জলের সুষ্ঠু ব্যবহার


বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ধরে হিসেব করে বলা যায় ২০২৫ সাল নাগাদ এই জনসংখ্যা ২০০ (দুই শত) কোটির কাছাকাছি পৌঁছাবে। আমরা সবাই জানি এখন পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ৮ (আট) কোটি ছাড়িয়েছে। আর এই বিপুল জনসংখ্যার মানুষজনদের জলের চাহিদা মেটানোর জন্য দরকার সূদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

মুখ্যতঃ নিম্নলিখিত কাজের জন্য আমাদের জলের প্রয়োজন হয় -


১) খাবার, রান্নার, স্নানের, জামাকাপড়-বাসনপত্র ধোয়ার, শৌচালয়ে ব্যবহার ইত্যাদি কাজের জন্য।
২) সেচের কাজের জন্য।
৩) শিল্প এবং বানিজ্যের জন্য।
৪) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজের জন্য যেমন – অফিস, স্কুল, কলেজ, হষ্টেল, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে কাজের জন্য।
৫) আগুন নেভানোর জন্য।
৬) গবাদি পশুদের পান করার জন্য বা তাদের স্নানের জন্য।

দেখা গেছে আমাদের গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজের জন্য সবচেয়ে কম জনপ্রতি ৪০ লিটার জল প্রতিদিনে এবং সবচেয়ে বেশি মোটামুটি জনপ্রতি ১৫০ লিটার জল প্রতিদিনে সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে আমরা সকলেই জানি পৃথিবীর তিনভাগ জল এবং এক ভাগ স্থল। পৃথিবীর এই তিনভাগ জলকে বা আমাদের সমস্ত বারিমণ্ডলটিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়-

১) ভূপৃষ্ঠের জল অর্থাত নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-হ্রদ প্রভৃতির জল।
২) ভৌম জল- সছিদ্র শিলা এবং শিলার ফাটল বা ফাঁকের মধ্য দিয়ে যে জল ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জলের ভাণ্ডার গড়ে তোলে বা বাড়ায় তাকেই সাধারণভাবে বলা হয় ভৌমজল।
৩) সমুদ্রের জল- আমরা আমাদের বিভিন্ন সমুদ্রের থেকে যে জল পেয়ে থাকি তাকেই বলে সমুদ্রের জল। সমুদ্রের জল পাণীয় জল হিসেবে গ্রহণ করা না হলেও এ জলও আমাদের বেঁচে থাকার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে।

এ কথা আজ আরো কোন গোপন কথা নয় যে, ভারতবর্ষের জন বিস্ফোরনের জন্য পাণীয় জলের সমস্যা বর্তমানে একটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনগণনার থেকে জানা যায় এখন ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ১১৫ কোটির উপরে। আর বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ধরে হিসেব করে বলা যায় ২০২৫ সাল নাগাদ এই জনসংখ্যা ২০০ (দুই শত) কোটির কাছাকাছি পৌঁছাবে। আমরা সবাই জানি এখন পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ৮ (আট) কোটি ছাড়িয়েছে। আর এই বিপুল জনসংখ্যার মানুষজনদের জলের চাহিদা মেটানোর জন্য দরকার সূদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। বেশিরভাগ জনসংখ্যার জলের চাহিদা সাধারণত মেটানো হয় ভৌমজল থেকে। কিন্তু বর্তমানে জলের বিভিন্ন স্থানের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের কম করে ৮টি জেলায় ভৌমজল আর্সেনিক দূষণে দূষিত এবং কম করে দুটি জেলায় ভৌমজল ফ্লুরাইড দূষণে দূষিত। আর এই আর্সেনিক ও ফ্লুরাইড-এর দূষণ ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ঐ জেলাগুলিতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেইজন্য আমাদের নিজেদের সুস্থ্য রাখতে বর্তমানে ভৌমজলের ব্যবহার যথাসম্ভব কমানো দরকার। সর্বত্র নদীর জল শোধন করে জল সরবরাহ করা সম্ভব নয় এবং ব্যয়সাপেক্ষও. আবার বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমুদ্রের জল শোধন করে পানীয় জলে রূপান্তরিত করাও খুব ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এই পরিপেক্ষিতে শুদ্ধ ও নিরাপদ পাণীয় জল পাওয়ার জন্য এখন আমাদের ভাবতে হবে চিরাচরিত পদ্ধতিগুলির ওপর আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে বলা যায় আমাদের চিরাচরিত পদ্ধতিগুলির নবীকরণের ওপর। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত এবং প্রয়োজনীয় পদ্ধতি হল বৃষ্টির জল সংরক্ষণ। অবশ্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণ একটি অতি সাধারণ ও পুরোনো প্রক্রিয়া। অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ নতুন কোন ব্যাপার নয়। আমাদের রাজ্যে এটি দীর্ঘকাল ধরেই চালু আছে। এখানে যে অসংখ্য পুকুর ছিল সেগুলিতেই প্রতি বর্ষা ঋতুতে এবং যখনই বৃষ্টি হত সেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হত। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ এবং আমাদের উদাসীনতায় এগুলির বেশিরভাগই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অনেক পুকুর আজ বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা আমাদের অজ্ঞানতার জন্য সেই পুকুরগুলি বুজিয়ে ফেলেছি এবং এখনও অনেক পুকুর বুজিয়ে ফেলছি। আমাদের জলের সমস্যার সহজ ও সাধারণ প্রতিকারের উপায় হল স্থানীয় মানুষদেরকে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এই হারিয়ে যাওয়া পুকুরগুলিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা অবিলম্বে শুরু করা। দরকার। এই হারিয়ে যাওয়া পুকুরগুলিই পারে আমাদের এই বর্তমান অসহনীয় জল কষ্টের এবং জল দূষণের অবস্থার থেকে বার করে আনতে। কারণ আমরাতো জানি জল সমস্য সভ্যতার সংকটের সমতুল্য। তাই জলের সংরক্ষণের সাথে সাথে আমাদের প্রয়োজন জলের সুষ্ঠু ব্যবহারের। অপচয় জলের আভাবকে যেমন ত্বরাণ্বীত করে, তেমনি জলের সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবেও তৈরী হয় জলের সংকট। তাই জলের অভাব এবং জলের দূষণকে পিছনে ফেলতে প্রয়োজন জলের মিতব্যায়ীতা বা জলের সুষ্ঠু ব্যবহার।

সুজিত কুমার ভট্টাচার্য্য
অবসর প্রাপ্ত মুখ্যবাস্তুকার, কলিকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলাপমেণ্ট অথরিটি


Source: Proceedings of Seminar on “ Water Conservation and its Proper Utility” held on 28th April, 2008. Organised by Ashabari in collaboration with Sponsored Teachers’ Training College, Purulia, Purulia Municipality, Rural Development Forum, The Institute of Engineers (India), at Sponsored Teachers’ Training College, Purulia, West Bengal.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading