocean and Global Atmosphere তার নাম। পরে NASA আর European Space Agency একটি কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবস্থা করেছে, যাতে প্রতি দশদিন অন্তর সমুদ্রস্রোত সম্পর্কে তথ্য জানা যাবে। এমনকি ভারতেও 16 Paramolar Mosoon Prediction Model ব্যবহার করা হয় এল নিনোর পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য। বিখ্যাত আবহবিদেরা নিয়মিত এইসব পর্যবেক্ষণ করেন এবং গোলমালগুলির আগাম জানান দেন- বায়ুর উচ্চচাপের অবস্থান সরে গেছে, নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলের উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, প্রায় 5০ বেড়ে গেছে, এইসব।

তো, এই হল এল নিনোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এরপর কি মনে হয় না, যদি নাজকা পাতের দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশীয় পাতের তলায় ঢুকে যাওয়াই এল নিনো সৃষ্টির মূল কারণ হয়, তাহলে আরো ঘন ঘন এই ঘটনা দেখা যেতে পারে? কেননা, গত কয়েক বছরে ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক বিপর্যয় কি এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে না, যে পাতগুলির চলাচল যেন হঠাত একটু বেড়ে গেছে ? একটু ভেবো তোমরা। আর, আগামী বছরগুলোর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের গতিপ্রকৃতির দিকে একটু নজর রাখো। যদি আরেকটু বোঝা যায় তাতে।

জলাশয় বাঁচানো সম্ভব যদি রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীমহোদয়, মহোদয়াদের শুভ ইচ্ছা থাকে এবং সামান্যই নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষদের ওপর। পরিবেশ হচ্ছে সকল উন্নয়নের, সকল আর্থিক উন্নতির প্রথম শিকার। দ্রুত বড় হওয়া ও আর্থিক মুনাফার জন্য প্রায় প্রতিদিনই পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুসংহত উন্নয়ন এখন আলংকারিক শব্দ। জলাশয়গুলি হচ্ছে এইসব ধ্বংসাত্মক সক্রিয়তার অন্যতম শিকার।

জলাভূমি শব্দটি এখন সুপরিচিত। সারা পৃথিবী জুড়ে জলাভূমির সংজ্ঞা ও সংজ্ঞার্থ নিয়ে নানান সুক্ষ্ম জটিলতা আছে। তবে কাজ চালানোর জন্য সে সব জটিলতা ভেদ করে একটা মোটামুটি ধারণাতে আসা যাক। কোথাওই ভূপৃষ্ঠ নিখুঁত সমতল নয়। প্রাকৃতিক কারণে কিংবা মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে কিছু অপেক্ষাকৃত নীচু ও উঁচু জায়গা তৈরী হয়েছে। জলের গতিপথে বাধা না থাকলে নীচু জায়গাগুলিতে জল জমে। এই জলের পরিমাণ খুব বেশি হলে সারা বছরই কিছু জল থাকতে পারে। আবার অনেকক্ষেত্রে শুখা মরশুমে জল থাকে না। বছরের অন্তত কিছু সময় জল জমে থাকলে নীচু জায়গাগুলি পরিণত হয় জলাজমিতে।

এই জলাজমিগুলির কিছু ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে। জল যে সময় জমে থাকে না তখনও এখানকার মাটি হয় অপেক্ষাকৃতভাবে ভেজা। এখানে গজিয়ে ওঠে শর ও হোগলা জাতীয় উদ্ভিদ। জলার ধারেও পাওয়া যায় নানান ধরনের উদ্ভিদ। সারা বছর জল থাকলে অনেক সময়ে জলার জলে থাকে প্রচুর মাছ। মাছ ধরে খায় এমন প্রাণীদের মধ্যে চোখে পড়ে মাছরাঙা ও বাঘরোল। জলা অঞ্চলে বাসা বাঁধে বহু স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখী। উদ্ভিদ, প্রাণী ও পোকা নিয়ে তৈরি হয় জলার বিশেষ ধরনের ইকোলজি।

নীচু জমিতে গড়ে ওঠা ঝিল, বিল, বা প্রাকৃত সরোবর ছাড়াও, জলাভূমির মধ্যে পড়ে মানুষের তৈরি করা দিঘি, পুকুর প্রভৃতি। জলাভূমির বিষয়ক আন্তর্জাতিক রামসার সমঝোতাতে নদী, খাল ও উপকূলীয় সমুদ্রাঞ্চলকেও জলাভূমির সংজ্ঞার মধ্যে আনা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে, জলাভূমির আলোচনাতে আসে জলা, ঝিল, পুকুর, দিধি প্রভৃতির প্রসঙ্গ।

সারা ভারতবর্ষে সব মিলিয়ে 26টা আন্তর্জাতিক রামসার অঞ্চল। সেখানে কলকাতাতে ‘ইস্ট কোলকাতা ওয়েটল্যাণ্ড’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জলাভূমি ভূমিরাক্ষসদের কাছে আক্রান্ত এবং দারুণভাবে বিপন্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ও আমাদের দেশে জলাভূমিতে মাটি, বর্জ্য, ছাই, সিন্ডার প্রভৃতি ফেলে বুজিয়ে দিয়ে মার্কেট, হাউসিং কমপ্লেক্স, কারখানা, হোটেল ও বিলাসবহুল বাড়ি গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে। কিন্তু আঞ্চলিক পুলিশ- প্রশাশন কখনও নিষ্ক্রিয়, কখনও সক্রিয়ভাবে সহযোগী। সরকার বড়ে বড়ো কথা বলে, কিন্তু কার্যত অনাগ্রাহী। শাসক দলের মদতে পুকুর ভরাটের প্রতিযোগিতা হয়েছে ও হচ্ছে শহরতলিতে। হারিয়ে যাচ্ছে জলাভূমি, প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ভরাটের খবরা-খবর থানায়, মিউনিসিপালিটিতে ও অঞ্চল প্রধানদের, পরিবেশ দপ্তরেও জানানো হচ্ছে কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। ভরাট হয়েই যাচ্ছে। মত্স্য দপ্তরও নির্বিকার, হিমগিরীর নিরবতা নিয়ে। যদিও পরিবেশমন্ত্রী এ বারের পরিবেশ দিবসে জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর নজর পড়লো জলাজমিতে, যা প্রচুর দামে বিক্রি করে নগরায়নের নামে কংক্রিট স্লাম তৈরীর ভাবনা মাথায় এলো। ‘পূর্ব্ব কলকাতা জলাভুমি’ যে আন্তজাতিক রামসার চুক্তির অন্তর্ভুক্ত তা পরিবেশমন্ত্রী জানতেন না, তারজন্য তিনি সেখানেও নগরায়ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যদিও আমাদের কাছে এই সব জলাশয় বাঁচানোর জন্য অনেক আইনি ব্যবস্থা আছে যেমন -

বেঙ্গল ওয়াটার হাইয়াসিন্থ অ্যাক্ট (1935)
বেঙ্গল ট্যাঙ্ক ইম্প্রভমেণ্ট অ্যাক্ট (1939)
ওয়েস্টবেঙ্গল ইনল্যাণ্ড ফিসারিস এ্যাক্ট (1984)
সেটারও অ্যামেণ্টমেণ্ট হয় 1993.... 2008 সালে।
ওয়েস্টবেঙ্গল ভূর্গভস্থ জল সম্ভাবনা ও পরিচালনা অ্যাক্ট (2005)
ওয়েস্টবেঙ্গ ভূমি সংস্কার অ্যাক্ট (2005)
ওয়েস্টবেঙ্গল বৃক্ষ সংরক্ষণ অ্যাক্ট (2006)
ইস্টকোলকাতা জলাশয় সংরক্ষণ অ্যাক্ট (2006)

তবুও জলাশয়গুলি ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে সকলের চোখের সামনে। এমতাবস্থায় 2010 সালে দিশা, ফিলার, গণ উদ্যোগের মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন এবং 2012 সালে প্রধান বিচারপতি স্টেট গভর্নমেণ্টকে একটি হাইপাওয়ার কমিটি গঠন করতে আদেশ দেন- যেন তাঁরা জলাশয় সম্পর্কিত একটি নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন যাতে ভবিষ্যতে আর যেন কোন রকম জলাশয় ভরাট-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মানুষের মনে ক্ষুব্ধতা না থাকে। গঠিত হাইপাওয়ার কমিটি আগস্ট 2012 তে বেশ কিছু স্পট ও নির্দিষ্ট ভাবে কার্যকরী সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেন যা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ও সদিচ্ছার ওপর। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার একটি অংশও কার্যকরী হয়নি।

এখন দেখা যাক রাজনৈতিক সদিচ্ছা কিভাবে ভূমিরাক্ষস ও অপউন্নয়নের হাত থেকে জলাভূমিকে বাঁচাতে পারে। তবে আমাদের সতর্ক আন্দোলন ও প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সংঘবদ্ধ হয়ে পথে নামি।

सम्पर्क


ডঃ অরুণকান্তি বিশ্বাস
প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading