জলও এক প্রকার ঔষধ


জল শুধু জল নয় l এটি একপ্রকার ঔষধও l তাই জলকে অমৃত বলা হয় l প্রাকৃতিক ‘জল চিকিত্সা’ জলের এই গুণের ওপরই আধারিত l এই চিকিত্সায় জলের ব্যবহার কিভাবে করা হবে তার উপরই জোর দেওয়া হয়, যাতে ঔষধ রূপে জল আমাদের রক্ষা করে l জলের ঠিকঠাক ব্যবহার এই চিন্তাধাররই একটি অঙ্গ l

.হাওয়া বা বাতাসের পরই আমাদের জীবনে দ্বিতীয় মহত্বপূর্ণ স্থান হল জলের l বায়ু ও জল ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না l আমাদের শরীরও ৭০ শতাংশ জল দিয়ে গড়া l আমাদের শরীর ও এই ব্রহ্মাণ্ড পঞ্চ মহাভূত দিয়ে অর্থাত্- ক্ষিতি, অপ, মরুত, ব্যোম, ত্যেজ দিয়ে তৈরী l তাই আমাদের জীবনে জলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে l

সকালে ঘুম থেকে ওঠার থেকে শুরু করে রাত্রে শোয়া পর্যন্ত আমরা অনেক ভাবে, অনেক প্রকারে জলের ব্যবহার করে থাকি l চায় সেটা বাহ্যিক রূপেই হোক বা আভ্যন্তরিক রূপে l প্রতিদিন স্নান করা থেকে শুরু করে জল পান পর্যন্ত আমরা সবসময় জলের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকি কিন্তু কখনও আমরা এটা ভেবে দেখেছি কি যে এই জল আমাদের জীবনে ‘সঞ্জীবনীর’ কাজ করতে পারে? আমাদের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে l আর শুধু তাই নয় অনেক প্রকারের রোগ থেকে আমাদের রক্ষাও করতে পারে l

বাস্তবে জল আমাদের জীবনে অমৃত স্বরূপ l মরুভূমিতে যদি পিপাশার্ত মানুষ জল পায় তাহলে তা তার জন্য অমৃত-ই l

আমাদের পুরোনো দিনের বই-গুলিতে স্থানে-স্থানে বিভিন্ন পাতায় জলের মহিমা বর্ণানা করা হয়েছে, জলকে সঞ্জীবনী, অমৃত তথা ঔষধি রূপে সজ্ঞায়ীত করা হয়েছে l

ধর্মগ্রন্থগুলিতেও বিভিন্ন পার্বনের সময় নদী-পুকুরে স্নানের বর্ণনা করা হয়েছে, যা জলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয় l আমাদের অনেক পূজা-পাঠই জল ছাড়া পূর্ণ হয় না l এইভাবে দেখা যায় তো জল সবসময়ই আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়েই রয়েছে l

জলের এই চিকিত্সাত্মক গুণকেই জল চিকিত্সাতে বিস্তারিত করা হয়েছে, যেটি প্রাকৃতিক চিকিত্সা পদ্ধতির অন্তর্গত একটি মহত্ত্বপূর্ণ উপাচার বিধি l জল চিকিত্সার সরল বা অতি সাধারণ অর্থ হল জল দিয়ে বা জলের মাধ্যমে চিকিত্সা করা l

চিকিত্সার দৃষ্টিতে যদি দেখা যায় তো জলের নিজের মধ্যেই অনেক গুণ সমাহিত রয়েছে l শরীরকে ঠাণ্ডা প্রদান করা, শরীরে উত্তেজনা পৌঁছানো, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলিকে সক্রিয় করা, শরীরে জমা বিভিন্ন বিজাতীয় পদার্থকে অবশোধিত করে বাইরে বার হতে সাহায্য করা, শরীরকে পীড়া থেকে রক্ষা করা, শরীরের থেকে কফ বার করতে সাহায্য করা, জ্বলন বা প্রদাহ থেকে রক্ষা করা- এই রকম অনেক গুণ আছে যা জলে সমাহিত রয়েছে l জল চিকিত্সায় জলের এই গুণগুলির প্রয়োগ শরীরকে সুস্থ্য রাখতে ও রোগ থেকে রক্ষা করতে বা রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে।

প্রাকৃতিক চিকিত্সার অন্তর্গত জল চিকিত্সা একটি লোকপ্রিয় পদ্ধতি রূপে প্রচলিত l গরম-ঠাণ্ডা সেঁক, কটি স্নান, বাষ্প স্নান, রীঢ় স্নান, পদ স্নান, বাহু স্নান, পূর্ণ টব স্নান, প্রভৃতি কিছু মহত্ত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রয়েছে যেগুলি রোগ নিরাময়ে ভাল রকম সহায়তা করে l

বাস্তুতপক্ষে জল চিকিত্সায় জলের তাপমাত্রা ও প্রক্রিয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ করে চিকিত্সার সুফল পাওয়া যায় l সেটা পেট ব্যাথা হতে পারে, কৌষ্ঠ্য-কাঠিন্য হতে পারে, আবার স্ত্রীরোগ অথবা কফ-সর্দি-ও হতে পারে l এই রকম অনেক রোগেই জল চিকিত্সা সাফল্যতাপূর্বক নিরাময়ে অত্যন্ত উপযোগী প্রমানিত হয়েছে l

চিকিত্সকেরা মনে করেন রোগ হল- মনোশারীরিক l অর্থাত রোগের প্রাদুর্ভাব মন ও শরীর উভয়েই হয় l তাই চিকিত্সা শুধু শরীরে নয়, মানসিক স্তরেও হওয়া প্রয়োজন l

জল চিকিত্সায় যে ধরণের শুশ্রুষা বা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় তা শরীর ও মন দু’-য়েরই চিকিত্সায় সমান উপযোগী l শুধু তাই নয় এটি অত্যন্ত সরল ও সস্তা l ভালোভাবে বুঝে এর প্রয়োগ ব্যক্তির স্বাস্থ্যলাভ হেতু করা যেতে পারে l মোটা হয়ে যাওয়া, মধুমেহ, উচ্চ-রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, অনিদ্রা, প্রভৃতি রোগগুলি জল চিকিত্সায় খুব ভাল ও সুফল প্রদানকারী পরিণাম পাওয়া যায় l

জল দিয়ে চিকিত্সা বাস্তবে একটি ঘরেলু চিকিত্সা l আমরা সবসময়ই ঘরে জলের প্রয়োগ করে এসেছি এবং করছি l পেটে গরম-ঠাণ্ডা জলের সেঁক এই রকমই একটি সাধারণ প্রয়োগl এর প্রয়োগবিধিও খুবই সরল l

একটি পাত্রে গরম, ও অন্য একটি পাত্রে ঠাণ্ডা জল নেওয়া হয় l জল ততটাই গরম হবে রুগী যতটা সহ্য করতে পারবে l এবার একটি ছোট তোয়ালে গরম জলে চুবিয়ে নিংড়ে নিয়ে পেটের ওপর তিন মিনিট চাপা দেওয়া যাক, তিন মিনিট পর গরম তোয়ালে সরিয়ে পেটে ১ মিনিট ঠাণ্ডা তোয়ালে চাপা দিতে হবে l একই সাথে পর পর তিনবার এই প্রক্রিয়া চালাতে হবে l

গরম সেঁকে সেখানের রক্ত বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে যাতে করে সেই জায়গার রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায় ও বিজাতীয় দ্রব্য নিজের জায়গা ছাড়তে শুরু করে l এই ভাবেই যখন ঠাণ্ডা সেঁক দেওয়া হয় তখন রক্ত বাহিনী সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে ও বিজাতীয় দ্রব্যকে বাইরে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে l তোয়ালের জায়গায় গরম জলের ব্যাগও ব্যবহার করা যেতে পারে l এই গরম-ঠাণ্ডা জলের সেঁক কৌষ্ঠ-কাঠিন্য, প্রদাহ প্রভৃতিতে সুফল প্রদানকারী হয় l যদি মাথা ব্যাথা অথবা কফ-সর্দির সমস্যা হয় তাহলে রাতে সোয়ার আগে কুসুম গরম জলে ১০ মিনিট পা ডুবিয়ে রাখা যেতে পারে l

जल चिकित्साগরম-ঠাণ্ডা জলে সেঁকের মতো গরম-ঠাণ্ডা কটি-স্নানও জল চিকিত্সার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুশ্রুষা l এতে অঙ্গের স্বাস্থ্য ও সবলতা রক্ষা করে l গরম জলে কটি প্রদেশের রক্তকোশগুলি ছড়িয়ে পড়ে, পরিনাম স্বরূপ রক্তে ভিটামিনের মাত্রা বাড়ায় l ঠাণ্ডা জল রক্ত কোষগুলি সঙ্কুচিত হয় আর রক্ত তীব্রভাবে সেখানের দোষ নিয়ে ফিরে যায় l এইভাবে সে রোগ বা দোষ উত্সকারী অঙ্গে পৌঁছে তা শরীর থেকে বাইরে বার করে দেয়। পুরোনো-জীর্ণ কোষ্ঠ কাঠিন্য, মধুমেহ, সাইটিকা, খিদে না হওয়া, কোমর ব্যাথা, মুত্রাশয় বা প্রোস্টেট সমন্ধীয় রোগে এই প্রণালীতে সুফল পাওয়া যায় l

মোটা হয়ে যাওয়া, চর্ম রোগ, গাঁটের ব্যাথা, হাঁপানি প্রভৃতিতে বাষ্প স্নানের পরামর্শ দেওয়া হয় যা স্বেদ গ্রন্থিগুলিকে সক্রিয় করে চামড়ার বিজাতীয় বস্তু শীঘ্রই বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে l এইভাবেই পেটের রোগে- কটি-স্নান, গাঁটের ব্যাথায়- পূর্ণ টব স্নান, মানসিক রোগে- রীঢ় স্নান প্রভৃতি জল চিকিত্সার উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়াl

প্রাকৃতিক চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে জল চিকিত্সার সাথে সাথে সুষম পান-আহারেরও অভ্যাস করা দরকার l এতে শুধু রোগই তাড়াতাড়ি সারে না আগামী দিনগুলিতে রোগের সম্ভাবনাও অনেক কমে যায় l

শরীর থেকে বিজাতীয় পদার্থ বাইরে বার করায় জলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে l জলের প্রয়োগ আমাদের শরীরের অঙ্গগুলির সক্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে ও বিজাতীয় পদার্থ শরীর থেকে বার করতে শরীরকে সাহায্য করে l বহু মানুষ জল পানের অভ্যাস তৈরী হয়নি l

যদি কৌষ্ঠ কাঠিন্যে ভুগছেন তো প্রচুর জল পান করুন ও পেটে গরম–ঠাণ্ডা জলের সেঁক নেন l এমনিতেও সাধারণভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে দিনে কমসে কম ১০ গ্লাম জল পানের পরামর্শ দেওয়া হয় l তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে কম জল খেলে যেমন নির্জলীয়করণ অর্থাত শরীরে জলের কমি হতে পারে ঠিক সেই রকম বেশি জল খেলেও অনেক সময় অসুবিধা হতে পারে l তাই আমাদের প্রয়োজন মত জল পান করে শরীরের সমতা বজায় রাখতে হবে l

অনেক মানুষ ভালভাবে স্নান করেন না, কেননা এটা তারা জলের অপচয় মনে করেন l কিন্তু এটা জেনে রাখা প্রয়োজন যে পরিষ্কার জলে ভালো ভাবে স্নান করলে আমাদের চামড়ার রোমকুপগুলি খুলে যায়, চামড়া জীবন্ত হয়ে ওঠে, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়, যা শরীরকে সুস্থ রাখতে, রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে l

জল চিকিত্সা একটি এ রকম চিকিত্সা যা শুধু রোগ নিরাময়ই করে না, আমরা যাতে অসুস্থ না হই সে ব্যাপারেও আমাদের সাহায্য করে l জল আমাদের ঔষুধের কাজ করতে পারে যদি আমরা বুঝে সুজে প্রয়োগ করতে পারি l জল চিকিত্সায় গরম জল ব্যবহারের সময় সঠিক পাত্রের ব্যবহার দরকার l সাধারণ জলের প্রয়োগ যেমন ঠাণ্ডা জলের পট্টি, পেটে জলের পট্টি প্রভৃতিতে সাথে সাথেই সুফল পাওয়া যায়। তবুও শেষ করার আগে এ কথা অবশ্যই বলে নেওয়া যায়, পুরোনো রোগের চিকিত্সার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত l

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading