জলের গুণগত সমস্যা ও বৃষ্টির জলের ব্যবহার


নির্দিষ্ট ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারে বৃষ্টির জল প্রবেশের হার বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিরুপন করা যায়। কিন্তু ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারে বৃষ্টির জল যে পরিমাণে প্রবেশ করছে সেই হার এবং জল উত্তোলনের হারের একটা বিরাট অমিল থাকার ফলে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বর্তমানে যথেষ্টভাবে কমতে শুরু করেছে।

পৃথিবীতে জল হল অনেকগুলি প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে একটি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ। আমাদের অপরিকল্পিতভাবে প্রাকৃতিক জলসম্পদ ব্যবহারের ফলে আজ পৃথিবীতে এক কঠিন জল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই সমস্যা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। শুধু পরিবেশবিদরা নন, আজ প্রায় সকল চিন্তাশীল মানুষই মনে করছেন যে শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষ নয় সমস্ত পৃথিবী সম্মুখীন হতে চলেছে এক অভূতপূর্ব জল সমস্যার। কৃষিক্ষেত্রে, কল কারখানায় এবং দৈনন্দিন বিভিন্ন গৃহস্থালীর কাজে জলের যোগান আসে মূলতঃ ভূপৃষ্ঠস্থ উত্স জলের থেকে।

যেহেতু ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারে বৃষ্টির জল প্রবেশ করে ধীরে ধীরে তাই স্বাভাবিকভাবেই ভূগর্ভস্থ জলস্তর বাড়তে অনেক সময় লাগে। নির্দিষ্ট ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারে বৃষ্টির জল প্রবেশের হার বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিরুপন করা যায়। কিন্তু ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারে বৃষ্টির জল যে পরিমাণে প্রবেশ করছে সেই হার এবং জল উত্তোলনের হারের একটা বিরাট অমিল থাকার ফলে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বর্তমানে যথেষ্টভাবে কমতে শুরু করেছে। ভারতবর্ষের এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু অঞ্চলে এটাও দেখা যাচ্ছে - ভূগর্ভস্থ জল দুষ্প্রাপ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গ্রীষ্মের সময় দেশের, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে জলের জন্য উঠছে হাহাকার। তাই অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন এখনই আজই বন্ধ হওয়ার আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

প্রাকৃতিক ও মনুষ্য উদ্ভূত কারণে জলের গুণগত মান বিভিন্ন ভাবে প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। আমাদের দেশে ভূগর্ভস্থ জলের গুণগত সমস্যা বিভিন্ন উপাদানের আধিক্যের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। যথা- আর্সেনিক, ফ্লুরাইড, নাইট্রেট, লোহা, লবনাক্ততা (দ্রবীভূত লবনের আধিক্য), খরতা প্রভৃতি।

ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলের গুণগত সমস্যা শহরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলের তরল বর্জ্য নিক্ষেপণের ফলে হতে পারে। এর সঙ্গে রয়েছে শহরাঞ্চের বিভিন্ন কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য তরল, এই তরল পদার্থের মিশ্রণের ফলেও ভূগর্ভস্থ জলে গুণগত সমস্যা হতে পারে। এ কারণে ভূপৃষ্ঠস্থলে বিভিন্ন উপাদানের আধিক্যের ফলে গুণগত মানের সমস্যা হয়। যথা- জৈব্য দূষণ, রাসায়নিক দূষণ, জীবানু জনিত দূষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা জানি প্রাকৃতিক জলসম্পদ জলচক্রের উপর নির্ভরশীল। সরাসরি বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে সেই জল ব্যবহার কিছু কিছু এলাকায় জল সমস্যা অবশ্যই সমাধান করতে পারে। সংরক্ষিত বৃষ্টির জলে মিশ্রিত কোন উপাদান থাকে না, তবে বৃষ্টির প্রারম্ভিক সময়ে বাতাসের কিছু ভাসমান ধুলিকণা, দূষিত গ্যাস প্রভৃতি জলে মিশ্রিত হতে পারে। বাড়ির ছাতের বৃষ্টির জল পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে সেই জল সাধারণ ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশ্রুত করে নিয়ে ভূগর্ভস্থ অথবা ভূপৃষ্ঠস্থ আধারে রেখে দেওয়া যেতে পারে। বর্ষাকালে এই বৃষ্টির জল সংগ্রহ করা হয় এবং ঐ সংগৃহীত জল অন্য সময় পরিমাপ মত প্রয়োজনে আমাদের নিজেদের পানীয় হিসেবে, গবাদী পশুর পানীয় হিসেবে, স্নানের কাজে, বিভিন্ন গৃহস্থালীর কাজে এবং রান্নার জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

গ্রামাঞ্চলে বৃষ্টির জল কোন নির্দিষ্ট পুকুর বা জলাশয়ে সংগৃহীত করা যেতে পারে। এই সব ক্ষুদ্র প্রকল্পে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল (Catchment Area) নির্দিষ্ট করা হয়। নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাহিত বৃষ্টির জল পুকুরে বা জলাশয়ে সংগৃহীত হয়। এই সমস্ত জলাশয় যেখানে জল সংগৃহিত হবে সেগুলি দূষণ মুক্ত করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। স্নান, কাপড় কাচা, পশু প্রাণী ধোয়ানো প্রভৃতি কাজের জন্য কখনই এই জলাশয় বা জলাশয়গুলি ব্যবহার করা উচিত নয়। এই জলাশয় বা জলাশয়গুলি মাছ চাষের জন্যও ব্যবহার করা সমীচিন হবে না। তবে জলে প্রাকৃতিক নিয়মে মাছ থাকা ভীষণ জরুরী। জলাশয়ে সংরক্ষিত বৃষ্টির জল ব্যবহারের আগে পরিশোধন করা প্রয়োজন রয়েছে। সমান্তরাল নুড়ি পাথরের ফিল্টার এবং নিম্নমুখী বালির ফিল্টার পরিশোধনের এই ব্যবস্থাগুলি খুব সহজেই পুকুরের জলকে পরিশোধন করতে পারে। এই ধরণের ফিল্টার নূন্যতম প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ লিটার জল পরিশোধন করতে পারে। এই ফিল্টারগুলির রক্ষণাবেক্ষণ সাধারণ গ্রামবাসীরা সম্মিলিতভাবে করতে পারেন। এই রকম ছোট প্রকল্পের জন্য কোন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। আর এই ধরণের একটি ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ১২০০০ লিটার জল সরবরাহ করা সম্ভব হয় এবং এর দ্বারা প্রায় ৩০০ জন গ্রামবাসীর জনপিছু দৈনিক ৪০ লিটার হিসেবে গার্হস্থ কাজের জল পাওয়া যায়।

তাই পরিশেষে আমরা এ কথা বলতেই পারি যে বৃষ্টির জলের সংরক্ষণের দ্বারা আমরা শুধু আমাদের জল সংকটকে মেটাতে পারি তাই নয়, জলের গুণগত প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তারও সমাধান করতে পারি। অর্থাত বৃষ্টির জল হল ঈশ্বরের সেই আশীর্বাদ যা সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে আমাদের জলের গুণগত সমস্যা মেটাতে সহজেই সাহায্য করে।

অরুনাভ মজুমদার
অবসর প্রাপ্ত ডিরেক্টর, অলইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যাণ্ড হাইজিন


Source: Proceedings of Seminar on “ Water Conservation and its Proper Utility” held on 28th April, 2008. Organised by Ashabari in collaboration with Sponsored Teachers’ Training College, Purulia, Purulia Municipality, Rural Development Forum, The Institute of Engineers (India), at Sponsored Teachers’ Training College, Purulia, West Bengal.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading