নদীর প্রকৃতি ও জীবনধারা


আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রচিত ‘ভাগীরথীর উত্স সন্ধানে’ প্রবন্ধের বেশ কিছু অংশকে পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, নদীকে বুঝতে, নদীর জীবনধারা জানতে :

“আমাদের বাড়ীর নিম্নেই গঙ্গা প্রবাহিত। বাল্যকাল হইতেই নদীর সহিত আমার সখ্য জন্মিয়াছিল, বত্সরের এক সময়ে কূলপ্লাবন করিয়া জলস্রোত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইত; হেমন্তের শেষে ক্ষীণ কলেবর ধারণ করিত, প্রতিদিন জোয়ার ভাঁটায় বারিপ্রবাহের পরিবর্তন লক্ষ্য করিতাম। নদীকে আমার একটা গতি পরিবর্তনশীল জীব বলিয়া মনে হইত। সন্ধ্যা হইলেই একাকী নদীতীরে আসিয়া বসিতাম। ছোট ছোট তরঙ্গগুলি তীরভূমিতে আছড়াইয়া পড়িয়া কুলু কুলু গীত গাহিয়া অবিশ্রান্ত চলিয়া যাইত। যখন অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিত, এবং বাহিরের কোলাহোল একে একে নীরব হইয়া যাইত, তখন নদীর সেই কুলু ধ্বনির মধ্যে কত কথাই শুনিতে পাইতাম। কখন মনে হইত এই যে অজস্র জলধারা প্রতিদিন চলিয়া যাইতেছে ইহা ত কখনও ফিরে না, তবে এই অনন্ত স্রোতঃ কোথা হইতে আসিতেছে? ইহার কি শেষ নাই? নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম, “তুমি কোথা হইতে আসিতেছে”? নদী উত্তর করিত, “মহাদেবের জটা হইতে।” তখন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত স্মৃতিশয়ে উদিত হইত। তাহার পর বড় হইয়া নদীর উত্পত্তি সম্বন্ধে অনেক ব্যাখ্যা শুনিয়াছি, কিন্তু যখনই শ্রান্তমনে নদীতীরে বসিয়াছি তখনই সেই চিরাভ্যস্ত কুলু কুলু ধ্বনির মধ্যে সেই পূর্ব্বকথা শুনিতাম, “মহাদেবের জটা হইতে” ।

এটা তো গেল আচার্যের উপলব্ধি। বাস্তবে বর্ষার জল ও বরফগলা জল থেকে সৃষ্টি হয় নালা বা ঝোরা। বর্ষার জল মাটিতে পড়ে চাদরের মতো ছড়িয়ে পড়ে। মাটিতে সামান্য ফাঁক পেলেই তার মধ্যে জল প্রবেশ করে তার পরিসরকে বাড়িয়ে তোলার জন্য। এই কঠিনের মধ্য দিয়ে নিম্নভূমির যে জলস্রোত প্রবাহিত হয় এবং নালা বা এইসব ঝোরা মিলে তৈরী হয় নদী। ক্রমে নানাদিক থেকে নানা উপনদী এসে মূলনদীকে পুষ্ট করে তোলে। আবার দুই বা তার চেয়ে বেশী ছোট ছোট নদীর মিলন থেকে বড় নদীর সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে মূল নদীর শাখাগুলি মাটি, পাথরকে কেটে কেটে অববহিকার বিস্তারকে বাড়িয়ে তোলে। মাটির মধ্যে জলের অনুপ্রবেশ ভূমিক্ষয়কে সহজ করে তোলে।

সাধারণভাবে জলপ্রবাহের স্থান অনুযায়ী নদীকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:


1 উচ্চভূমির নদীপ্রবাহ
2 সমতলের নদীপ্রবাহ
3 বদ্বীপ অঞ্চলের নদীপ্রবাহ

আবার, জলপ্রবাহের স্থায়িত্ব অনুযায়ী নদী তিনরকমের:


1 অল্পপ্রবাহ (ephemeral)
2 স্বভাবপ্রবাহী (intermittent)
3 নিত্যপ্রবাহী (perennial)

এবং প্রবাহের আকৃতি অনুসারে নদীকে তিনভাবে ভাগ করা হয়ে থাকে যেমন:


1 সরল
2 সর্পিল
3 বেণীবদ্ধ

নদীপ্রকৃতির বিশ্লেষণ অথবা দুটি নদী অববাহিকার তুলনামূলক বিচারের জন্য বিজ্ঞানীরা নদীর শাখাপ্রশাখাগুলিকে তাদের মর্যাদা অনুসারে এক একটি সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করে থাকেন। যে সব ছোট ছোট নদী মিলে মূল নদীর উত্পত্তি, তাদের বলা হয়ে থাকে প্রথম পর্যায়ের নদী ( first order streams ) দুটি প্রথম শ্রেণীর নদী মিলে তৈরী হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী, দুটি দ্বিতীয় শ্রেণীর নদী মিলে তৈরী হয় তৃতীয় পর্যায়ের নদী প্রভৃতি, অর্থাত যে নদীর পর্যায় সংখ্যা যত বেশী, তার দৈর্ঘ্য, ঢাল, অববাহিকার বিস্তার ও জলপ্রবাহের পরিমাণও তত বড়। পাহাড়ের গা বেয়ে খরস্রোতা নদী সমতল ভূমিতে প্রবেশ করলে দ্রুত নদীখাতের ঢালের পরিবর্তন হওয়ায় নদীবাহিত পলি পাহাড়ের সানুদেশে জমা হতে থাকে। এই জলস্রোত আবার দুই প্রকার

1 স্তরাকৃতি ( laminar)
2 উত্থান ( turbulent )

জলের গভীরতার তুলনায় স্রোতের গতি বেশী হলে জলস্রোত তীব্রবেগে ছুটে চলে। এ অবস্থায় প্রবাহকে উচ্চ পর্যায়ের স্রোত প্রবাহ বলে। স্রোতের গতি এতটা বেশী না হলে প্রবাহ নিম্নপর্যায়ে থাকে, তখন স্রোত ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়, উচ্চ ও নিম্নপর্যায়ের পলল পরিবহণের প্রকৃতিও ভিন্ন। নদীর শক্তি তার গতিতে। কোনও নদীখাতে প্রবাহিত জলের মোট ওজন ও তার দুই প্রান্তের উচ্চতার পার্থক্যের গুণফল জলের মোট স্থিতিশক্তি, জল প্রবাহিত হলে এই স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে পরিণত হয়।

सम्पर्क


ড. অরুণকান্তি বিশ্বাস
প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা

ডঃ অরুণকান্তি বিশ্বাস
প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী) কলকাতা


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading