পরিবেশ বিনষ্টকারী ও ক্ষতিকর মোবাইল টাওয়ার


পরীক্ষার মাধ্যমে প্রেসিডেন্সি কলেজে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ঘরে বসে তিনি তড়িত চুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করে প্রথম ঘরের দেওয়াল ভেদ করে দ্বিতীয় ঘরে রাখা একটি পিস্তল থেকে গোলা ছুড়তে সক্ষম হলেন। 1890-এর দশকে জগদীশচন্দ্র বসু মাইক্রোওয়েড (মিলিমিটার তরঙ্গ) আবিষ্কার করেছিলেন। তখন এর সুদূর প্রসারী প্রভাব উপলব্ধ হয়নি, হয়েছে অনেক পরে। মাইক্রোওয়েভের বিশেষ কিছু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এই তরঙ্গগুলিকে বিভিন্ন প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জলবায়ু ও আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম খবর জানা, অন্ধকারাচ্ছ্ন্ন ও কুয়াশাচ্ছন্ন বায়ুমণ্ডলে ও মেঘাচ্ছান্ন আকাশে সমুদ্র জাহাজ এবং বায়ু মণ্ডলে উড়োজাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণ করা, বিমানের নিরাপদ অবতরণ করানোর কাজে, তাপ উত্পাদনে (মাইক্রোওয়েড ও ভেন) ব্যবহার টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনও মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি নির্ভর।

মাইক্রোওয়েভের বিশেষ কিছু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে, আজকের প্রযুক্তি কিভাবে মানুষের উপকারে আসছে ও তার অপব্যবহার কিভাবে হচ্ছে তা নিয়ে উন্নত ও উন্নতশীল দেশগুলো ভাবনা চিন্তা করছে। মোবাইল সংস্কৃতি কতটা প্রয়োজনীয় আর কতটা অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসিতার উপকরণ, তা নির্ধারণ করছে বেশ কিছু টোলিকম কোম্পানী। বিভিন্ন লোভের হাতছানি দেখিয়ে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষদের হাতেও মোবাইল পৌঁছে দিচ্ছে এই কোম্পানীগুলো। আর উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তরা তো একটা নয়, দুটো তিনটে মোবাইল ফোন নিয়ে নিজেকে গণ্যমান্য প্রমাণ করার চেষ্টায় আছেন। দেখা যাচ্ছে ভারতে মোবাইল এসেই 2006 সালের মধ্যে পৃথিবীর দ্বিতীয় স্থানে চীনের পরেই এসে গিয়েছে ও 2011-তে কমপক্ষে 50 কোটি গ্রাহক ধরবে বলে সিদ্ধান্তে এসেছে এই সব ব্যবসায়ী টেলিকম কোম্পানীগুলো মোটারোলা (motorola) কোম্পানীতে কর্মরত মার্টিন কুপার নামে একজন গবেষককে মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক বলে চিহ্নিত করা হয়।

মোবাইল ফোন থেকে নির্গত তড়িত চুম্বকীয় বিকিরণের এলাকার মধ্যে মানব শরীরের ওপর মোবাইল ফোনের প্রভাব নিয়ে কতকগুলো বিষয় আজ প্রমানিত- যেমন হৃদস্পন্দন, মস্তিস্কের তরঙ্গ (Brain Wave), রক্ত-মস্তিস্কের ব্যবধান (blood brain bamer), অণ্ডকোষ, শ্রবনেন্দ্রিয়, ত্বকের ওপর তড়িত চুম্বকীয় বিকিরনের প্রভাব।

মস্কোর আইজার বেলওয়েড দেখেছেন, একটা সেলফোন থেকে যে পরিমান মাইক্রোওয়েভ বিকিরিত হয়, তার চেয়ে 16 গুণ কম বিকিরণে ব্যাকটেরিয়া ডি.এন.এ. (Bacterial DNA) অনুরণিত হয় জার্মানীর এক গবেষক ডব্লু গ্রাণ্ডলার বলেছেন যে শূন্য মাত্রার কাছাকাছি বিকিরণেও ইষ্ট কোষ বৃদ্ধি পায়। সুইজারল্যাণ্ডের সায়ারজন বাগ দেখেছেন এই সব সর্ট ওয়েভের ধারে কাছে থাকা লোকজন ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রাজনিত রোগের শিকার হন। অর্থাত মাইক্রোওয়েভের প্রভাব অনেকাংশেই পরমানুশক্তির মতন। কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। তড়িত্চুম্বকীয়তার ক্ষেত্রে যে কোন মাত্রাই বিপদজনক।

এবার আমি যে বিদ্যুত চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে এই মোবাইল ফোনগুলো সচল থাকে, সেই বিদ্যুত চুম্বকীয় তরঙ্গ সঞ্চালনের প্রাণ ভোমরা, তথা মোবাইল টাওয়ারের কথায় আসবো। এই মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমেই হ্যাণ্ডসেট থেকে অর্থাত প্রেরকের কষ্ঠ নিঃসৃত বাক্যস্রোত থেকে বিদ্যুত চুম্বকীয় তরঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে নিকটবর্তী টাওয়ারে পৌঁছায়। সেই টাওয়ার থেকে পরবর্তী টাওয়ার, এভাবে টাওয়ার বাহিত হয়ে গ্রাহকের হ্যাণ্ডসেটে গিয়ে পৌঁছায় এবং গ্রাহক সেই বাক্য স্রোত শুনতে পান। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই টাওয়ারগুলোই দূরসঞ্চারের মূল হোতা। সাধারণ এই টাওয়ারগুলো গৃহস্থবাড়ির ছাতে, উঁচু উঁচু থাম তৈরী করে অথবা কোন উঠোন চত্বরে বসানো হয়। তার উপরে বসানো হয় প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্র। শক্তি যোগান দেওয়ার জন্য থাকে শক্তির উত্স বা পাওয়ার সোর্স এই টাওয়ারগুলি চালু রাখার জন্য থাকে ব্যাটারী বা বিকট শব্দকারী জেনারেটর, যাতে সারাদিন সারা সপ্তাহ, সারা বছর একটানা শক্তি যোগান দেওয়া যায়।

এই টাওয়ারগুলি থাকে নির্গত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী (RF) তড়িত চুম্বকীয় বিকিরণের মাধ্যমে (electromagnetic radiation, EMR) 2 থেকে 2.5 মাইল সহজে পৌঁছে যায়। এর মাত্রা অনেকটাই মাইক্রোওয়েভের বিকিরণের মাত্রার মতো। ফলতঃ এই অল্প শক্তির বিকিরণ সেল টিসু (cell tissue) ও DNA-এর পরিবর্তন ঘটায় এবং ব্রেন টিউমার, ক্যান্সার, গর্ভপাত, অ্যালজাইমার সূচিত করতে পারে। শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। দেখা গেছে শিশুরাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদের করোটি পাতলা ও বেড়ে ওঠার সময় বলে তাদের কোষ বেশী সক্রিয়। যদিও বয়স্ক মানুষরা ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। UK-র ডাক্তার বাবুরা তো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন যে 16 বছরের কমবয়েসী ছেলেমেয়েরা যেন মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী (RF) থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকা যায়।

বর্তমানে আমেরিকা মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ মাত্রা বেঁধে দিয়েছে 580 থেকে 1000 মাইক্রোওয়াট প্রতি বর্গ মিটারে 580-100 µW/cm2 ইউরোপীয় দেশগুলির মাত্রা আমেরিকা নির্ধারিত মাত্রা থেকে 100 - 1000 গুণ কম, অস্ট্রেলিয়ার মাত্রা 200 µW/cm2, রাশিয়া, ইটালী ও টরেণ্টোর 10 µW-cm2, চীন ও সুইজারল্যাণ্ড, অস্ট্রিয়া যথাক্রমে 6,4 and 1 µW/cm2, যদিও দেখা যায় টাওয়ার থেকে নির্মিত বিকিরণ মাত্রা (RF) এর থেকে কম হওয়া সত্বেও শারীরিক ক্ষতি হতে থাকে। এমনকি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে 0.01 – 100 µW-cm2 মাত্রার বিকিরণেও শরীর ও জীবকোষের ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাত এখনো পর্যান্ত সঠিক নিরাপদ বিকিরণ মাত্রা ধার্য করা সম্ভব হয়নি (Viena conference 1998) ।

FCC ( The US Federal Communication Commission ) যাদের ওপর দায়িত্ব ছিলো বিকিরণের মাত্রা ঠিক করার, তাঁরা ইণ্ডাস্ট্রিগুলোর লগ্নীকরা টাকা ($ 40 billion ডলার) বরবাদ হবে বলেছেন যে US নির্ধারিত মাত্রাই সঠিক। ক্যাথি বার্গম্যান ভেনিজা (Cathy Bergman-Veniza), 1996-Vermant Law School Environmental Law Center-এ অনুষ্ঠিত এ অনুযোগ করেছেন যে ইণ্ডাস্ট্রিগুলো যা বলাতে চাইবে FCC কে তাই বলতে হবে। যেমন একসময় এরাই বলেছিলেন অ্যামবেসঠম, সিগারেট, থালিডোমাইড (thalidomide) ব্যবহারে কোন ক্ষতি হয় না যা আজকের পরীক্ষায় ভুল প্রমানিত হয়েছে। EPA (Environmental protection Agency, US), WHO (World Health Organization), FCCO- এর সাথে একমত নন, বরং বলেছেন EMR সম্ভবত কারসিনোজেন ( carcinogen ) অর্থাত ক্যান্সারের কারণ। দু’বার মেডিসিনে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীতে পদার্থবিদ ডঃ গেরাউ হাইল্যাণ্ড (Dr Gerard Hyland) বলেছেন বা যে নিরাপদ গাইড লাইন তৈরী হয়েছে তা অর্পযাপ্ত যেহেতু এই সব গাইডলাইনে তাপমাত্রা জনিত বিকিরণের কথাই ধরা হয়েছে (thermal effects of exposure)’’।

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে বিধিনিয়ম অনুসারে মোবাইল টাওয়ার বানানোর আগে মিউনিসিপালিটি ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে অনুমতিপত্র নিতে হবে। জনবসতি থেকে কমপক্ষে 36 মিঃ দূরে, হাসপাতাল বা স্কুল চত্বরে বানানো যাবে না এবং টাওয়ারের অ্যাণ্টেনার মুখ সরাসরি কোন বাড়ির দিকে রাখা যাবে না, শুধুমাত্র 5000 টাকা ফাইন দিয়ে বিধি নিষেধ ভাঙ্গা যাবে না, কোম্পানীর হয়তো কিছু বাড়তি খরচ হবে, সামাজিক দায়িত্ববোধের, পরিবেশরক্ষা করার কথা মাথায় রাখতে হবে। যত্র তত্র মোবাইল টাওয়ার বানানো যাবে না। আমাদের দেশের টেলিকমিমিউনিকেশন অ্যাক্ট 1996 অনুযায়ী জনসাধারনের ক্ষতি হচ্ছে এই মর্মে কোন প্রতিবাদ করা যাবে না।

কিন্তু আমরা প্রতিরোধ করতে অনেক সংখ্যক মোবাইল টাওয়ার বানানোর বিরুদ্ধে কারণ এর থেকে সামগ্রিক তড়িত চুম্বকীয় বিকিরণের মাত্রা বেড়ে যায়। জন প্রতিনিধিরা ক্ষমতা প্রয়োগ করেত পারেন, কারণ জনসাধারণের ভালো, মন্দ শারীরিক অসুবিধার ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিরাই একমাত্র বাধ্য থাকবেন। যদিও ইতিমধ্যে অ্যক্টের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। আসুন আমরা সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, সেলফোনের ব্যবহার কমাই, ও সুনাগরিক হয়ে উঠি।

তথ্যসূত্রঃ-
1. ‘‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’’ বিজ্ঞান মন্দির প্রকাশিত 2002
2. আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু – 150তম জন্ম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী – আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস 150তম জন্ম শতবার্ষিকি উদযাপন কমিটি প্রকাশিত, 2008
3. ‘‘মোবাইল একটি চলমান বিপদের ধারা বিবরণী’’ সবুজ মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞান অন্বেষক ও চাকদা ও সংস্কৃতিক সংস্থা প্রকাশিত, 2008
4. অজানা দূষণ – তরুণ কুমার দে, সপ্তাহ পাবলিকেশনস, 2001
5. শ্রমজীবি স্বাস্থ্য – জানুযায়ী 2009
6. ‘‘মোবাইল টাওয়ার –এর গোপন দূশণ কথা ‘‘সুভাশিস মুখোপাধ্যায়. দুর্বার ভাবনা বর্ষ 1, সংখ্যা 3, জুলাই, 2009
৭.WWW.monntshastaecology,org
৮.WWW.lineindia.com

ড. অরুণকান্তি বিশ্বাস, প্রাক্তন পূর্বঞ্চলীয় প্রধান ও ডেপুটি ডাইরেক্টর নিরী, কলকাতা

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading