পরিবেশ ভাবনায় স্বামী বিবেকানন্দ


স্বামীজি প্রাথমিক ভাবে জোর দিয়েছেন পরিচ্ছন্ন জীবন চর্চার ওপর, জোর দিয়েছেন... পানীয় জলের সঠিক ব্যবহারের ওপর যা শেষতক সমস্ত পরিবেশকে সুন্দর করে তুলতে সহায়তা করবে।

স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বান দিয়ে লেখাটা শুরু করছি যেখানে স্বামীজি বজ্রনির্ঘোষে বলিয়া উঠিলেন, “ওঠ, জাগো, অমৃতের পুত্রগণ, কতদিন আর জড়ের উপাসনায় মুগ্ধ থাকিয়া মরণের বেদনায় জর্জরিত হইবে? ওঠ, জাগো, ভাঙ্গিয়া ফেল এই মোহ শৃঙ্খল”। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, “ওঠ, জাগো লক্ষ্যে না পৌঁছুনো পর্যন্ত থেমো না”।স্বামী বিবেকানন্দের মতে, মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত অন্তর্নিহিত দেবত্বের উপলব্ধি। মানুষের কাজ হল সেই ভাবকে জাগিয়ে তোলা এবং সেটা সম্ভব, বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতিকে বশ করে। বহিঃপ্রকৃতিকে মানুষ বশ করে বিজ্ঞানের সাহায্যে এবং অন্তঃপ্রকৃতিকে ধর্মের মাধ্যমে। বিজ্ঞান মানুষকে শারীরিক সুখস্বাচ্ছান্দ্য দেবে এবং ধর্ম তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধান করবে। সেজন্যই স্বামীজি চেয়েছিলেন যে ভারত পাশ্চাত্য থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আনবে এবং বিনিময়ে পাশ্চাত্যকে শেখানো হবে আধ্যাত্মিকতা। তা বলে এই নয় যে পাশ্চাত্যের সবকিছুই ভালো।

কারণ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, অনেক ভারতবাসীদের মধ্যে পাশ্চাত্যকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার প্রবণতা, এবং এই অন্ধ অনুকরণ প্রবণতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁকে মুগ্ধ করতো পাশ্চাত্যের কর্মকুশলতা। তিনি চাইতেন পাশ্চাত্যের এই কর্মকুশলতাকে ভারতবর্ষও আয়ত্ব করুক। বিজ্ঞান চর্চা বাড়তে লাগলো। সভ্যতার উন্নতি (progress of civilization) হতে লাগলো। আমরা ক্রমশ প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্টের কাজে এগুতে লাগলাম। বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের অভাবে ও বিজ্ঞানচর্চার অপব্যবহারে আমরা ক্রমশ লোভী হতে থাকলাম। পৃথিবীটাকে শুধু আমাদের জন্য ভাবতে লাগলাম। বিরামহীনভাবে প্রকৃতিকে অশুদ্ধ করতে ধাবমান হলাম। বিশেষ করে আমরা আমাদের বায়ুস্তর, জলকে আমাদেরই অনিয়িন্ত্রত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ক্রমাগত নষ্ট করে চলেছি।

আমরা কি করে জানবো বা বলবো যে, শুধু পরিবেশ আমাদেরকে, এই জীবজগত্কে কিভাবে প্রভাবিত করে চলেছে, কারণ বিভিন্ন কার্য কারণের প্রতিফলনের একটা দিক এই পরিবেশগত পার্থক্যে এবং ফলস্বরূপ এই পরিবেশের তারতাম্যের রূপ। যখন আমরা সৃষ্টির সময়কার পরিবেশের আকারে ফিরে যেতে চাই, তখন আমরা বুঝতে পারি বর্তমান পরিবেশের পার্থক্যগত চেহারা। স্বামীজি প্রাথমিক ভাবে জোর দিয়েছেন পরিচ্ছন্ন জীবন চর্চার ওপর, জোর দিয়েছেন খাওয়া দাওয়া ও পানীয় জলের সঠিক ব্যবহারের ওপর যা শেষতক সমস্ত পরিবেশকে সুন্দর করে তুলতে সহায়তা করবে। সে সময় এত কলকারখানা ছিলো না, ছিলো না চাষের কাজে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার ফলতঃ আজকের মতো পরিবেশের এই ক্রমাগত অবনতির চেহারা পরিস্ফুট হোত না। জোর দেওয়া হোত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রবন্ধে, স্বামীজি এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন,“ময়লাকে অত্যন্ত ঘৃণা করে আমরা ময়লা হয়ে থাকি অনেক সময়। ময়লাকে আমাদের এত ঘৃণা যে ছুঁলে নাইতে হয়, সেই ভয়ে স্তুপাকৃতি ময়লা দোরের পাশে পচতে দিই। না ছুঁলেই হল। এদিকে যে নরককুণ্ডে বাস হচ্ছে, তার কি? একটা অনাচারের ভয়ে আর একটা মহাঘোর অনাচার। একটা পাপ এড়াতে গিয়ে, আর একটা গুরুতর পাপ করছি। যার বাড়ীতে ময়লা সে পাপী, তাতে আর সন্দেহ কি, তার সাজাও তাকে মরে পেতে হবে না, অপেক্ষাও বড় বেশী করতে হবে না”।

স্বামীজি আহার ও পানীয় বিষয়ে মানুষের কাছে আবেদন করেছেন,খিদে পেলেও কচুরিখানা ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও,সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে। ভাত, ডাল, আটার রুটি, মাছ, শাক, দুধ যথেষ্ট খাদ্য। মাংস খাবার পয়সা থাকে, খাও, তবে ও পশ্চিমী নানা প্রকার গরম মশালাগুলো বাদ দিয়ে। মশলাগুলো খাওয়া নয়, এগুলো অভ্যাসের দোষ। তিনি মানুষের জলকে পানীয় ও স্বাস্থ্যসম্মত করে খাওয়ার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তার স্বভাবসিদ্ধ লেখনীতে। বলেছেন, “অশুদ্ধ জল আর অশুদ্ধ ভোজন রোগের কারণ। আমেরিকায় এমন জল বিশুদ্ধর বড়ই ধূম। এখন ঐ যে ফিলটার ওর দিন গেছে চুকে। অর্থাত ফিলটার জলকে ছেঁকে নেয় মাত্র, কিন্তু রোগের বীজ যে সকল কীটাণু তাতে থাকে, ওলাউঠা প্লেগের বীজ তা যেমন তেমনি থাকে, অধিকন্তু ফিলটারটি স্বয়ং ঐ সকল বীজের জন্মভূমি হয়ে দাঁড়ান। কলকাতায় যখন প্রথম ফিলটার করা হল তখন পাঁচ বত্সর নাকি ওলাওঠা হয় নাই, তার পর যে কে সেই, অর্থাত ফিলটার মশায় এখন স্বয়ং ওলাওঠা রোগের আবাস হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ফিলটারের মধ্যে দিশি তেকাঠার ওপর ঐ যে কলসীর ফিলটার উনিই উত্তম, তবে দু তিন দিন অন্তর বালি বা কয়লা বদলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে নিতে হবে। আর ঐ যে ফটকরি দেওয়া গঙ্গাতীরস্থ গ্রামের অভ্যাস, এটি সকলের চেয়ে ভাল। ফটকিরির গুঁড়ো যথা সম্ভব মাটি ময়লা ও রোগের বীজ সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে তলিয়ে যান।

গঙ্গাজল জালায় পুরে একটু ফটকিরির গুঁড়ো দিয়ে থিতিয়ে যে আমরা ব্যবহার করি, ও তোমার বিলিতি ফিলটার মিলটারের চোদ্দ পুরুষের মাথায় ঝাঁটা মারে, কলের দুশো বাষ্পান্ত করে। তবে জল ফুটিয়ে নিতে পারলে নির্ভয় হয় বটে। ফটকিরি থিতান জল ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে ব্যবহার কর, ফিলটার, মিলটার খানায় ফেলে দাও।” সাধারণ মানুষদের জন্য পরিবেশ ভাবনা স্বামীজি কিভাবে করতেন, করেছেন তা ওনার বিভিন্ন প্রবন্ধ, পত্রাবলী থেকে আমরা পেয়ে থাকি। তাইতো যখন ক্রমবর্ধমান ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলশ্রুতি হিসেবে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন, ও ক্রমহ্রাসমান মানবিক মূল্যবোধ, তখন বারে বারে মনে পড়ে স্বামীজির আহবান, সমাজ সচেতনাতার জন্য ডাক “ওঠ, জাগো, নিজে জেগে অপরকে জাগাও।”

सम्पर्क


ড. অরুণকান্তি বিশ্বাস
প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading