নোংরা জলের ভেড়ি থেকে মিঠে জল


প্রতিদিন ধাপা অঞ্চল থেকে প্রায় 150 টন সবজি কলকাতার বাজারে আসে। আর আসে 22 থেকে 25 টন মাছ। এর মধ্যে আছে চারাপোনা, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প ইত্যাদি তুলনা-মূলকভাবে সস্তা মাছ। যা কলকাতায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। ‘‘জানেন কলকাতার যে ড্রেন, কাঁচা নর্দমা দেখেন - সেই সবের জল আমরা দুবেলা দুহাতে ঘাঁটি। চারদিকে যত জল দেখেছেন ভেড়িগুলোতে, সবই তো আসছে শহরের বাথরুম, পায়খানা, রান্নাঘর, রাস্তাঘাট থেকে নর্দমা বা ড্রেন বয়ে। এই জলে আমরা ডিম ছাড়ি, মাছ বড় করি, ডাল টানি, আর শহরের বাজারে জ্যান্ত ছটফট করা চারাপোনা, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, সিলভার কার্প চালান দিই। তারপর ভেড়ি ঘুরে সেই নোংরা জল যখন শেষে কেষ্টপুর বা বানতলা খাল হয়ে কুলটিতে গিয়ে পড়ে -সেই কালো জল হয়ে যায় ঝকঝকে পরিষ্কার!’’ জানিয়েছিলেন চার নম্বর ভেড়ির এক শ্রমিক।

কলকাতার পাশের ময়লা জলের এই প্রাকৃতিক পরিশোধন পদ্ধতি উঠে গেলে তার বদলে বসাতে হবে যান্ত্রিক পরিশোধনাগার। মেকানিকাল ট্রিটমেণ্ট প্ল্যাণ্ট। বেশ কয়েকটি আমাদের দেশেও আছে। অধিকাংশই ঠিকমত চলে না, আর কয়েকটা একেবারেই চলে না। এই ভেড়ি এলাকাতেই একটা দৃষ্টান্ত আছে বানতলায়। ভারতবর্ষের বৃহত্তম সেডিমেণ্টশন ট্যাঙ্ক। নিশ্চল, নিথর। শয়ে শয়ে সচল ভেড়ির মাঝখানে মহাস্থবিরের মত পড়ে আছে অচল যন্ত্র-দানব।

সত্যি ভাবতে অবাক লাগে যখন জানতে পারি যে কলকাতার মাপের অন্যান্য শহরগুলো ময়লা, নোংরা জল শহর থেকে বের করে দেবার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে থাকে। মাইলের পর মাইল লম্বা বিশেষ ধরনের পাইপ, বড় বড় যন্ত্র আর বড় বড় কারখানা তৈরি করতে হয় শহরের নোংরা জল পরিষ্কার করতে।

মনে মনে হিসেব মেলাতে গিয়ে বেশ জোরেই বলে ফেললেন এক বন্ধু- ‘‘মানে, একদিকে শহরের নোংরা জল পরিষ্কার কর বাবদ কোটি কোটি টাকা বছরে বাঁচছে-অন্যদিকে নিজেদের কাজ আর তাজা মাছ বাবদ কোটি কোটি টাকা বছরে আয় হচ্ছে। এত লাভজনক শিল্প বোধহয় আমাদের দেশে খুব একটা নেই? শুনি তো পশ্চিমবঙ্গেই 30 হাজার বড়, মাঝারি ও ছোট শিল্প রুগ্ন হয়ে ধুঁকছে! তাহলে এখন লাভজনক একটি প্রকল্প বদ্ধ করা কার স্বার্থে।’’

চেনা - চেনা সুর


‘‘সেই যখন বিদ্যাধরী দিয়ে নোনা জল আসা বন্ধ হয়েছে – তারপর থেকেই কলকাতা শহরের নোংরা জলের একটা অংশ ফেলা শুরু হোলো এই লবণ হ্রদে। তখনই এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বিদ্যাধরী স্পিল মত্স্যজীবি সমবায় সমিতি।’ এখন যেখানে বিধাননগর, সেখানকার 20-25টা ছোট-বড় মাঝারি ভেড়ি মিলিয়ে প্রায় 2500 শ্রমিক এই সমবায়ের মধ্যে ছিলেন। অত বড় সমবায় নাকি গোটা এশিয়ায় তখন ছিল না। জানেন, ভারতবর্ষের সেরা সমবায় ছিল এটা। প্রাইজও পেয়েছিল সে যুগে। সে সময়কার কয়েকজন মত্স্যজীবির আজও দেখা পাবেন দত্তাবাদ অঞ্চলেই ই এম বাইপাসের ধারে।’’ সুকান্তনগর ভেড়ি সমবায় সমিতির অফিসঘরের সামনে বসে আমরা শুনছিলাম সেই সব দিনকার কথা-কীভাবে চলত সে সময়কার রমরমা সমবায়। 1958 সালে যখন বিদেশী কোম্পানীকে দিয়ে বিধান রায় লবণহ্রদ ভরাট করাবার কাজ শুরু করালেন-ভেড়ি শ্রমিকরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বিধান রায় প্রথমে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেই চাননি-শেষে বাধ্য হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘এখানে এত লোক থাকে, আমাকে কেউ বলেনি তো?’’ তারপর বলেছিলেন যে, চুক্তিমত দিনে 50 লক্ষ টাকা করে বিদেশীদের দিতে হবে ফলে কাজ বন্ধ করা যাবে না। তবে যাঁদের সরে যেতে হচ্ছে তাঁদের দিকটা তিনি নিশ্সয়ই দেখবেন। –‘‘বিধান রায় -এর সরকার সে সময়ে বলেছিল, ঘর দেবে মাছ চাষের ভেড়ির কাছেই, যেখানে তারা ভেড়ি শ্রমিক হয়েই থাকতে পারবে – আরো কত কী? কিন্তু কি পেয়েছি? বিধাননগর তৈরির সময়ে জন-মজুরের কাজ করেছি। বাড়ির বৌ -ঝিরা এখন বাবুদের বাড়ি বাসন মাজছে -এই তো সব কথায় দাম!’’

পুরোনো ছবি, চেনা ছবি, নতুন হয়ে ফিরে আসছে। কী যুক্তি!-কায়েক হাজার মানুষকে কয়েক লক্ষ মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার তো করতেই হবে। নর্দদা, বালিয়াপাল, টেহরী, ভোপাল, কোয়েল-কারো, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি -একের পর এক চলছে উন্নতির নামে ধ্বংসলীলা।

প্রকৃতির গবেষণাগারে


আমরা ঘুরে ঘুরে দেখেছি কিভাবে প্রতিটা ভেড়িতে একটা করে নোংরা জল ঢোকানোর আর জমা জল বের করার জন্য পাইপ আছে। এগুলোর মুখের ঢাকনা খুলে দিলেই প্রয়োজন মতো জল ঢোকানো বা বার করা যায়। দেখলাম কীভাবে জমির ঢাল ব্যবহার করে নোংরা জল বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খালগুলো দিয়ে। যেমন কয়েক জায়গায় দেখা গেল ভেড়ির জলের থেকে খালের জল বেশ নীচুতে। এখানে এই তফাত্টা ব্যবহার করে ভেড়ি থেকে জল বার করে দেওয়া হচ্ছে সহজেই। আবার যেখানে খালের জল উঁচুতে থাকছে সেখানে নোংরা জল ভেড়িতে ঢোকানো সহজ হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার একটা ভেড়ির বার করে দেওয়া জল খালে না ফেলে পাশের কোনো ভেড়িতে ঢোকানো হচ্ছে। এটা বিশেষ করে সেইসব ভেড়িতেই করতে হচ্ছে যে ভেড়ির জল বেরোনোর খালগুলো নষ্ট হয়ে গেছে সল্টলেক মহানগরী তৈরির সময়ে। আবার কখনও দেখলাম পাশাপাশি দুটো খাল যাচ্ছে -একটাতে কুচকুচে কালো নোংরা জল, অন্যটাতে ভেড়ি থেকে ছাড়া একটু পরিষ্কার সবজে রঙের জল। এক কথায় জলের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ভেড়িগুলোর আশপাশে একটা খালের জাল তৈরি করেছেন এখানকার মানুষ।

‘‘ভেড়ির জলের রং, গন্ধ আর স্বাদ দেখে আমরা বুঝতে পারি ভেড়ি থেকে জল কতটা বার করে দিতে হবে আর কতটাই বা নোংরা জল ঢোকাতে হবে।’’ –বললেন এক জেড়ি শ্রমিক।

আমরা দেখলাম কীভাবে ছোট ছোট পুকুরে ডিম-পোনা ছাড়া হয়। একটু বড় হলেই সেগুলোকে তুলে নিয়ে অন্য একটা ছোট পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর তিন চার ইঞ্চি লম্বা হলে তাদের চালান করা হয় বড় ভেড়ি গুলোতে। শেষে 100-150 গ্রাম ওজনের হলেই মাছ বাজার ঘুরে ভাতের পাতে। এর ফাঁকে পুকুরের কালো জল পরিণত হয় টলটলে পরিষ্কার জলে।

প্রতিদিন ধাপা অঞ্চল থেকে প্রায় 150 টন সবজি কলকাতার বাজারে আসে। আর আসে 22 থেকে 25 টন মাছ। এর মধ্যে আছে চারাপোনা, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প ইত্যাদি তুলনা-মূলকভাবে সস্তা মাছ। যা কলকাতায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। এছাড়া অল্পস্বল্প চিংড়ি, পারশে, ভেটকি, ভাঙ্গর জাতীয় মাছও আসে।

দেখলাম কচুরিপানা


বড় ভেড়িগুলোর চারপাশে বাঁধের ধারে ধারে দেখলাম কচুরিপানা হয়ে রয়েছে জলের মধ্যে। এগুলো পরিষ্কার করা হয়নি কেন প্রশ্ন করতে একজন ভেড়ি শ্রমিক উত্তর দিলেন - ‘‘অনেক উপকারে আসে এই কচুরিপানা জলের ঢেউ থেকে বাঁধকে বাঁচাতে সাহায্য করে এই কচুরী পানা। আবার গরমকালে ছোট মাছগুলো পানার তলায় ছায়ায় এসে ঠাণ্ডা হয়। তাছাড়া কিছু মাছ - যেমন তেলাপিয়া, নাইবোটিকা - ডিম ছাড়ে এই কচূরী পানার মধ্যেই।’’ পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম নোংরা জলের সাথে মিশে থাকা কিছু কিছু ভারী ক্ষতিকর ধাতুকে কচুরি পানা নিজের দেহে টেনে নেয় - ফলে জলও পরিষ্কার হয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভেড়িতে এসেই ওই নোংরা জলের পরিষ্কার হয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভেড়িতে এসেই ওই নোংরা জলের ময়লা পরিষ্কার হয় আর জলের মধ্যে কমে - যাওয়া অক্সিজেন আবার বেড়ে ওঠে।

শহরের প্রায় 1500 কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নর্দমা বাহিত নোংরা জলের আনুমানিক 30 ভাগ জল ব্যবহৃত হয় এই জলাভূমিতে। পরিশোধিত হয়ে ফিরে যায় খালে। এই এলাকা বুঝিয়ে দিলে এই ময়লাও বইতে হবে সেই খালকে। বাড়তি চাপ সইতে পারবে তো এই খাল?

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading