মহাসাগরে মিলিত হওয়ার শিক্ষা

2 Sep 2017
0 mins read

বিনোবা বলতেন – জলের উদ্গমন, জলের বয়ে চলা সমুদ্রের সঙ্গে মিলনের জন্য। কিন্তু চলার পথে যদি কোন ছোট গর্ত এসে পড়ে, গর্ত থাকে তাহলে জল তাকেই আগে ভরে। গর্ত ভর্তি করে যদি সে আগে বইতে পারে তো ঠিক আছে, নাহলে তাতেই সে সন্তুষ্ট হয়। সে কারো কাছে এই অভিযোগ করে না, কখনও এটা ভাবে না যে, আরে আমার তো সমুদ্র পর্যন্ত যাওয়ার এক মহান উদ্দেশ্য, এক মহান লক্ষ্য, এক মহান স্বপ্ন পূরণ করার ছিল, আর সেই মহান লক্ষ্য তো পূরণ হতে পারলো না।

প্রথমে দু’ কথা নিজের বিষয়ে।
তারপর দু’ কথা আজকের এই সুন্দর, পবিত্র অনুষ্ঠান সম্পর্কে।
তারপর দু’ কথা আমাদের আশপাশে গড়ে ওঠেছে, নিত্য নতুন গড়ে উঠছে এমন এক পরিবেশ সম্পর্কে।
এই পরিবেশে না আমরা নিজেদের ঠিকমত খাপ খাওয়াতে পারছি আর না নিজেদের পুরোপুরি আলাদা রাখতে পারছি। এই পরিবেশে আমরা ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে ঝুলে থেকে যাই। ত্রিশঙ্কু এই অবস্থা আমাদের বড়ই পীড়া দেয়, মন বেদনা দিতে থাকে, তাই এই অবস্থাটিকেও কিছুটা বোঝার চেষ্টা করবো।

তো এইভাবে দুই - দুই আর দুই মোট ছয় শব্দই তো হবে। কিন্তু হবে তো প্রায় হাজার শব্দ। এটা কি রকম যোগ, এটা কেমন গনিত, কেমন অঙ্ক। এই অঙ্ক কিছুটা আধুনিক পাঠক্রম পড়ে ফেলেছে যে সমাজ সেই সমাজের অঙ্ক, আর তাদের শোভা বর্ধনকারী এই অঙ্ক তারা খুব পচ্ছন্দও করে। তার নিজেদের ছোট-ছোট প্রায়ই ভালো ভালো কাজগুলির প্রচার খুব উচ্চস্বরে করে থাকে, আর নিজেদের এই ছোট্ট সংসারের বাইরেও যে একটি অনেক বড় সংসার আছে, তাদের বড় বড় কাজগুলিকে তারা জোড়ে পর্যন্ত না, যদি বা জুড়েও নেয় তো ফলাফল খুবই কম করে দেখায়। এই অঙ্ক গান্ধীজীর একটুও পচ্ছন্দ ছিল না।

প্রথমে দু’ কথা নিজেকে নিয়ে। সেটা এই জন্য নয়, যে নিজেকে নিয়ে অতিরঞ্জিত করে আমার কিছু বলার আছে। একেবারে সাধারণ জীবন। না তো আজকের আধূনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, না কোনো বুনিয়াদী ট্রেনিং নেওয়ার বা বোঝার সুযোগ হয়েছে। সাধারণ উপাধী, সাধারণ ডিগ্রী, সেটাও সাধারণ নম্বর নিয়ে। এতটাই সাধারণ যে সমাবর্তনে (Convocation) গিয়ে সেটা নেওয়ার হিম্মত পর্যন্ত হয়নি। সেটা ওই বিশ্ব বিদ্যালয়েই কোথাও সুরক্ষিত রাখা আছে অথবা রদ্দি কাগজের সঙ্গে হয়তো বা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

এবার দু’ কথা আজকের এই পবিত্র আয়োজন সম্পর্কে।

আজকের এই উত্সব আপনাদের জীবনের নতুন এক মোড়। সমাবর্তন মানে - শিক্ষান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী প্রদান অনুষ্ঠান। তবে এক্ষেত্রে আমার বিনম্র নিবেদন হল - বাস্তবে আজ থেকে আপনাদের শিক্ষা শুরু হতে চলেছে। তাই আপনারা এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে শিক্ষা শেষের অনুষ্ঠানকে আপনারা শিক্ষারম্ভ অনুষ্ঠান মনে করুন। গুজরাতিতে এর একটি সুন্দর নাম রয়েছে –

পদবীদান, আসলে সেভাবে দেখলে আপনারা এই পদবী দানে পাচ্ছেন না। এটি তো নিজেদের শ্রম দিয়ে, বৌদ্ধিক শ্রম দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। তাই আমি পদবীদান শব্দটি শাব্দিক অর্থে নিচ্ছি না। এর আরও একটি অর্থ এ ও হয় যে, যে পদবী আপনি অর্জন করেছেন, আজ এখান থেকে বাইরে বেরোবার সময় সেই পদবীটি সমাজে প্রদান করুন। মানে যে জ্ঞান আপনি অর্জন করলেন, এখন থেকে সেই জ্ঞান সমাজে, সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিন। যে কেও এই জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। এই জ্ঞান আপনার জন্য এখন রাম রতন হওয়া চাই যে, যার ব্যবহার আপনি যত করবেন তা ততই বেড়ে যাবে। কখনও কোথাও কমে যাবে না।

বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠার সময় 1920 সালে গান্ধীজী এখানে যে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন - এই বিদ্যাপিঠের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য শুধু বিদ্যা দান নয়, বিদ্যা দেওয়া নয়। শিক্ষার্থীরা যাতে জীবন যাপনে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে সেটাও একটা উদ্দেশ্য। তাঁর এই বক্তব্যটিকে পূর্ণতা দিতেই তিনি, আগের বাক্যে বলেন - তাই যখনই আমি এই বিদ্যালয়ের তুলনা অন্য কোন শিক্ষণ সংস্থাগুলির সঙ্গে করি তখনই আমি চমকে উঠি। সেই সময়ের বড় বলা হতো যে বিদ্যালয়গুলিকে, বড়র তকমা পেয়েছিল যে বিদ্যালয়গুলি সেইগুলির সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে তিনি এক ভিন্ন অর্থে এটিকে অনু বিদ্যালয়, একটি লঘু বিদ্যালয় অর্থাত ছোট বিদ্যালয় বলেছিলেন। এটির তুলনায় অন্য গুলিতে ইট, পাথর, চূণ অনেক বেশি লেগেছিল - এরকম কথাও তখন গান্ধীজী বলেছিলেন। তবে এই সুযোগে আমরা আবার ঝালিয়ে নিতে পারি যে অনু দেখতে ছোটই কিন্তু তার ভীতর শক্তি অপার হয়।

তবে এখন সেই অনু শক্তির আর ইট পাথর চূনের কথা এখানেই রেখে ফিরে যাই স্বাবলম্বী হওয়ার কথায়। সেই সময় গান্ধীজী চমকে উঠেছিলেন। আজকে থাকলে না জানি তিনি কত অধিক চমকে উঠতেন। এখন তো এই শহরেই এমন অনেক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলিতে পদবী দানের আগেই, উপধী হাতে আসার আগেই দু - তিন লাখ টাকার চাকরী সেই ছাত্রদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

এই রকম বৈভবশালী চাকরীর দিকে যদি আমরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি , তারপর জানতে পারি কি এই রকম বেতন তো আমি পাব না তখন আমরা নিরাশ হতে পারি। অন্য আশঙ্কা এটাও হতে পারে যে, আঙুর ফল আমাদের ‘টক’ লাগল। তবে একটি তৃতীয় রাস্তা রয়েছে। এই রকম চাকরী ও তাকে ঘিরে যে ছোট্ট পৃথিবীটা রয়েছে যদি ভালভাবে বিবেক দিয়ে সেটি বিশ্লেষণ করি, ভালভাবে তার খোঁজ খবর করি – তাহলে আমাদের সকলের না হোক, কিছু জনের তো এটা মনে হতেই পারে সোনায় বাঁধানো বলে মনে হচ্ছে যে রাস্তা, সেই রাস্তা যে আমাদের খুব সুখ আর খুব সন্তোষের দিকে নিয়ে যাবে এটা জরুরী নয়।

এই রাস্তা পশ্চিমের দেশগুলির, বড়লোক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে দেশগুলিকে, সেই দেশগুলি যে মাটি, পাথর ও আড়ম্বর দিয়ে তৈরী তার মজবুতির কোন পাক্কা গ্যারিণ্টি নেই। বিগত পাঁচ – দশ বছরে আপনারা সকলেই দেখেছেন যে সমৃদ্ধির সবথেকে আকর্ষণীয় চমক দেখানেওয়ালা আমেরিকার মতো দেশও কিরকম ভয়ানক মন্দার শিকার হয়েছিল আর সেখানেও এই অর্থ ব্যবস্থা অদ্ভুত সোরগোল তুলেছিল। আমেরিকার পর গ্রীস, স্পেন ও ভয়ানক মন্দায় ডুবেছে। আর ধারের অর্থ ব্যবস্থায় ডুবে থাকা এই সব দেশগুলিকে সাঁতারে ওঠার জন্য মিত ব্যায়িতার লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়নি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা অন্তরাষ্ট্রিয় মুদ্রা কোষের মত বড় মহাজনগুলি তাদের আরও ধার দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছে।

এখানে আমরা সকলেই প্রায় সাধারণ ঘর থেকে আসি। আমাদের মা-বাবারা খুবই কষ্ট করে কিছু পয়সা বাচান যাতে আমরা লেখা - পড়া করে কিছু করি আর তাদের ঘাড়ে যে ঘর সংসারের যে ভারী ভার রয়েছে কিছুটা হলেও তা লাঘব করি। তাই এখান থেকে বেরিয়ে কোন ঠিক ঠাক চাকরি পেলে তো ভালই হয়। তবে আপনাদের সকলের কাছে আমরা একটি নিবেদন আছে এই বিষয়ে।

হিন্দিতে আর গুজরাটিতেও দুটি শব্দ রয়েছে – একটি শব্দ হল নোকরী আর অন্যটি হল চাকরী। আপনি নোকরী করেন জীবিকার জন্য। যে কাজ করবেন তাতে এমন ভাবে নিজের মন ঢেলে দিন যেন সেই কাজ আপনার নিজের কাজ হয়ে যায় - অন্যের জন্য করা কাজ না হয়। তাহলেই কাজের আনন্দ পাবেন আর তখন আপনি তাকে শুধু পয়সার তুলাদণ্ডে না মেপে প্রশান্তির তুলাদন্ডে মাপবেন – এই সাধনা আর একটু আগে বাড়লেই আপনার এই তুলাদন্ডটিরও প্রয়োজন পড়বে না। ওজন করার বাঁটখারাগুলিও আপনি ফেলে দেবেন।

বিদ্যাপীঠ তৈরী হয় 1920 সালে। সালের হিসেবে এটি খুবই পুরোনো মনে হবে। তবে দেশের আরও দুটি পুরোনো বিদ্যাপীঠের উল্লেখ আমি আপনাদের সামনে করবো। তাদের বয়সের দিকে তাকিয়ে এই বিদ্যাপীঠটিকে একেবারে টাটকা, আজকের মনে হবে।

আমি যে সোনার ইতিহাসের কথা বললাম তার মধ্যে একটি বিদ্যাপীঠ হল নালন্দা ও অন্যটি হল তক্ষশিলা। সংস্কৃতে পন্ডিত কোন ব্যক্তি যদি এ গুলির নামের কোন অর্থ বার করেন সেটি তাঁর ব্যাপার, তবে এই বিদ্যাপীঠ গুলির আশপাশে যারা বসবাস করেন তাঁরা এগুলির নামের একটি সরল ব্যাখ্যা করেছিলেন – না – অলম – দা, অর্থাত কম দিও না। জ্ঞান কম দিও না। আমরা তোমার এই বিদ্যাপীঠ নালন্দায় এসেছি তো আমাদের বেশি থেকে বেশি জ্ঞান দিও।

দ্বিতীয় বিদ্যাপীঠটির অর্থ হল তক্ষ অর্থাত তরাশনা (খোদাই করা) শিলা অর্থাত পাথর বা চাটান। সাধারণ এক খণ্ড পাথর থেকে শিক্ষক, অধ্যাপক নিজেদের দক্ষ, অসাধারণ হাত দিয়ে হাতিয়ার দিয়ে এক সুন্দর মূর্তি খোদাই করেন। একটি সাধারণ ছাত্রকে একজন উপযোগী, সংবেদশীল নাগরিক রূপে তৈরী করে তার পরিবার ও সমাজকে ফিরিয়ে দেয়।

এই দুটি নামের সঙ্গে ছাত্র শব্দেরও একটি ব্যাখ্যা দেখুন - যে গুরুর দোষ ছাতার মত ঢেকে দেয় – সে হল ছাত্র। তো নামের এই সুন্দর খেলা কয়েক হাজার বছর আগে চলেছিল আর আজও আমাদের কিছু প্রেরণা দিতে পারে। তবে আমাদের এটাও ভুললে চলবে না যে নালন্দা ও তক্ষশিলার মত এত বড় বড় বিদ্যাপীঠ আজ তো খন্ডহারে পরিণত হয়েছে আর খুব বেশি হলে আজ পর্যটকদের কাজে লাগে, এগুলি এখন ধ্বংসের মুখে।

তো এর থেকে আমাদের এটা বোঝা দরকার যে সংস্থা বিশেষ করে শিক্ষণ সংস্থাগুলি কেবল ইঁট, পাথর, চূন বা সিমেণ্টেই তৈরী হয় না। এগুলি গড়ে ওঠে গুরু ও ছাত্রের সুন্দর সম্পর্ককের ভিত্তিতে, ও সেই সম্পর্কই এগিয়ে নিয়ে যায় ও টিকিয়ে রাখে। এই সুক্ষ সম্পর্ক যতদিন কায়েম ছিল ততদিন এই প্রসিদ্ধ শিক্ষণ সংস্থাগুলি চলেছিল। আপনারা সকলেই জানেন যে এখান থেকে কেমন কেমন বড় বড় নাম সেই সময় বেরিয়েছিল। কেমন কেমন বড় বড় শিক্ষক সেখানে পড়াতেন। চানক্যের মত মহাপুরুষ সেখানে ছিলেন, যাঁর লেখা এত হাজার বছর আগেও মানুষ পড়তেন আর তাঁর সমস্ত লেখা আজও শেষ হয়ে যায়নি। আজও মানুষ চানক্যের লেখা পড়ে। নালন্দা ও তক্ষশিলা খুবই রাজার আশ্রয় বা প্রশ্রয় পেয়েছিল, কিন্তু সেই রাজাই তো এখন নেই তো আশ্রয় কোথায় পাওয়া যাবে।

তাই আজ আপনারা এখান থেকে খেতাব বা ডিগ্রী যাই বলুন, নিয়ে বেরোনোর সময় মনে কোন প্রকার হীন চিন্তা আসতে দেবেন না। আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান যে এমন একটা বিদ্যাপিঠে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, যেটি গান্ধীজী নিজে বানিয়ে ছিলেন। তিনি নিজে 1920 সাল থেকে তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠের উপচার্য ছিলেন। তিনি দেশের সেই দুর্দিনে স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে, পিড়িতের সেবা থেকে শুরু করে হাজার কাজের মধ্যে এই বিদ্যাপীঠের সম্পূর্ণ খেয়াল রেখেছিলেন। এই বিদ্যাপিঠের ভবিষ্যত বিষয়ে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন। তিনি এই বিদ্যাপীঠের প্রাঙ্গনে একবার বলেছিলেন – আমি তো বুড়ো হয়েছি, পেকে যাওয়া পাতা, অন্য অনেক কাজে আটকে রয়েছি। আমার মতো পাকা পাতা যদি ঝরেও যায় তো তাতে এই গাছের (বিদ্যাপীঠের) গায়ে কোন আঁচ লাগবে না। উপাচার্য ও অধ্যাপকরাও তো এই গাছেরই পাতা, আর তাঁরা এখনও কোমোল ও মোলায়েম রয়েছেন। কিছু দিন পরে হয়ত তাঁরাও পাকা পাতা হয়ে ঝরে যাবেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা হল এই বৃক্ষের শাখা, প্রশাখা, আর ভবিষ্যতে এই শাখা প্রশাখা থেকেই উপাচার্য ও অধ্যাপক রূপী পাতা প্রস্ফুটিত হবে।

দেশের সমস্ত উচ্চ শিক্ষণ সংস্থাগুলিতে নিয়মিত লেখাপড়া ছাড়াও গবেষণার কাজও চলে। এখানেও গবেষণার কাজ হয়। আমি এক প্রকার আপনাদের মাঝে এই প্রথমবার এসেছি, তাই এখানের গবেষণার বিষয়ে ঠিকঠাক জানি না। তবুও খুবই ভয়ে ভয়ে, সংকোচের সঙ্গে বলতে চাই গবেষণার সঙ্গে যদি শ্রদ্ধা না থাকে তা হলে তা যত ভালই হোক তা থেকে সমাজের খুব বেশি কিছু পাওয়ার থাকে না। প্রতি বছরের গবেষণার কাজে এরকম একজন থাকা চাই, এই পর্যায়ের হওয়া চাই যে সমস্ত দেশে নিজের পতাকা উড়িয়ে দেবে। আপনারা কোন মামুলি বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী নন। এই বিদ্যাপীঠের পিছনে সেই পতাকা, সেই ঝান্ডা রয়েছে - গান্ধীজীর ঝান্ডা, যিনি সেই ইংরাজদের ঝান্ডাও নামিয়ে দিয়েছিলেন যাদের সমাজে সূর্যাস্তই হত না ।

আমরা এটা বলতে কিছুটা অস্বস্তিই হচ্ছে, ভাল লাগছে না, যে সারা দেশে গান্ধীজীর ওপর গবেষণায় কোন আনন্দ উত্সাহ বা চমক দেখা যায় না। গান্ধী অধ্যয়ন কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক বেড়েছে আর সেখান থেকে গবেষনা করে উপাধীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাটাও খুব কম নয় – এই সংখ্যায় আমাদের গর্ব হতে পারে। কিন্তু সত্যি সত্যি কি এটা বলতে পারি কি যে এই গবেষণা, এই শিক্ষার্থীরা সমাজের কিছু কাজে লাগবে? গুজরাতী ভাষায় একটি শব্দ আেছ ‘বেদিয়া ঢোর’ আমরা যেন এরকম চারপেয়ে না হই, এরকম গাধা না হই যার পিঠে কিছু বেদ (বই) চাপানো রয়োছে। গান্ধীজীর বেদ খুবই ভারী বেদ। এটা নিরর্থক বয়ে বেড়ানোর নয়। আর তা যদি করি তাহলে আমাদের পা - ও টলমল করবে এবং দুনিয়াও আমাদের পুছবে না, হয়তো বা হাসতে পারে। গান্ধী বিষয়ে গবেষণা এমন হবে যে আমরাও তরব ও সাথে আমাদের সমাজও তরবে। এই গবেষণা আমাদের ও আমাদের সমাজ উভয়েকই বর্তমান মহা প্রলয় থেকে রক্ষা করবে।

আজ আমাদের হাজার বিভিন্ন খবরের কাগজ শয়ে শয়ে টেলিভিশন চ্যানেল দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা অমঙ্গলকারী খবর দিয়ে চলেছে। তাহলে কি সত্যিই আমরা এরকম অমঙ্গলকারী সমাজের মধ্য দিয়ে চলেছি? আমার তো সেরকম মনে হয় না। গান্ধীজী হিন্দ স্বরাজ - এ যেরকম বলেছিলেন এতো ঠিক সেরকমই। এতো তীরের ময়লা। মাঝের প্রসস্ত ধারা পরিষ্কারই আছে। সমাজের সেই বড় অংশের বিষয়ে গান্ধীজী একশো বছর আগেই বড়ই বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন – মাঝের ওই প্রশস্ত ধারার ওপর না ইংরাজ রাজত্ব করতে পেরেছে না তো আপনারা পারবেন। লাগাতার উপেক্ষিত হতে হতে কিছুটা হয়তো ভেঙ্গে পড়েছে, তবুও নিজের বিশ্বাস কয়েম রয়েছে।

তো নিজের বিশ্বাস থেকে না পিঠ ফেরানো সমাজের ওপর কতগুলি গবেষণা হয়েছে ? এটা আমাদের কষ্টিপাথরে পরখ করে নেওয়া প্রয়োজন।

কিছু আগে বিদ্যাপীঠের বর্ণনা দেওয়ার সময় যে গাছ – পাতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেই রূপকে শেকড়ের কথা বাদ পড়ে গেছে। শেকড়ের জোরই গাছের জোর। এখন বিদ্যাপীঠের শেকড় কোথায় থাকবে, কেমন হবে? এর উত্তর আমরা গান্ধীজীর থেকেই পেতে পারি। এই রকমই কোন এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন – হিন্দুস্থানের প্রতিটি ঘরই এক একটি বিদ্যাপীঠ, মা – বাবারা উপাচার্য। এ কথাটা অবশ্য আলাদা যে মা – বাবারা আজ সে ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছেন। তবে এখান থেকে বেরিয়ে যখন আপনারা যখন নিজেরদের ঘর বানাবেন তখন সেখানে বাদ্যাপীঠের বিচারের শিকড় কিন্তু অবশ্যই প্রোথিত হতে দেবেন।

আমার লেখাপড়া, যেমন আমি প্রথমেই বলেছিলাম – একেবারে সাধারণ। ইংরাজীরও খুব একটা অভ্যাস নেই। তবে ওই ভাষার একটি শব্দ আমাকে খুব আকর্ষণ করে, বা বলা যায় আমাকে খুব ছুঁয়ে যায়। শব্দটি হল – পিগমেলিয়ন। বিচিত্র অর্থ রয়েছে এই শব্দটির। আমরা যা নই তা যদি কেউ ভালবেসে বলে দেয় – আরে তুমি তো এটাই। তখন আমার মনও আমাকে সেটাই বানাতে চায়। ইংরেজীর এক বড় লেখক এই শব্দটিকে নামকরণ করে সুন্দর একটি নাটক লিখেছিলেন। পরে হলিউড এই নাটকটিকে কেন্দ্র করে খুব সুন্দর একটি সিনেমা তৈরী করে। সিনেমাটির নাম – মাই ফেয়ার লেডি।

এর সঙ্গে মেলে সে রকম আরও একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন বিনোবা। আমাকে সকলে বলে যে অন্যের পাহাড় প্রমান দোষকে যেন আমি তিলের মতো ছোট করে দেখি। আর নিজের তিলের মতো ছোট দোষকে যেন পাহাড়ের মতো বড় করে দেখি। কিন্তু বিনোবা বললেন এসব তো অনেক হল, এবার অন্যেরও গুণ দেখ আর অন্যের থেকেও এগিয়ে নিজের গুণ দেখ। এটিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন – গুণ দর্শন।

আমরা আমাদের সাথিদের গুণ দেখবো, নিজেদেরও গুণ দেখবো। যে গুণ নেইও তাও যদি আমরা দেখি তাহলে তা ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যেও আসবে।

এই বিদ্যাপীঠ যখন তৈরী হয় তখন আমরা পরাধীন ছিলাম, গোলাম ছিলাম। তাই কুলপতি হিসেবে গান্ধীজী যখন ভাষণ দিতেন তখন তাঁর সেই ভাষণে সরকারের সাথে অসহযোগিতার কথা থাকতই। আজ আমরা স্বাধীন। তবে বড়ই বিচিত্র এই স্বাধীনতা। আমরা, আমাদের এই সমাজ, এই স্বাধীনতাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তাই যে জ্ঞান এখান থেকে আমরা অর্জন করেছি, যে বিশিষ্ট উপাধী আজ আমরা এখান থেকে পাচ্ছি, এখান থেকে বেরিয়ে তা যদি সমাজের কাজে লাগাই তাহলে ভালো হয়। তখন সরকারের সঙ্গে অসহযোগীতা ছিল, এখন সমাজের সঙ্গে আপনারা সহযোগিতার রাস্তা তৈরী করুন। চাকরি অবশ্যই করুন কিন্তু কাজ সমাজের। এই কঠিন সময়ে নিজেদের গুণ দর্শন করুন, তা বাড়ান ও সমাজের গুণও দেখতে আরম্ভ করুন – অগুনতি গুণ আপনি দেখতে পাবেন।

তখন সমাজের বিভিন্ন অঙ্গে আপনি তিল তিল গান্ধীজীকে দেখবেন। সেই তিলগুলি একত্রে জড়ো করে চলুন। পৌরানিক গল্পে আছে – ব্রহ্মা সৃষ্টির উত্তোমত্তম জিনিষগুলি থেকে তিল তিল জমা করে তিলোত্তমা নামে এক পাত্রের রচনা করেছিলেন। সেই রকম আপনারাও সমাজ থেকে উত্তোমত্তম তিলগুলি একত্র করে তিলোত্তম হয়ে উঠুন – এই আমাদের সকলের শুভকামনা, এটি গ্রহন করুন।

আজকের এই পূন্য লগ্নে কী ভেবে আপনারা আমায় ডেকে ছিলেন, আমি তা জানি না। এটা আদরনীয় নারানভাই, আদরনীয় সুদর্শন ভাই, রামজীবন ভাই –এর স্নেহ, অতিশয় উদারতা। যা কিছু বড় উদ্দেশ্যের জন্যে ডেকেছিলেন, আমি জানি, আমি তা পূরণ করার যোগ্য নই। একজন ভালো ছাত্রের মতো নিজেদের ছাতা দিয়ে আমার দুর্বলতা, আমার অপগুণ আপনারা সকলে ঢেকে রাখবেন।

শেষে বিনোবার সুন্দর কথা দিয়ে আমা আজকের আমার এই বক্তব্য শেষ করবো। বিনোবা বলতেন – জলের উদ্গমন, জলের বয়ে চলা সমুদ্রের সঙ্গে মিলনের জন্য। কিন্তু চলার পথে যদি কোন ছোট গর্ত এসে পড়ে, গর্ত থাকে তাহলে জল তাকেই আগে ভরে। গর্ত ভর্তি করে যদি সে আগে বইতে পারে তো ঠিক আছে, নাহলে তাতেই সে সন্তুষ্ট হয়। সে কারো কাছে এই অভিযোগ করে না, কখনও এটা ভাবে না যে, আরে আমার তো সমুদ্র পর্যন্ত যাওয়ার এক মহান উদ্দেশ্য, এক মহান লক্ষ্য, এক মহান স্বপ্ন পূরণ করার ছিল, আর সেই মহান লক্ষ্য তো পূরণ হতে পারলো না।

তাহলে আসুন আমরা বইতে শুরু করি, আর জীবনের এই যাত্রায় যদি গর্ত পড়ে তাহলে ভালবেসে সেগুলিও ভরে চলুল। তাকেই এখানের ভাল শিক্ষার সুন্দর পরিণাম মনে করুন। এই টুকু বিনম্রতা যদি এখানের শিক্ষা, বিদ্যাপীঠের থেকে পাওয়া শিক্ষা শিখিয়ে থাকে তাহলে হয়তো আমরা মহাসাগর পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি জোটাতে পারবো।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading