কুণ্ড


ভূমিকা


জল নিয়ে দেশে, সব ধর্মে নানা কাহিনীর দেখা মেলে। মানব সভ্যতার আদি অবস্থান বহমান নদীগুলোর পাড়-বরাবর - আজকের ঊষর অংশ বলে পরিচিত ভূখণ্ডগুলো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ছিল - মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু সভ্যতাl আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। নগর-সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক নির্দশনমতে গঙ্গার দু-পাড় ছাড়া উত্তর-পশ্চিম ভারতে বহু প্রাচীন জনপদের নিদর্শন পাওয়া গেছে। আবার জলের সমস্যা সংকটের আকার নিলে প্রাচীন সভ্যতার নাভিশ্বাস উঠেছে এমন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও উদাহরণ বিরল নয়। জনপদের বিস্তৃতি প্রথম দিকে জলের চলাচলের পথ ধরেই ঘটেছে। নতুন বাসস্থানের সন্ধানে পাড়ি-জমানো গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ জলের ধারে-ধারে অস্থায়ী আস্তানা গড়েই অগ্রসর হয়েছে।

ডারউইন সাহেবের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে, বা মা ষষ্ঠীর কৃপায় মানব প্রজাতির সদস্য সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, ফলে জল ব্যবহারের আগের সমীকরণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে চিরকালের মতো। নগর-সভ্যতা ও তার হাত ধরে আসা ইউরোপীয় বাণিজ্যিক ও আগ্রাসী মতাদর্শ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের পরিবর্তে অপচয়ের দর্শনের জন্ম দিয়েছে। এই দর্শন মানবজাতির সাধারণ জ্ঞান ভাণ্ডারের প্রয়োজনীয় সাধারণ গুণগুলি আহরণের পরিবর্তে অপব্যবহারের বিষয়টি আত্মস্থ করে ধরণীকে আজ নীলকণ্ঠ, রিক্তপ্রায় করে তুলেছে। জলের লভ্যতার ক্ষেত্রে এই বর্ণনা আরও বেশি করে ঘটেছে।

ইউরোপীয় আগ্রাসী মতাদর্শ যত দিন এ দেশের মাটিতে শেকড় গাড়েনি, তত দিন প্রাচ্য দর্শনের অনুসারী অপচয়ের পরিবর্তে মিতব্যয়িতা সমাজের মান্যতা পেত। সে যুগের জলের সমস্যা সংকটের রূপ পরিগ্রহের আগেই ভারতের গ্রাম সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এ কথা আপাত - শুখা তালুকগুলোর জন্য বেশি করে সত্যি।

‘কুণ্ড’ নামক এই বইটিতে রাজস্থানের আজকের নিরিখে শুখা তালুকগুলোর প্রাচীন জলাকর্ষণ ও সংরক্ষণের কিছু চিত্তাকর্ষক বিবরণ গ্রথিত হয়েছে। বইটির ছত্রে-ছত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের ঘনীভূত প্রজ্ঞা তার নিজস্ব দীপ্তি নিয়ে ভাস্বর।

বহু ক্ষেত্রেই তা কালের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আধুনিক প্রকৌশলকে (পড়ুন ইউরোপের সমাধানকে) ব্যঙ্গ করছে। প্রকরণের দিক থেকে সঠিক, প্রয়োগের দিক থেকে যথাযথ, প্রয়োজন মেটানোর সক্ষম অথচ দেশজ এই পদ্ধতিগুলো সাধারণভাবে কেন এত অপরিচিত, অব্যবহৃত এবং অবজ্ঞাত তা বিশেষ কৌতূহল উদ্রেক করে।

এই বইটির সতর্ক পাঠে এই মৌলিক প্রশ্নগুলো না-উঠেই পারে নাl গ্রন্থপাঠ শেষ হলে পাঠকের জিজ্ঞাসা শুরু হয়, শুরু হয় অন্বেষণ। সেই অন্বেষণ ও আকুতির থেকে পুনর্বার পাঠে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে।

এমন কি সম্ভব যে এই বইয়ে বর্ণিত প্রকৌশল, পদ্ধতি ও প্রকরণ যে-কোন সাধারণ অবস্থায় অনুকরণযোগ্য নয়, হয়তো নানা কার্যকারণ সম্পর্কের এক বিশেষ টানাপোড়েনের ফলে কিছু প্রাচীন প্রকরণ টিকে গেছে?

সাধারণভাবে আজকের ভৌগোলিক অঞ্চলগুলো সুদূর অতীতে প্রায় নিশ্চিতভাবেই আজকের মতো ছিল না। প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে তারা ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের যাত্রাপথে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, আজকের অবস্থা অতীতের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল – রাজস্থানেরও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। কুণ্ড বা রাজস্থান বা আরও বড় পরিপ্রেক্ষিতে শ্রী অনুপম মিশ্রের লেখা এই দেশের প্রাচীন জল-সংরক্ষণ ব্যবস্থার যে অসাধারণ শ্রমসাধ্য ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলি আাছে তার প্রত্যেকটির মধ্যেই একটি সাধারণ দিক রয়েছে। ‘সমাজ’ নামক এক বিমূর্ত প্রতিষ্ঠানের জবানিতে তিনি প্রাচীন জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার পটভূমিকা-সহ বর্ণনার নানা দিক, ঊষা থেকে গোধূলি যেমন ক্রমে ক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে এক দশা থেকে অন্য দশায় উপনীত হয়, ঠিক তেমনি তিনি প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ‘সমাজ’এর চোখ দিয়ে আলোকপাতে প্রয়াসী হয়েছেন।

ইতোমধ্যে নদীপথে অনেক জল, অনেক নির্দয় নিদাঘ ও বর্ষণমন্দ্রিত বত্সর অতিক্রান্ত হয়েছে – কিন্তু অনুপমের সমাজকে কালের সেই চিরচঞ্চল গতি কী যাদুস্পর্শে যেন তার অভিঘাত থেকে বঞ্চিত করেছে। আর খটকা লাগছে ঠিক এখানেই।

কুণ্ড-র বর্ণনায় বা রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ অথবা দেশের অন্যান্য স্থানের জল-সংরক্ষণ নীতির বর্ণনায় কুণ্ড স্থাপন, দীঘি খনন বা সংস্কারের ক্ষেত্রে যে-জমির ওপর এই মহান ক্রিয়াকলাপ সংগঠিত হচ্ছে তার মালিকানার প্রশ্ন নিয়ে অনুপম নীরব। মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন না-থাকলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্নে সমাজে অর্থনৈতিক বর্গের যে-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তার দেখা মিলবে না। কিন্তু আধুনিক ভারতে এই দ্বন্দ্ব নেই এমন স্থান, সমাজের কোণ, অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে বিরল। তাই এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা, এমন আটপৌরে অথচ রূপায়ণযোগ্য কৌশল মনে হয় সারা দেশের শুখা তালুকের জন্য বৃহত মাত্রায় এবং সর্বত্র অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠবে না। এমনকী রাজস্থানের সব জেলার জন্যও হবে কি না, তা বলা দুরূহ। এ বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাজস্থানেরই আলোয়ার জেলার তরুণ ভারত সংঘের জল সংরক্ষণ বিষয়ক যে ব্যাপ্ত ক্রিয়াকলাপ, কয়েক মাস আগে তার কিছুটা দেখার সামান্য সুযোগ মিলেছিলl শীতের শেষ, গ্রীষ্মের আগমনের সময়কাল সেটি। তরুণ ভারত সংঘের আতিথেয়তায় তাঁদের কাজের কয়েকটি ক্ষেত্র ঘুরে দেখতে গিয়ে এই বিষয়টি আরও অস্বস্তিতে ফেলল। মণ্ডলবাস নামক এক গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছি, যানবাহনের রাস্তা শেষ এবং হাঁটা-পথের শুরু। রুক্ষ, শুষ্ক প্রান্তর ও বেশ উঁচু টিলা পেরিয়ে অপর প্রান্তে পৌঁছানোর পর টলটলে জলভর্তি বেশ কিছু দীঘি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এই শুষ্ক, রুক্ষ মরুসদৃশ ভূমি কেমন করে যেন প্রাণদায়িনী জলের স্পর্শে নবীন হয়ে উঠেছে। পুকুরের স্থানগুলো দেখলাম ক্ষেত্রফলে বিশাল, লম্বা ও চওড়ায় একশো ফিট করে হবে হয়তোl দশ হাজার বর্গফুট স্থান সহসা পাওয়া দুষ্কর। শুনলাম, অতি অনুর্বর জমি বলে তার কোন দাবিদার নেই, পুরো জমিটিই গ্রামের কয়েক ঘর পরিবার মিলে ব্যবহার করেন। জনপ্রতি জলের লভ্যতা চিরবহমান নদীর পাড়ের মানুষদের চেয়েও বেশি হবে হয়তো।

সারিসকা যাওয়ার রাস্তাটি ঘাট অঞ্চল পেরিয়ে যেতে হয়। ঘাটের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছশো-সাতশো ফিট হবে। ছোট, বড়, মাঝারি নানারকমের পাঁচিল দিয়ে পুরো ঢালটিকেই জলসংগ্রহ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একটি ছোটখাটো উপত্যকা পরিকল্পনার সমতুল। এই বিশাল সংগ্রহ-এলাকা থেকে জল গেছে দুটি বা তিনটি গ্রামে। এই সংগৃহীত জল যে তথাকথিত জলাধারে জমা হচ্ছে, তার প্লাবনভূমিও বিশালl দুটি সবচেয়ে নিকটবর্তী লোকালয়ের মধ্যে দূরত্ব অন্তত পাঁচ কিলোমিটার হবে। মনে পড়ল নর্মদা নদী পাড়ের গ্রামগুলোর কথাl প্রায় গায়ে-গায়ে। প্লাবন ভূমির চিহ্ন মাত্র নেই।

এর বিপরীতে তরুণ ভারত সংঘের একই জেলার অন্য একটি অংশে গেছি। এখানে তরুণ ভারত সংঘের জলসংরক্ষণের আদি চিন্তার ফলে নবজাগরণ এসেছে, গ্রামের লোকেরা প্রকৃত স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বাঁধ মজবুত করেছেনl টলটলে জল, কিন্তু পুরো গ্রামটি প্রায় শূন্য। পুরোনো বাংলা উপন্যাসের কলেরা, ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে-যাওয়া গ্রামের গুল্মহীন, বৃক্ষহীন, মধুক্ষরা পাখী গেছে চলে। চারণভূমি নেই। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শেষের দিন গুণছেন। গ্রামে চাষ, প্রাণী পালন, বৃক্ষ রোপণ নিষেধl কেননা এই আপাত-পতিত জমির মালিকানা বন দপ্তরের, গ্রামের তিনপাশের বিরাট পতিত জমিগুলো একটি অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্তl পুণ্যসলিলা জলরাশি বহমান, কর্ষণে সুপটু কৃষকের অভাব নেই, কিন্তু অর্থনৈতিক বর্গে বিভক্ত সমাজের মালিকানার প্রশ্নটি এখানে সজোরে উপস্থিত থাকায় শস্য-শ্যামলা ছায়াসুনিবিড়ি শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলির দেখা মিলল না।

পুরো আলোয়ার জেলা জুড়ে তার জলসংগ্রহ এলাকা ও সেবিত এলাকার পরিমাণ সরকারি অনেক ক্ষুদ্র উপত্যকা প্রকল্পের সমতুল্য। কিন্তু এই সব সরকারি প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশজোড়া আন্দোলনে রত যে-অর্থনৈতিক বর্গের মানুষরা, রাজস্থানে তাঁরাই এই উন্নয়ন যজ্ঞের মূল পুরোধা। এর কারণ জটিলl তবে একটা মূল কারণ অবশ্যই জলের লভ্যতার বহুগুণ বৃদ্ধির ফলে মালিকানাহীন জমির কর্তৃত্ব – অন্তত ছটি গ্রামে এই সাধারণ চিত্র দেখেছি। ভারতের আর কোন অংশে এমন মরুদ্যানের অস্তিত্ব রয়েছে? জল-সংরক্ষণের এই মহাযজ্ঞের হোতারা প্রায়ই মাঝারি থেকে প্রান্তিক স্তরের চেয়ে কিছু ওপরের কৃষক। খুব অল্প কিছু গ্রামে (যেখানে নিষ্করুণ প্রকৃতির খেয়ালে চাষযোগ্য জমির অসম বণ্টন প্রায় অসম্ভব) প্রান্তিক চাষীরা উত্সাহী, কিন্তু সংগঠনে তাদের প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্য নয়।

পুরো অঞ্চলটি সফর করলে অথবা অনুপম মিশ্রের বইগুলি পড়লে তাঁদের বর্ণিত সমাজ একটি আদর্শ সমাজ মনে হবে, যেখানে আধুনিক কলুষতার স্পর্শ নেই, সমাজে অর্থনৈতিক বর্গ নেই, অর্থনৈতিক বর্গের ভিত্তিতে স্বার্থের সংঘাত নেই, জাতপাত নেই, ঋজুরেখ, জটিলতাহীন এক সাম্য সমাজl সেই সমাজের আদর্শ প্রতিরূপ ও তার সংগঠন আজও অনুপস্থিত, তাই জল-সংরক্ষণের প্রকরণও সেই জটিলতার সঙ্গে তাল রেখে লুপ্তপ্রায়।

সারা দেশ জুড়ে সরকারি জল প্রকল্পগুলো বড় ও উঁচু বাঁধের কথা বলেছেl জন-আন্দোলনে কথা বলছে। আলোয়ার জেলার মধ্য চাষিরা তাদের বানানো বাঁধ ক্রমাগত উঁচু করার কথা বলছেন, যাতে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তের মালিকানাহীন জমিগুলো তাঁদের দখলে আসে। প্রাচীন সমাজের সারল্যের কথা বলতে গিয়ে অনুপমের বইয়ে এমন নির্মম সত্য অন্তরালে চলে গেছে। তাঁদের সঙ্গেই কর্মরত দক্ষ প্রকৌশলিক যখন সংগৃহীত জলের অতিরিক্ত অংশটুকু ছোট ফাঁক দিয়ে বের করে দেওয়ার কথা বলেন ( স্থানীয় ভাষায় এর নাম অপরা বা স্পিলওয়ে) তখন পক্ককেশ, পক্কগুম্ফ, পাগড়িধারী উত্তীর্ণ-সত্তর রাজস্থানি কৃষক তাঁর দাবি চোস্ত রাজস্থানী বাগধারা ব্যবহার করে যে-ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন তা সর্দার সরোবর নর্মদা নিগমের ঝকঝকে ছাপা প্রচার-পুস্তিকায় বা গুজরাটের নর্মদা বিষয়ক মন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনেই শোভা পায়l অনুপম-বর্ণিত সমাজের এ-ও এক বাস্তব দিক, যাকে উপেক্ষা করলে এত বড় মানসিক পরীক্ষা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

তবে সমগ্র বইতে যে-আন্তরিকতা, দর্শনের বীণার তারের রিনরিনানি ছত্রে-ছত্রে তা মনের গভীরে মূর্ছনার সৃষ্টি করেl হিমালয় বা সমুদ্রের ব্যাপ্তির সামনে জাগতিক তুচ্ছতা যেমন মুহূর্তেই অন্তর্হিত হয় – প্রথম পাঠে এই সব অতিজাগতিক বাস্তব প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দিয়েও আত্মপ্রকাশে অসমর্থ হয়। কিন্তু ব্যাপ্তি অতিক্রম করে জ্ঞানের যে সীমার শুরু তা ব্যাপ্তির সামনে আমাদের নত মস্তক করালেও জ্ঞানের সীমা বাড়ানোর অদম্য প্রয়াসকে সে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। বহূপাঠে তাই এই সব প্রশ্ন পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে।

তবে এ সব প্রশ্ন হয়তো ঘরপোড়া গরুর সিঁদুর মেঘ দেখে শঙ্কিত হওয়ার সমতুল। শঙ্কিত না-হয়ে প্রয়োজন এই ধী ও প্রজ্ঞার বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল রেখে সংরক্ষণ ও প্রসারণ। কালের প্রেক্ষিতে এই প্রাচীন জ্ঞানকে স্থাপিত করতে না-পারলে তার জরা রোধ করা দুঃসাধ্য – তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় কালনিপাত ছাড়া গতি নাই।

ঐতিহ্যময় জলের ঐতিহ্য


‘প্রবাহিত জলে শ্যাওলা জমে না’ – এই প্রবাদটি রাজস্থানে এসে থমকে যায়। এখানে যে-সব ‘কুণ্ডি’ দেখা যায় তাতে সারা বছর ধরে, এমনকী তার চেয়েও বেশি সময় ধরে জমে-থাকা জলও সম্পূর্ণ নির্মল থাকে ।

ব্যবস্থাটা অবশ্য একই – সেই বৃষ্টির জল অর্থাত ‘পালরপানি’কে এক পরিচ্ছন্ন জায়গায় সংগ্রহ করা। ‘কুণ্ডি’, ‘কুণ্ড’, ‘টাকা’ – নাম অনেক, চেহারাও আলাদা আলাদা, কাজ সেই একই – আজকের বর্ষার প্রতিটি বৃষ্টিবিন্দুকে আগামী- কালের জন্য সংগ্রহ করে রাখা। কুণ্ডি সব জায়গায় পাওয়া যায় l দুর্গম পাহাড়ের ওপর তৈরী দুর্গে, মন্দিরে, পাহাড়ের পাদদেশে, ঘরের উঠোনে, ছাতে, গ্রামের ভেতর, গ্রামের বাইরে নির্জন স্থানে, বালির মধ্যে, চাষের জমিতে – সব জায়গায় সব সময়ে কুণ্ডি তৈরি হয়েছে। তিন-চারশো বছরের পুরনো কুণ্ডি যেমন পাওয়া যায়, সেরকম এই অল্প কয়েকদিন আগে তৈরি হয়েছে এরকম কুণ্ডিও পাওয়া যাবে। এমনকী স্টার টিভি-র অ্যাণ্টেনার ঠিক নিচেই কুণ্ডি তৈরি হয়েছে।

যেখানে যতটা জায়গা পাওয়া সম্ভব – সেখানে সেই জায়গাটুকু চুন-সুরকি দিয়ে পলেস্তরা করে একটা উঠোন তৈরি করে নেওয়া হয়। এই উঠোন হয় ঢালওয়ালা l এক দিক থেকে অন্য দিকে অথবা উঠোন বড় হলে চারপাশে থেকে কেন্দ্রের দিকে রাখা হয় এই ঢাল। উঠোনের পরিসর অনুসারে, বর্ষায় যেখানে যতটা জল বর্ষিত হতে পারে যাতে এক বিন্দু জলও নষ্ট না-হয়, সারা বছর সুরক্ষিত ও পরিষ্কার থাকে।

নিয়ম কঠিন, ব্যবস্থা উদার


বর্ষার সময় চারপাশের যে-উঠোন থেকে কুণ্ডিতে জল আসে তাকে ‘আগৌর’ বলে। শব্দটা এসেছে আগৌরনা ক্রিয়াপদ থেকে। সারা বছরই আগৌর যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বর্ষার আগে তো রীতিমতো যত্নসহকারে চলে আগৌর পরিষ্কারের কাজ। জুতো-চপ্পল এ সব আগৌরে নিষিদ্ধ।

আগৌরের ঢাল দিয়ে বয়ে-আসা জল কুণ্ডিতে জমা হয়। কুণ্ডির ভেতর গোলাকারে রাখা ‘আয়রো’ এবং ‘সুরাথোর’ মধ্যে দিয়ে এই জল কুণ্ডিতে ঢোকে। এগুলি হল এক ধরনের ছিদ্র বা নালি। কোথাও কোথাও এর আরেক নাম ‘ইণ্ডু’। আগৌর যতই পরিষ্কার রাখা হোক, বর্ষার জলে কিছুটা বালি বা খড়কুটো বয়ে আসেই। এই সব ময়লা যাতে কুণ্ডির ভিতর গিয়ে না পড়তে পারে, তার জন্য নালাগুলোতে জাল লাগানো হয়। বড় আকারের কুণ্ডিতে জল সারা বছর টাটকা রাখার জন্য বিশেষ জানালা কেটে আলো হাওয়া ঢোকার ব্যবস্থা করা হয়।

ছোট হোক বা বড়, কুণ্ডি কখনও খোলা থাকে না। সমাজের চোখে সেটা অশোভন। আর জলের কাজে তো শোভা চাই-ই। সৌন্দর্য, শুচিতা, পরিচ্ছন্নতা এখানে একই সঙ্গে বর্তমান l

কুণ্ডির মুখ হবে গোলাকার এবং ঢাকনা গম্বুজাকার l মন্দির, মসজিদের মতো উঁচু হয়ে-ওঠা গম্বুজ দৃশ্যত কুণ্ডিকে সুন্দর করে তোলে। যেখানে পাথরের সুদীর্ঘ স্তর পাওয়া যায়, সেখানে অনেক সময়ে গম্বুজের বদলে পাথরের বড় পাটা ঢাকনা হিসেবে প্রচলিত। গম্বুজ বা পাথরের পাটা, যাতেই কুণ্ডি ঢাকা হোক না কেন, তার এক কোণায় লোহা বা কাঠের আরও একটা ছোট ঢাকনা লাগানো হয়। প্রতিদিনের জল নেওয়ায় এটা কাজে লাগে।

ছোট আবার বড়ও


অনেক কুণ্ডই প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ হাত গভীর। তাই কোন গভীর কুয়ো থেকে যেভাবে জল তোলা হয়, কুণ্ডি থেকে জল তোলার কায়দা-কানুনও সেরকমই। জল তোলার জন্য পাড়, পাড়ে ওঠার জন্য পাঁচ-সাত ধাপ সিঁড়ি। জল তোলার সুবিধার জন্য চরকি বা কপিকল। চুরু অঞ্চলের কয়েক জায়গায় খুবই বড় ও গভীর কুণ্ড দেখা যায়। গভীরতার জন্য এই কুণ্ডগুলিতে যে-চরকি বা কপিকল লাগানো হয় সেগুলো খুবই শক্তপক্ত করা হয়, কারণ অত গভীর থেকে জল নিয়ে বালতি যখন ওপরে উঠতে থাকে তখন তার পুরো ওজনটাই তো পড়ে চরকির ওপর। তাই দু-দিক থেকে দুটি মিনারের মতো স্তম্ভে চরকি বসানো হয় স্থায়ীভাবে। কোথাও কোথাও চার স্তম্ভওয়ালা চরকি আছে, এমন কুণ্ডিও দেখা যায় ।

জায়গা কম পাওয়া গেলে কুণ্ড হয় ছোট। এরকম কুণ্ডের আগৌর করা হয় কিছুটা উঁচুতে। আসলে কোন পরিবার বা সমাজের কাজে লাগছে বলেই তো কুণ্ডের জন্য জায়গার অভাব ঘটেছে। তাই এ ক্ষেত্রে চারপাশের ব্যবহৃত অপরিচ্ছন্ন জমি থেকে ঐ কুণ্ডের আগৌরটিকে আলাদা রাখার জন্যই তা বরান্দার মতো উঁচু করে তৈরি করা হয় ।

চাষের জমি বড় হওয়ায় মরুভূমিতে গ্রাম ও ক্ষেতের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি। ফলে সারা দিন ক্ষেতে কাজ করার জন্য কাছাকাছি জলের উত্স থাকাটা খুবই দরকার। তাই ক্ষেতের মধ্যেই কিছু দূরে দূরে ছোট, বড় কুণ্ডি তৈরি করা হয়।

বালুকাময় এলাকায় যেখানে ভৌমজল একশো, দু’শো হাতেরও বেশি গভীর, যা আবার বেশির ভাগ সময়েই লবণাক্ত, সেখানেও কুণ্ডি পাওয়া যায় l আদিগন্ত বালির ভিতর মাত্র কুড়ি-ত্রিশ হাত গভীর কুণ্ডি l কুণ্ডিতে যে-জল জমা করা হয় তা যদি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বালিতে শুষে যেতে থাকে, তাহলে পরিপূর্ণ কুণ্ড খালি হতেও খুব একটা সময় লাগবে না l তাই কুণ্ডের ভিতর জলনিরোধক পলেস্তরা হয় সর্বোত্তম l ছোট-বড় সব কুণ্ডেই থাকে একশো ভাগ পলেস্তরা l এই কাজে টুকরো পাথর অথবা পাথরের পাটা ব্যবহার করা হয় l দুটো পাথর পর পর বসানো হলে জোড়ের কাছে যে-সূক্ষ্ম ফাঁক থেকে যায়, সেখানে আবার মিহি চুনের প্রলেপ দেওয়া হয় l মরুভূমিতে ত্রিশ হাত গভীর কুণ্ডে পরিপূর্ণ জল রয়েছে অথচ ত্রিশ ফোঁটা জলও বালিতে শুষে নেবে না, কোন বড় বাস্তুকারই এরকম পোক্ত জলনিরোধক পলেস্তরার আশ্বাস নাও দিতে পারতে পারেন, চেলওয়াজ-রা কিন্তু এই আশ্বাস দিয়ে থাকেন l

এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম


যত সাবধানতা নিয়েই আগৌর পরিষ্কার করা হোক না কেন, কিছুটা বালি শেষ পর্যন্ত কুণ্ডে গিয়ে পড়েই l তাই চৈত্র মাসে কুণ্ডের ভিতরে নেমে তা পরিষ্কার করে নিতে হয় l আর এই নামার সুবিধে রাখতেই পলেস্তরা করার সময় কুণ্ডের বৃত্তাকার দেওয়ালে এক হাত অন্তর পাথরের ধাপ বসিয়ে দেওয়া থাকে l

কুণ্ডের মেঝেতে জমা হওয়া বালি যাতে সহজে তুলে আনা যায়, সে ব্যাপারেও থাকে সুচিন্তিত পরিকল্পনা l মেঝেটি তৈরি হয় কড়াইয়ের মতো করে (যাতে সমস্ত বালি এসে কেন্দ্রে জমা হতে পারে) l এর নাম ‘খামারিয়ো’ বা ‘কুণ্ডালিও’ l তবে ওপরে, আগৌরে এত বেশি সাবধানতা বজায় রাখা হয় যে খামারিয়ো থেকে বালি তোলার কাজ দশ থেকে কুড়ি বছর পর এক-আধবার করলেই চলে l একটি প্রজন্ম কুণ্ডকে এতটাই আগলে রাখে যে পরবর্তী প্রজন্মই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সুযোগ পায় l পরবর্তীকালে সরকার কোথাও-কোথাও জল-সরবরাহের আধুনিক ব্যবস্থা করেছে, সে সব স্থানে আজ কুণ্ডিকে বাঁচিয়ে রাখার এই ঐতিহ্য অনেকটাই কমে গেছে l

ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন


ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন, দু-রকম কুণ্ডই দেখা যায় l ব্যক্তিগত হলে ঘরের সামনে, উঠোনে, হাতায়, পিছনে ও বেড়ার পাশে হয়, আর সর্বজনীন কুণ্ড সাধারণত পঞ্চায়েতের খাস জমিতে বা দুটো গ্রামের মাঝখানে করা হয়ে থাকে l বড় কুণ্ডের ভেতর প্রবেশ করার জন্য দরজার ব্যবস্থা থাকে এবং সামনে সাধারণত দুটো চৌবাচ্চা l একটা ছোট, একটা বড়। একটা উঁচু, অন্যটা নীচু l আশপাশের ছাগল, ভেড়া, গরু, উটের জন্য এগুলিতে জল ভরে রাখা হয়। ‘খেল,’ ‘থালা’, ‘হওয়াড়ো’ কিংবা ‘উবরা’ প্রভৃতি নামে এদের ডাকা হয় l

সর্বজনীন কুণ্ড গ্রামের মানুষই তৈরি করেন l জলের জন্য শ্রমদান পুণ্যের কাজ l কোন পরিবার বিশেষ কোন উপলক্ষে সর্বজনীন কুণ্ড নির্মাণের সংকল্প নেন l তবে তার বাস্তব রূপায়ণে গ্রামের সব মানুষই সহযোগিতা করেন l কখনও-কখনও সম্পন্ন পরিবার সর্বজনীন কুণ্ড তৈরি করে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অন্য কোন পরিবারের হাতে তুলে দেন l কুণ্ডের বড় হাতার মধ্যে আগৌরের বাইরে এই পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয় l এই ব্যবস্থা দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই বংশানুক্রমে চলতে থাকে l কুণ্ড নির্মিতা সচ্ছল গৃহকর্তা তাঁর সম্পত্তির একটা অংশ কুণ্ড দেখাশোনার জন্য আলাদা করে রেখে দেন l এ ব্যবস্থাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে l এখনও এসব স্থানে এমন কুণ্ড আছে যেগুলো তৈরি করিয়েছেন যে-পরিবার, তাঁরা হয়তো চাকরির খাতিরে এখন আসাম, বাংলা, মুম্বই বা অন্য কোথাও প্রবাসী, অথচ যে-পরিবারকে কুণ্ড দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা এখনও কুণ্ডতেই বসবাস করছেন l এই সব বড় বড় কুণ্ড এখনও বর্ষার জল সঞ্চয় করে রাখে এবং যে-কোন পৌরসভার সরবরাহ করা জলের থেকে শুদ্ধ ও নির্মল জল সারা বছর দিতে সক্ষম l

পরিকল্পনা নতুন পুরনো


আজ কোথাও- কোথাও ভাঙাচোরা কুণ্ড দেখা যায় l বহু জায়গায় জল খারাপ হয়ে গেছে l এতে এই পদ্ধতিটির কোন ত্রুটি নেই l এ সবই সমাজের ভাঙনের সঙ্গে সমানুপাতিক l বরং বলা যায়, শতাব্দী-প্রাচীন এই ব্যবস্থা বর্তমানের ব্যয়সাপেক্ষ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন পরিকল্পগুলোর ভুল ত্রূটিও ঢেকে দেবার ক্ষমতা রাখে l কিছু দিন আগে এই এলাকা- সমূহে জল সমস্যার সমাধানকল্পে অনেকগুলো নলকূপ ও হ্যাণ্ড-পাম্প বসানো হয় l দেখা গেল সবগুলোর জলই লবণাক্ত l মিষ্টি পানীয় জল এখনও একমাত্র কুণ্ড গুলোতেই পাওয়া সম্ভব l অতএব পরে যখন বুদ্ধি এল, তখন এই কুণ্ডগুলোর ওপরই হ্যাণ্ড-পাম্প বসিয়ে দেওয়া হল l বহুল প্রচারিত ইন্দিরা গান্ধী নহর থেকে এ সব অঞ্চলে কোথাও কোথাও পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল l কিছু ক্ষেত্রে জল সংগ্রহে সরকারি ট্যাঙ্ক তৈরি হল, কিছু ক্ষেত্রে কুণ্ডগুলোকেই ব্যবহার করা হয়েছে l

কুণ্ডগুলি অতীত কালকেও প্রত্যক্ষ করেছে আবার বর্তমানকেও প্রত্যক্ষ করছে। সে হিসেবে এরা সময়সিদ্ধ l এগুলির আরও এক বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণতা l কুণ্ডি তৈরি করতে কখনওই অন্য কোন জায়গা থেকে নির্মাণসামগ্রী আমদানি করতে হয়নি l মরুভূমিতে জল সংরক্ষণের যে-সুবিশাল ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থাপনা চালু আছে, তার সবচেয়ে বড় গুণ হল, যেখানে যে উপকরণ পাওয়া যায় সেখানে তা দিয়েই মজবুত পরিকাঠামো তৈরি করার স্থিতিস্থাপক মানসিকতা l কোন জায়গায় হয়তো বিশেষ একটা উপকরণ পাওয়া যায়, কিন্তু অন্যত্র সেটা নেই – তবুও সেখানেও কুণ্ডি হবে l

যেখানে পাথরের পাটা পাওয়া যায়, সেখানে কুণ্ডের প্রধান অংশ তৈরি হয় এই পাটা দিয়েই l কোথাও হয়তো পাথর নেই, কিন্তু ফোগ গাছ আছে l ফোগের কাঠ দিয়েই হবে এ কাজ l ফোগের ডাল দিয়েই কুণ্ডের গম্বুজাকৃতি ঢাকনাটি তৈরি হয় l ডালগুলিকে একটাকে অন্যটার সঙ্গে গেঁথে, ফাঁস লাগিয়ে এই কাঠামোটি তৈরি করা হয় l এর ওপর বালিমাটি ও চুনের মোটা প্রলেপ দেওয়া হয় l গম্বুজের ওপরে ওঠার জন্য ভেতরে গাঁথা কাঠের কিছু অংশ বাইরে বার করা থাকে l মাঝখানে জল তোলার জায়গা l বর্ষার জল কুণ্ডের চারপাশের সেই আয়রো অর্থাত নালা বা ফুটো দিয়েই ভেতরে যায়, তবে পাথরের কুণ্ডির গায়ে যেমন অনেকগুলো ফুটো থাকে, ফোগ কাঠের কুণ্ডতে তা থাকে না l এখানে ফুটো সব সময়ে একটা l কুণ্ডের ব্যাস হয় সাধারণত সাত,আট হাত এবং উচ্চতা প্রায় চার হাত l আর যে ফুটোটি দিয়ে জল কুণ্ডে প্রবেশ করে তা এক বিত্তা l বর্ষার জল কুণ্ডিতে জমা হয়ে গেলে পর এই ফুটোটি কাপড়ে জড়ানো একটি খিল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় l ফোগ গাছের কুণ্ডগুলো চারপাশে আলাদা আলাদা আগৌরের বদলে একটাই বড় আগৌরের ভেতর নির্মাণ করার চল আছে l অনেকটা কুঁইয়ের ধরনে l আগৌরের পাশে লেপা-পোঁছা ঘর আর সেরকমই পরিচ্ছন্ন কুণ্ডগুলো চারপাশে ছড়ানো সীমাহীন মরুভূমির ভেতর যেন পরস্পরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে থাকে l

বালিতে ছড়িয়ে থাকা কুণ্ড

রাজস্থানের মানুষের রঙের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ দেখা যায় l জীবনের সুখ-দুঃখের ওঠাপড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এখানে লেহেঙ্গা, ওড়না আর জমকালো রঙের পগড়িগুলোও রঙ পালটায় l কুণ্ডি কিন্তু হবে শুধু সাদা রঙের l প্রখর রোদ আর প্রচণ্ড গরমের এই এলাকায় কুণ্ডিগুলিতে যদি গাঢ় রঙের প্রলেপ দেওয়া হয় তাহলে তা বাইরের উত্তাপ শুষে নিয়ে ভেতরের সঞ্চিত জলকেও প্রভাবিত করবে l তাই এই রঙিন সমাজও কুণ্ডিতে শাদা ছাড়া আর কোন রঙ চাপায় না l সাদা রঙ রৌদ্রকে প্রতিফলিত করে l ফোগ কাঠে তৈরি কুণ্ড রৌদ্রে চট করে গরমও হয় না, ফেটেও যায় না l ভেতরের জলও অনায়াসে ঠাণ্ডা থাকে l

কিছু দিন আগে এক সরকারি বিভাগ তাদের পরিকল্পনা অনুসারে ফোগের তৈরি কুণ্ডিগুলির ওপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় l গম্বুজ তৈরিতে ফোগের বদলে সিমেণ্ট ব্যবহার করা হয় l যারা এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তারা ভেবেছিল নতুন এই কুণ্ডিগুলি বেশি মজবুত হবে l কিন্তু সেরকম হল না l সিমেণ্টের গম্বুজ রাজস্থানের প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে কুণ্ডের ভেতরেই ভেঙে পড়ল l এই নতুন কুণ্ডিগুলিতে ভেতরের পলেস্তরার কাজও চুন-সুরকির বদলে সিমেণ্ট দিয়ে করা হয়েছিল l তাই সেখানেও অসংখ্য ফাটল দেখা দিল l এবার এই ফাটল বন্ধ করতে আলকাতরা ব্যবহার করা হল l মরুভূমির প্রচণ্ড উত্তাপে আলকাতরা গলে গিয়ে বর্ষায় সঞ্চিত সমস্ত জল সেই ফাটল পথে বালির ভেতর চলে গেল l শেষ পর্যন্ত সেখানকার মানুষ আবার ফোগকাঠ ও চুনসুরকি দিয়ে স্বয়ংসিদ্ধ কুণ্ডি তৈরি করে নিতে বাধ্য হন l আধুনিক উপকরণ যে জলসংকট ডেকে এনেছিল তার সমাধান হল এই ভাবে l

খড়িয়া পাথরের কুণ্ড


মরুভূমিতে কোথাও কোথাও খড়িয়া পাথরের স্তর কম গভীরেই অর্থাত মাটির মাত্র চার-পাঁচ হাত গভীরেই পাওয়া যায় l ফলে এরকম জায়গায় কুঁই হওয়া সম্ভব নয় l রেজানি জলের ভাণ্ডার থাকলে তবেই কুঁইতে জল জমে l কিন্তু খড়িয়া পাথর যদি কম গভীরতাতেই থাকে, তাহলে সারা বছর কলসি ভরানোর মতো জল পাওয়া যাবে না l তাই এ সব এলাকায় কুণ্ড তৈরিতে খড়িয়া পাথর ব্যবহার করা হয় l পাথরের বড়-বড় চাঁই খাদান থেকে ভেঙে এনে কাঠের আগুনে পোড়ালে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তা ফেটে গিয়ে ছোট ছোট টুকরো হয়ে যায় l এবার এগুলো গুঁড়ো করে নেওয়া হয় l আগৌর নির্বাচন করে কুণ্ড খোঁড়ার পর ভেতরের পলেস্তরা ও গম্বুজ বানাতে এই গুঁড়ো ব্যবহার হয় l পাঁচ-ছয় হাত ব্যাসওয়ালা গম্বুজগুলো পুরু থাকে এক বিত্তা। এর ওপর দু’জন মহিলাও যদি দাঁড়িয়ে জল তোলেন তাহলেও কুণ্ড ভাঙবে না l

মরুভূমিতে কোথাও কোথাও পাথরের চাটানও পাওয়া যায় l এই চাটান থেকেও প্রয়োজনীয় পাথর পাওয়া সম্ভব l এরকম পাথর দিয়ে বিশাল বিশাল কুণ্ড তৈরি হয় l চাটান থেকে পাওয়া পাথরের পাটাগুলো প্রায় দু-হাত চওড়া ও চোদ্দ হাত লম্বা হয় l তাই যত বড় আগৌরই হোক আর তাতে যত জলই পাওয়া যাক, এই পাথর দিয়ে ঢেকে তত বড়ই কুণ্ডি বানিয়ে ফেলা সম্ভব l

ঘর ছোটই হোক বা বড়, কাঁচাই হোক বা পাকা, কুণ্ড কিন্তু সব সময়ে পাকাপাকি ভাবেই তৈরি হবে l মরুভূমিতে এক একটা গ্রাম পরস্পরের থেকে অনেক দূরে l জনসংখ্যাও কম l এই রকম ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলিতে জল-সরবরাহের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব l তাই এখানকার সমাজ জল সংক্রান্ত সমস্ত উদ্যোগ যতটা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ করে তার দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে বিন্দু বিন্দু ভাগ করে নিয়েছেন l ফলে পুরো বিষয়টা নীরস অথবা যান্ত্রিক একটা অভ্যাস না হয়ে সামগ্রিক এক চেতনায় পরিণত হয়েছে l কুণ্ডিকে যে কত সুন্দর করে তোলা যায় তা বোঝা যায় জয়সলমেরের গ্রামগুলিতে গেলে l

জমকালো রঙে সজ্জিত কুণ্ড


এক একটা গ্রামে বড়জোর পনেরো থেকে কুড়িটা পরিবারের বাস l বর্ষা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম l প্রতিটি ঘরের সামনে দেখা যাবে বড়মতো একটা বারান্দা তৈরি করা হয়েছে l বারান্দার ওপরে ও নিচের দেওয়ালে রামরজ, হলুদমাটি, গিরিমাটি দিয়ে সুন্দর আলপনা করা l মনে হয় যেন বা একটা রঙিন গালিচাই বিছানো রয়েছে l এই বারান্দার ওপরই গৃহস্থলির প্রতিদিনের সমস্ত কাজ l আনাজপাতি শুকনো, বাচ্চাদের খেলা, বড়দের মজলিশ বসে, আর ঘরে অতিথি এলে রাত্রে তার শোয়ার ব্যবস্থাও হয় এই বারান্দাতেই l তবে এটা কিন্তু শুধু একটা বারান্দাই নয়, এটা একটা কুণ্ডও l ঘরের ছাদ, উঠোন, এমনকী সামেন মাঠের ওপর বির্ষত জলের সমস্তটুকুই এই কুণ্ডতে জমা হয় l কোন বছর যদি কুণ্ড না ভরে তাহলে কাছের বা দূরের কোন কুয়ো বা পুকুর থেকে জল এনে কুণ্ডটি ভরিয়ে নেওয়া হয়l

কুণ্ডি, কুণ্ডর মতই হল ‘টাকা’ l টাকাতে সাধারণত উঠোনের বদলে ছাদের ওপর বর্ষিত জল সংগ্রহ করা হয় l যে বাড়ির ছাদ যত বড়, সেই অনুপাতে সে বাড়ির টাকাও তত বড় l তা ছাড়াও পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও জলের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে টাকার আয়তন। মরুভূমিতে গ্রাম বা শহরের বাড়িগুলোর ছাদ একটু ঢাল রেখে তৈরি হয়, যাতে বর্ষার জল গিড়য়ে এসে টাঁকাতে জমা হতে পারে l ঢালের মুখের দিকে একটি নালা রাখা হয়l এতে জলের সঙ্গে বয়ে আসা ময়লা আটকানোরও ব্যবস্থা থাকে l ফলে পরিষ্কার ছাঁকা জল নীচের কুণ্ডে গিয়ে জমা হয় l দশ বারো জন সদস্যের একটি পরিবারের টাঁকা প্রায় পনেরো-কুড়ি হাত গভীর ও প্রায় ততটাই লম্বা চওড়া হয়ে থাকে l

ঘরের মধ্যে টাকা


এই টাকা কোন ঘর, বৈঠকখানা বা উঠোনের নিচে থাকে l এটি পাকাপাকিভাবে ঢাকা থাকে l এক কোণে থাকে টাকার মুখ, তাতে পরিষ্কার ঢাকনা লাগানো। এই জলই সারা বছরের পানীয় এবং রান্নার কাজে ব্যবহার হবে l তাই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে ছাদে কেউ চটি বা জুতো পরে ওঠে না l গরমকালে ঘরের লোকজন অবশ্যই ছাদে শোয় কিন্তু অভোধ শিশুদের এমন জায়গায় শোয়ানো হয় যে অংশটা টাকার সঙ্গে যুক্ত নয় l ছোট শিশু বিছানা ভিজেয়ে ফেলতে পারে তাতে ছাদের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হবে l

নলের জলকে লজ্জা দিয়ে থাকে কুণ্ড


প্রাথমিক সাবধানতা হল — ছাদ, নালা ও তার সঙ্গে যুক্ত টাকা যেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে l তবুও কয়েক বছর অন্তর গরমকালে অর্থাত বর্ষার ঠিক আগে, যখন টাকায় সব থেকে কম জল থাকে, তখন ভেতরে ঢুকে সেটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয় l ভেতরে নামার জন্য ছোট-ছোট সিঁড়ি এবং মেঝেতে সেইরকমই কড়াইয়ের মতো খামাড়িয়ো, যাতে ভেতরে চলে যাওয়া ময়লা সহজে তুলে নেওয়া যায়। কোথাও কোথাও ছাদ ছাড়াও সামনের বড় উঠোনটিকেও টাকার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় l তখন জল-সংগ্রহের ক্ষমতাও দ্বিগুণ হয়ে যায় l যদিও এই টাকাগুলি ব্যক্তিগত, তবুও ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দেখলে পুরো পাড়াই এর সামনে জড়ো হয়। ব্যক্তি নৈর্ব্যক্তিকে মিশে যায় l

পাড়া, গ্রাম অথবা শহর ছাড়াও সুদূর নির্জনেও টাকা তৈরি হয় l যাঁরা এগুলির নির্মাতা তাঁরা নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্যই এ কাজ করেন l প্রভুত্ব বিসর্জন দেওয়ার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কোথায় আছে l এই টাকাগুলো বিশেষ করে পশুপালক ও বাগাল ছেলেদের কাজে লাগে l সকাল বেলা কুপাড়ি ভর্তি জল নিয়ে বেরিয়ে যায় যে রাখাল বালক, দুপুর পর্যন্ত চারণ ভূমিতে পৌঁছানোর আগেই তার কুপড়ি খালি হয়ে যায় l তখন কাছে পিঠেই সে পেয়ে যায় এরকম একটি টাকা l প্রতিটি টাকায় দড়িতে বাঁধা একটি বালতি, নিদেনপক্ষে একটা টিনের কৌটো হলেও থাকে l দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাময় এলাকা, সেখানেও যদি কিছুটা পাথুরে বা কাঁকুরে মাটি পাওয়া যায় তাহলে সেখানেও টাকা তৈরি হবে l এ ক্ষেত্রে জলের পরিমাণ নয়, জল সংগ্রহ করতে পারাটাই গুরুত্বের বিষয় l বালির টিলার মাঝে ছোট ছোট জায়গা, সেখানে অল্প হলেও জল জমা হয়, এগুলোকে ‘চররো’ বলে l চররো-তে জমে থাকা জলও টাকায় ভরে নেওয়া হয় l এই রকম টাকার পাশে পাশে আল দিয়ে জল সংগ্রহ কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া হয় l

আধুনিক হিসেব অনুযায়ী, অতি ছোট কুণ্ডি বা টাকাতেও প্রায় দশ হাজার লিটার এবং মাঝারিগুলোতে পঞ্চাশ হাজার লিটার জল জমা করা সম্ভব l বড় আকারের টাকাগুলি হল লাখপতি, লক্ষাধিক লিটার জল এতে ধরা থাকে l

কোটিপতি টাকা


সবচেয়ে বড় টাকাকে কোটিপতিই বলুন l এতে ষাট লক্ষ গ্যালন অর্থাত প্রায় তিন কোটি লিটার জল ধরে l আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে জয়পুরের কাছে জয়গড় দুর্গে এটি তৈরি হয়েছিল l একশো পঞ্চাশ হাত লম্বা ও চওড়া এবং চল্লিশ হাত গভীর এই বিশাল টাকাটির প্রশস্ত ছাদ, জলে ডুবে থাকা একাশিটি থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে l ভেতরে আলো, হাওয়া ঢোকার জন্য রয়েছে জানালার ব্যবস্থা l এর জল সারা বছর টাটকা ও শীতল থাকে l ভিতরে ঢোকার জন্য টাকার দুই প্রান্তে দুটো দরজা l একটা গলি দিয়ে দরজা দুটোকে যুক্ত করা হয়েছে এবং দু-দিক থেকেই নিচে জলের কাছে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি রয়েছে l সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বাঁকে করে জল ওপরে তুলে আনা হয় l বাইরের জানালা থেকে যখন কারও ছায়া স্তম্ভের মাঝ দিয়ে জলের ওপর পড়ে, তখন বোঝা যায় যে জল কতটা নীলাভ l এই নীল জল দুর্গ বা গড়ের আশপাশের ছোট ছোট নালা দিয়ে একটা বড় নালা বা পরিখায় এসে পড়ে l রাস্তার মতো চওড়া এই পরিখা পুরোপুরি দুর্গের সুরক্ষা বজায় রেখেই গড়ের দেওয়ালের তলা দিয়ে ভেতরে পৌঁছেছে l

বর্ষার আগে নালাগুলো পরিষ্কার তো করা হয়ই, তা ছাড়াও বর্ষার প্রথম জল টাকার ভেতর ঢোকানো হয় না l প্রধান টাকা ছাড়াও আরোও দুটো টাঁকা আছে l একটা খোলা, একটা বন্ধ l এদের সামনে এসে বড় নালার মুখে ফটক লাগানো হয়েছে l ফটকটি খোলা বা বন্ধ করা যায়। প্রথমে প্রধান টাকার দিকে বয়েচলা নালার ফটক বন্ধ করে দিয়ে খোলা টাকার মুখ খুলে দেওয়া হয় l প্রথম দফার জল নালাগুলিকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে খোলা টাকায় গিয়ে পড়ে। এর পর তার সঙ্গে সংলগ্ন টাকায়। এই টাকাদুটির জল পশুদের কাজে লাগত l জয়গড় ছিল পুরোদস্তুর এক দুর্গ এবং কোন এক সময়ে গোটা একটা সৈন্য বাহিনীই এখানে থাকতো। সৈন বাহিনীর হাতি, ঘোড়া, উট সকলের জন্যই প্রতিদিন প্রচুর জলের প্রয়োজন ছিল l তা ছাড়া এত বড় দুর্গ পরিষ্কার করার জলও নেওয়া হত ঐ দুটো টাঁকা থেকেই l

জল সম্পদের ভাণ্ডার


যখন জল আসার সব নালা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যেত তখন প্রথম ফটক বন্ধ হত এবং প্রধান টাকার ফটক খুলে যেত l এই বিশাল টাকা তখন তিন কোটি লিটার জলধারণের জন্য প্রস্তুত l এত বড় টাকা তৈরি করার পেছনে অবশ্য শুধুই প্রয়োজন নয়, দুর্গের সুরক্ষার বিষয়টিও ছিল l শক্ররা যদি কখনও দুর্গ অবরোধ করে, তাহলে দীর্ঘ সময় যেন জলের অভাব না হয় l

রাজা গেছেন, তাঁর ফৌজও আর নেই l এখন জয়পুরের পর্যটকরা এই টাঁকা দেখতে এসে খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন টাকার নির্মল শীতল জল তাদের ক্লান্তি দূর করে l

বলা হত, জয়পুর রাজবংশের সমস্ত সম্পত্তি এই টাকাতেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল l জরুরি অবস্থার সময়ে অর্থাত ১৯৭৫-৭৬ সালে, সরকার এই টাকাতে জয়পুর রাজবংশের লুকনো সম্পত্তির খোঁজে প্রচুর খোঁড়াখুঁড়ি করে l কয়েক মাস ধরে তা চলেছিল l তিনটি টাকারই আশপাশে খোঁড়া হয় l টাকার সমস্ত জল বড় বড় পাম্প লাগিয়ে তুলে ফেলা হয় l

আয়কর বিভাগ কোন সম্পত্তি পাক বা না পাক, চারিদিকে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বর্ষার জল সংগ্রহের এই মূল্যবান সম্পদটি কিছুটা ভেঙে-চুরে যায় l ভিত ও দেওয়াল কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে l তবুও যে প্রায় চারশো বছরের পুরনো টাঁকাটি এই বিচিত্র অভিযানের ধাক্কা সামলে উঠে এখনও নিজের কাজ করে চলেছে এতে তার দৃঢ়তাই প্রমাণিত হয় l

কুবেরের উত্তর


সাধারণ গৃহস্থের এক ঘড়া শুরু করে রাজা, তার সৈন্যবাহিনীর জন্য কোটি কোটি ঘড়া জল ধরে রাখার এই ঐতিহ্য - কুণ্ড, টাকার এই উজ্বল পরম্পরা এখনও বয়ে চলেছে l কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই হয়েছে, তবে কুবেরের উত্তর এখনও সেই একই হবে l যেখানে বৃষ্টির একটি ফোঁটাও পড়বে, যেখানে রজতবিন্দু ঝরবে, সেটিকে সেখানেই সংগ্রহ করে নাও l এই টাঁকা ও কুণ্ডিতে স্থির হয়ে থাকা জলও যে এত নির্মল হতে পারে তা বোধ হয় সারা দেশে বয়ে চলা বাগধারাও আন্দাজ করতে পারে না l

তথ্য সূত্র


প্রবাহিত জলকে সঞ্চয় করে সারা বছর নির্মল করে রাখতে পারে যে কুণ্ডিগুলি, সেগুলি আমরা প্রথম দেখি ১৯৮৮ সালে সেণ্টার ফর সায়েন্স অ্যাণ্ড এনভায়রনমেণ্টের শ্রীঅনিল আগ্রওয়াল এবং শ্রীমতী নারায়ণের সঙ্গে বিকানের যাওয়ার পথে l কুঁইয়ের মতো এগুলিকেও বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে l

কুণ্ডি শব্দ কুণ্ড এবং যজ্ঞকুণ্ড থেকে এসেছে বলে মনে করা হয় l জয়সলমের জেলাতে অনেক পুরনো বৈশাখী কুণ্ডও আছে, যেখানে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে মানুষ অস্থি বিসর্জন দিতে আসে l বলা হয়, বৈশাখী পূর্ণিমায় স্বয়ং গঙ্গা এখানে বিরাজিত হন l এই লোক-কথাগুলি কুণ্ডের জলের নির্মলতা ও পবিত্রতারই পরিচয় দেয় l

কুণ্ড তৈরির প্রথা কত পুরনো তা সঠিক বলা যায় না l বিকানের জয়সলমের এলাকায় দুশো-তিনশো বছরেরও পুরনো কুণ্ড, টাঁকা পাওয়া যায়l নতুন পদ্ধতির হ্যাণ্ড পাম্পগুলিকে সচল রেখেছে এমন কুণ্ডও চুরু এলাকায় অনেক আছেl কুণ্ডিগুলির সময়সিদ্ধ ও সমাজসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যটি আমাদের বুঝিয়েছিলেন জনসত্তা, দিল্লির শ্রীসুধীর জৈন l

বিকানের জেলার সীমানার মধ্যে পাকিস্তানের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জলওয়ালি গ্রামের ফোগের ডাল দিয়ে তৈরি কুণ্ডিগুলি আমরা দেখতে পাই শ্রীওম থানবি ও রাজস্থান গো সেবা সংঘের শ্রীভম্বরলাল কোঠারিজির সৌজন্যে l এই কুণ্ডিগুলিকে সদা রঙ করার কারণ ও রহস্যও আমাদের বোঝান শ্রীওম থানবি l

খড়িয়া পাথর দিয়ে তৈরি কুণ্ডগুলি বিকানের ও জয়সলমেরের সংযোগকারী রাস্তার ওপর মাঝে-মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে l রজ্জু এলাকাতেও আমরা এই ধরনের কুণ্ড দেখি উরমূল ট্রাস্টের শ্রীঅরবিন্দ ওঝার সঙ্গে যাবার সময় l রাজস্থানের গো-সেবা সংঘের শ্রীজগদীশজীর সঙ্গে যাবার সময় আমরা রামগড় এলাকায় দেখতে পাই শিল্প হয়ে ওঠা বারান্দার মতো কুণ্ডিগুলি l এই কিছু দিন আগে কবিরবস্তি নামে জয়সলমেরে একটা সম্পূর্ণ নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছে l এই গ্রামে প্রতিটি ঘরের সামনে কুণ্ডি তৈরি করা হয়েছে l এই তথ্য আমরা পাই জয়সলমের গ্রামোদয় পরিষদের শ্রীরাজু প্রজাপতের কাছে l শ্রীওম থানবির সৌজন্যে যোধপুর ফলৌদি শহরে, ছাদ ও উঠানের আগৌর জুড়ে দ্বিগুণ জল সংগৃহীত হওয়া টাকাগুলি আমরা দেখতে পাই l চুররো-র জল যত্নসহকারে গ্রহণ করে যে টাকাগুলি, সেগুলির পরিচয় আমাদের দেন শ্রীজেঠুসিং ভাটিl জয়সলমেরের নরসিংহ ঢানি আট, দশটা পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রামের কাছাকাছি এই রকম একটি টাঁকা তৈরি করেন শ্রীসন্তোষপুরী নামের এক সাধু l সন্ন্যাস নেওয়ার আগে ইনি পশু চরাতেন l এ এলাকার বৃষ্টির জলকে তিনি বয়ে যেতে দেখেছেন l তাই সাধু হওয়ার পর তিনি এই জল মানুষের প্রয়োজনে সংগ্রহ করার প্রয়োজন অনুভব করেন l তিনি যে-কাজ শেষ করে যেতে পারেননি, তাঁর শিষ্যরা এখন সে কাজ করছে l সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী জলের কাজকে কত আধ্যাত্মিকভাবে নিজের করে নিয়েছিলেন তার বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যেতে পারে জয়সলমেরের শ্রীজেঠুসিং ভাটির কাছে l

জয়গড় কেল্লার প্রাথমিক তথ্য আমরা পাই জয়পুর শহরের সংগ্রহালয়ে লাগানো একটা বিজ্ঞাপন থেকে l ঐ বিজ্ঞাপনটিতে এটিকে বিশ্বের সব থেকে বড় টাঁকা বলা হয়েছিল। ‘এগ্রো এন’-এর শ্রীশরদ যোশির সঙ্গে সেখানে আমরা যাই এবং তাঁর কাছেই প্রারম্ভিক তথ্য পাই l এগ্রো এন ‘চাকুসুর’ একটি সংস্থা। জয়গড়ের টাকাটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল এই রকম- জয়গড় পাহাড়ের ওপর চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে টাকাটির আগৌর l পাহাড়ের ওপর বর্ষিত সমস্ত জলটুকুই ছোট, বড় নালা দিয়ে বয়ে দুর্গের প্রাচীর পর্যন্ত আসে l নালাগুলির ঢালও এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে জল আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলে l এতে জলের সঙ্গে বয়ে আসা মাটি তলায় পড়ে যায় l নালার রাস্তাতেও কয়েকটা ছোট ছোট কুণ্ড করা হয়েছে l তাতেও মাটি ফেলে রেখে, জল পরিষ্কার হয়ে প্রধান টাকার দিকে এগিয়ে চলে l

এই টাকা অভিযান ও খোঁড়াখুঁড়ির বিস্তৃত তথ্য আর এস খঙ্গরোত ও পি এস নাথাওতের লেখা ইংরাজি বই ‘জয়গড় দা ইনভিসিবল ফোর্ট অফ আমের’-এ পাওয়া যেতে পারে l প্রকাশক – আর বি এস পাবলিশার্স, এস এম এস হাইওয়ে, জয়পুর l রাজস্থানে রজতবিন্দুর মতো ছড়িয়ে থাকা এই টাকা, কুণ্ডি, কুঁই, পার ও পুকুরগুলি সমাজের যে সেবা করে চলেছে, পানীয় জলের যে যোগান দিয়ে চলেছে, হিসেব কষে সে মূল্য আমরা নির্ধারণ করতে পারব না l

কোন কেন্দ্রীয় পরিকাঠামোর পক্ষে এই কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়, যদি সম্ভবও হয় তাহলে তাতে খরচ হবে কয়েক কোটি টাকা l রাজস্থান সরকারের জনস্বাস্থ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ মাঝে-মধ্যে এখানে, ওখানে পানীয় জলের পরিকল্পনা তৈরির জন্য কাগজে টেণ্ডার নোটিশ দিয়ে থাকে l ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির জনসত্তা দৈনিকে প্রকাশিত এইরকম একটি টেণ্ডার নোটিশে বাড়মের জেলার শিব, পচপদরা, চৌহটান, বাড়মের এবং সিওয়ানা তহসিল নিয়ে মোট দুশো পঞ্চাশটি গ্রামে জলপ্রকল্প তৈরি করতে অনুমানিক লগ্নী চল্লিশ কোটি টাকা বলা হয়েছে l এই টেণ্ডারে বিকানের জেলার বারোটি তহসিলে প্রায় ছশো গ্রামে কাজের জন্য ছিয়ানব্বই কোটি টাকা লাগবে l

১৯৯৪-এর ফেব্রুয়ারীতে রাজস্থানের খবরের কাগজে প্রকাশিত টেণ্ডারের খবরটিও লক্ষ্য করার মতো l এটি যোধপুর জেলার ফলৌদি ক্ষেত্রে এই বিভাগের পক্ষ থেকেই পঁচিশ হাজার লিটার থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার লিটার জলধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন ভূতল জলাশয় অর্থাত অন্য কোন জায়গা থেকে জল এনে জমা করার ট্যাঙ্ক তৈরি করার পরিকল্পনা l এতে এক লিটার জল জমা রাখতে খরচা পড়বে প্রায় দু-টাকা l এ ছাড়াও জল অন্য কোনখান থেকে আনতে হবে। তার খরচা আলাদা। এই কাজ ফলৌদির তেরোটা গ্রামে হবে। মোট খরচ প্রায় নয় লক্ষ টাকা। এবার কল্পনা করুন, রাজস্থানের সমাজের সেই অংশটির কথা, যাঁরা বিজ্ঞাপন, টেণ্ডার খবর, ঠিকাদার ছাড়াই নিজেদের ক্ষমতাবলে প্রায় ত্রিশ হাজার গ্রামে নির্মল জলের যোগান দিতে পারত।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading