জলবাহিত অসুখ ও পুরুলিয়া


পরিশ্রুত পানীয় জল না পাওয়ার জন্য ঘটে নানা ধরণের জলবাহিত রোগ। জানা গেছে শুধুমাত্র এই জলবাহিত রোগেই সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর অসুস্থ হয় পঞ্চাশ কোটি মানুষ। পুরুলিয়া শহরে অনেক কুয়োই বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। যে কয়েকটি কুয়ো রয়েছে সেগুলি প্রায় গরমের সময় শুকনো পড়ে থাকতে দেখা যায়। আসলে কুয়োগুলিতে বর্ষার সময় জল সংরক্ষণ না করার জন্যই এগুলো বর্তমানে প্রায় অকেজো কুয়োতে পরিণত হয়েছে।

আমরা সকলেই জানি জলের আরেক নাম জীবন। আবার এটাও আজকে আমাদের এটা অজানা নয় যে ক্ষেত্রবিশেষে জল, মৃত্যুর পরোয়ানা বয়ে নিয়ে আসে l জীবাণু, ব্যাকটিরিয়া, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি বিভিন্ন অণুজীব জলে বাহিত হয়ে প্রায়ই মহামারি ঘটায়। একটি সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অন্তত ১০০ কোটি মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জল পায় না। আর পরিশ্রুত পানীয় জল না পাওয়ার জন্য ঘটে নানা ধরণের জলবাহিত রোগ। জানা গেছে শুধুমাত্র এই জলবাহিত রোগেই সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর অসুস্থ হয় পঞ্চাশ কোটি মানুষ। আরো বিশেষ ভাবে বললে বলা যায় পেটের অসুখেই পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই কম করে পৃথিবীর বুক থেকে ফি বছর বিদায় নেয় পঞ্চাশ লক্ষ শিশু। আমাদের নিজেদের দেশেই প্রতি বছর জল প্রবাহিত রোগে প্রায় পাঁচ কোটি শিশু অসুস্থ হয়। জলবাহিত একটি রোগ শুধু ডায়রিয়াতেই মারা যায় প্রায় পনেরো লক্ষ শিশু। মনে হয় এ কথা বলার কোন আপেক্ষা রাখে না যে পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাবেই এ অবস্থা হয়। এই ১০০ কোটির তালিকায় অবশ্যই আছেন পুরুলিয়ার মানুষজনও। পুরুলিয়ায় পানীয় জলের উত্স হাতের নাগালের মধ্যে থাকলেও তা সবসময় নিরাপদ উত্স হয় না, বা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। এখানের জল সত্যিই পরিশ্রুত কিনা তা জানবার জন্য যে নিয়মিত ও নিরন্তর তদারকি প্রয়োজন তা সচরাচর করা হয় না।

আমরা জানি পানীয় জলের পি.এইচ. (pH) সাধারণত ৭.০ থেকে ৮.৫ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। পুরুলিয়ার বেশির ভাগ উতসের জলের সর্বাধিক PH মাত্রা গ্রহণ যোগ্য সীমার মধ্যেই বর্তমান। পুরুলিয়া জেলার কিছু নলকূপের জল পানের অনুপযুক্ত। যেমন পাড়া অঞ্চলের বেশ কিছু স্থানে ফ্লোরাইডের মাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। আর্সেনিক পুরুলিয়ায় সেরকম সমস্যার সৃষ্টি না করলেও ফ্লোরাইড কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় সর্বোচ্চ সীমার ঠিক ওপরে বা নিচে রয়েছে। ফ্লোরাইড একটি প্রাকৃতিক লবণ জাতীয় পর্দার্থ যা ভূ-স্তর থেকে জলে মেশে। আমরা জানি হাড় ও দাঁতের সুষম বৃদ্ধির জন্য জলে কিছু ফ্লোরাইড থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু জলে যখন এই প্রয়োজনীয় লবণটির পরিমাণ সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সীমা ১.৫ মিলিগ্রাঃ-লিঃ অর্থাত ১০ লক্ষ ভাগে ১.৫ ভাগের ওপরে হয়ে যায় তখনই তা আমাদের দেহে ভয়াবহ ক্ষতির সৃষ্টি করে। আমাদের ফ্লুরোসিসের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিছুদিন আগে মণিময় মজুমদার পুরুলিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলের জলে যে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড পাওয়া যাচ্ছে তা পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তাঁর লেখা বইয়ে উল্লেখও করেছেন।

পুরুলিয়া শহরে অনেক কুয়োই বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। যে কয়েকটি কুয়ো রয়েছে সেগুলি প্রায় গরমের সময় শুকনো পড়ে থাকতে দেখা যায়। আসলে কুয়োগুলিতে বর্ষার সময় জল সংরক্ষণ না করার জন্যই এগুলো বর্তমানে প্রায় অকেজো কুয়োতে পরিণত হয়েছে। গরমের সময় এবং বর্ষার সময় নিরাপদ পানীর জলের অভাব জেলার বহু জায়গায়, কারণ নল বাহিত জল এখনো সমস্ত জেলায় পৌঁছায় নি। সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল এবং জেলার সামগ্রিক পরিবেশের সাথে সরাসরি যুক্ত। এখনও পুরুলিয়া জেলার বেশিরভাগ গ্রামে পানীয় জল উত্তোলনের বা সংগ্রহের প্রধান উত্স পুকুর, কুয়ো বা ইন্দারা। প্রচণ্ড গরমের সময় পানীয় জলের এই সাবেক উত্সগুলি এবং সরকারকৃত গভীর নলকূপগুলি অনেক জায়গাতেই শুকিয়ে যায়। ফলে পানীয় জলের হাহাকার ওঠে। কিছু জায়গায় আবশ্যই পাণীয় জল পাওয়া যায় কিন্তু সব জায়গার জলের গুণমান বজায় থাকে না।

বিভিন্ন জায়গার জল দূষিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে অনেকসময়ই নিয়মমাফিক টিউবওয়েল বসানো হয় না। আমরা জানি জনসাধারণের জন্য যে টিউবয়েলগুলি বসানো হয় সেগুলি আসলে খোঁড়া উচিত ভূগর্ভের অন্তত দ্বিতীয় স্তর পর্যন্ত কিম্বা আরও নীচ পর্যন্ত। কারণ ভূগর্ভের প্রথম স্তরের জল নিরাপদ নয়। দ্বিতীয় স্তরের গভীরতা মোটামুটি ২০০ ফুট। অথচ টিউবওয়েল বসানোর সময় পঞ্চায়েতগুলি অনেক সময় এই বিধি মেনে চলে না। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় ২০০ ফুট পাইপ দিয়ে একটির জায়গায় ২-৩ টি টিউবয়েল বসানো হয়। ফলে যা হবার তাই হয় গ্রীষ্মকালে এই সব টিউবওয়েল দিয়ে আর জল পড়ে না। এছাড়া গ্রামের বেশির ভাগ কুয়োর গড় গভীরতা ২৫ থেকে ৪০ ফুট। কুয়োগুলির অবস্থানও বিজ্ঞান সম্মত নয় কারণ কাছাকাছি হয় নর্দমা বা সোকপিট বা গোবরকুড় বা আস্তাকুড় থাকে। প্রতিবছর তাই ঋতুচক্রের আবর্তনের চেয়েও পুরুলিয়ায় বেশি নিয়মিত বার্ষিক মহামারি আন্ত্রিক বা জণ্ডিস। গত বছরতো পুরুলিয়ার জণ্ডিস এক ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করে। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায় পুরুলিয়ার মানুষ কি ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে জলপ্রবাহিত রোগে।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading