পরিবেশে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া


ভারতের সুপ্রিম কোর্টের হিসাবে 2002 সালে প্রতি হেকটর (এক হেকটর = দশ হাজার বর্গ মিটার) ছোট আগাছা ভর্তি জমির বর্তমান নেট মূল্য (N. P. V.) হল 5.8 লক্ষ টাকা, পাতলা বৃক্ষাচ্ছাদিত অঞ্চলের প্রতি হেকটরের বর্তমান নেট মূল্য হল সাত (7) লক্ষ টাকা এবং ঘন অরণ্যানীর প্রতি হেক্টরের বর্তমান মূল্য 9 লক্ষ টাকা। সুপ্রিম র্কোটের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চলের মূল্য প্রায় নব্বই হাজার কোটি টাকা। আর্সেনিক দূষণে জমির ক্ষতির আর্থিক মূল্যায়নও হওয়া প্রয়োজন।

জীবমন্ডলে মানুষ ছাড়াও আছে উদ্ভিদ, জীবজীবাণু, কীটপতঙ্গ এবং পশুপাখিরা। তাদের সক্রিয়তার ওপরই মানুষের সুখ সমৃদ্ধি শুধু নয়, তার সমগ্র অস্তিত্বই নির্ভরশীল। পরিবেশে বর্ধিত আর্সেনিক মাটি জল প্রভৃতির নানারকম উদ্ভিদ ও জীবাণু সমূহের কমবেশি ক্ষতি করছে। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই, বিজ্ঞানী মহলেও চেতনা ও অনুসন্ধানের অভাব আছে। উন্নতদেশের বিজ্ঞানীরা তাদের দেশের ও সমুদ্রের জীবসমূহে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছেন। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমসমূহে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার অনুসন্ধান তথ্য বিশেষ নেই। অথচ এই বিষয়েই আমরা সমধিক আগ্রহী। ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাক্ষেত্রে আর্সেনিকের নানা রাসায়নিক প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ ও জীবের ওপর যত তথ্য পাওয়া যায়, পরিবেশের ক্ষেত্রে তত নেই।

পৃথিবীতে বৃহত্তম ইকোসিস্টেম হল জীবমন্ডল বা বায়োস্ফিয়ার, যা ছোটো বড় অসংখ্য ইকোসিস্টেম নিয়ে গঠিত। অন্যান্য দূষণের সঙ্গে আর্সেনিক দূষণও ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্যহানি করে, তার কার্যকারিতা ক্ষণ্ণ করে। মানুষের খাদ্য, ওষুধ, শিল্পের কাঁচামাল থেকে জল ও বাতাসের পরিশোধন ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্যের ওপরই নির্ভরশীল।

মাটি ও জলের উদ্ভিদকণা ও জীবকণা (ফাইেটো প্লাংটন ও জু প্রাংটন), শৈবাল, ছত্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইকোসিস্টেম সমূহের উত্পাদনশীলতা কমে আসে। আর্সেনিকের মাত্রা বাড়লে জমির উর্বরতা কমে যায়। তার ক্রমসঞ্চিত আর্থিক ক্ষতি সাঙ্ঘাতিক। কৃষি ও প্রকৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে পরাগ সংযোগ অত্যন্ত মূল্যবান একটি প্রক্রিয়া, যা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদি আর্সেনিক মৌমাছি ও কীট পতঙ্গাদির সংখ্যা কমিয়ে দেয়। জমিতে শৈবাল, ছত্রাক, জীবাণুসমূহ উদ্ভিদের পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। কেঁচোর শরীর দিয়ে প্রতি বছর প্রতি হেক্টর জমিতে দশ মেট্রিক টন মাটি বেরিয়ে যায়, যার ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা বৃদ্ধিসহ জল ও বাতাসের প্রবেশ্যতা বজায় থাকে। সুতরাং পরিবেশীয় আর্সেনিক ইকোসিস্টেমে কার ওপরে কিভাবে কতটা ক্ষতি করছে, তার ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। পরিবেশে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আরও আলোচনার আগে পরিবেশীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

পরিবেশীয় অর্থনীতি


পরিবেশ অর্থনীতি ইদানীং অর্থনীতির একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে দেখা দিয়েছে। পরিবেশ অর্থনীতিবিদরা ইকোসিস্টেমের বিভিন্ন পরিষেবারও ইকোসিস্টেম সার্ভিসের মূল্যায়ন করে চলেছেন। সম্প্রতি একদল গবেষক পার্থিব ইকোসিস্টেম পরিষেবা ও প্রাকৃতিক মূলধনের মূল্যায়ন করেছেন।

ইকোসিস্টেম পরিষেবার মূল্যঃ

 

সেবা

মূল্য (trillion US $)

মৃত্তিকা গঠন

বিনোদন

পৌষ্টিক উপাদান সমূহের চক্রায়ন nutrient cycling

জলনিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ                                    

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ (climate)                          

জীবের আবাস                                            

বন্যা ও ঝড় থেকে সুরক্ষা                                

খাদ্য ও কাঁচামাল উত্পাদন                               

জিনগত সম্পদ (genetic resources)          

বায়ুমন্ডলীয় গ্যাসের ভারসাম্য                            

পরাগসংযোগ (pollination)                        

অন্যান্য সেবা (বর্জ্য শোধন ইত্যাদি)             

17.1

3.0

2.3

2.3

1.8

1.4

1.1

0.8

0.8

0.7

0.4

1.6

 

33.3

 

বিভিন্ন গবেষকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোল (16) প্রকার ইকোসিস্টেমের সাতেরো (17) টি পরিষেবাকে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন এবং সেগুলির মোট বার্ষিক মূল্যায়ন করেছেন, যা 33.3 ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সমমূল্যের। এক ট্রিলিয়ন ডলার মানে এক লক্ষ কোটি বা 1012 ডলার। টাকার অঙ্কে পরিণত করতে একে আবার প্রায় 50 দিয়ে গুণ করতে হবে। অর্থাত 1012 X 50 টাকা। এই পরিমাণ পৃথিবীর মোট উত্পাদনের (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাকট বা G. N. P.) প্রায় দ্বিগুণ। পৃথিবীর মোট G. N. P. 18 ট্রিলিয়ন ডলার।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের হিসাবে 2002 সালে প্রতি হেকটর (এক হেকটর = দশ হাজার বর্গ মিটার) ছোট আগাছা ভর্তি জমির বর্তমান নেট মূল্য (N. P. V.) হল 5.8 লক্ষ টাকা, পাতলা বৃক্ষাচ্ছাদিত অঞ্চলের প্রতি হেকটরের বর্তমান নেট মূল্য হল সাত (7) লক্ষ টাকা এবং ঘন অরণ্যানীর প্রতি হেক্টরের বর্তমান মূল্য 9 লক্ষ টাকা। সুপ্রিম র্কোটের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চলের মূল্য প্রায় নব্বই হাজার কোটি টাকা। আর্সেনিক দূষণে জমির ক্ষতির আর্থিক মূল্যায়নও হওয়া প্রয়োজন।

পরিবেশে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কিছু নমুনা


মধ্য স্লোভাকিয়ায় পঞ্চাশের দশকে নোভিকি তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হয়। তা থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ শত কেজি (500 Kg ) মতো আর্সেনিক চিমনির ধোঁয়া দিয়ে বেরিয়ে যেত। ব্যবহৃত কয়লায় টন প্রতি থাকত আট শত (800) থেকে পনেরো শত (1500) গ্রাম আর্সেনিক ফ্লাই অ্যাশ কণায় পরিশোষণে আবদ্ধ আর্সেনিক ট্রাই অকসাইড পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ত। আশেপাশের জলাশয়গুলিতেও বর্ধিত আর্সেনিক মাত্রা দেখা গেল। 165 ppm আর্সেনিকের দরুন মাটিতে জীবাণু প্রোটোজোয়ার সংখ্যা কমে। 150 ppm আর্সেনিকে মাটিতে কিছু বৃষ্টির কীট অদৃশ্য হয়ে যায়। এক বছর বা তার কম বয়সি খরগোশের দেহকলায় যে বর্ধিত আর্সেনিক পাওয়া যেত, তা এগারো (11) বছর বয়সি ওই অঞ্চলের ছেলেদের চুলেও পাওয়া যেত।

তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পর বাতাসের অনুকূলে ত্রিশ (30) কিমি দূর পর্যন্ত মধুমক্ষী (honey bee, Apis mellifera) কলোনিগুলি একেবারে বিনষ্ট হয়ে গেল মাছি প্রতি 0.6 µg আর্সেনিক মারাত্মক। বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পর গৃহ পালিত পশুদের জননাঙ্গে আর্সেনিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় শুয়োর ফার্মে গর্ভপাত বাড়তে লাগল। শুয়োর উত্পাদন ফার্মটি বন্ধ করে দিতে হল। গবাদি পশুদের মধ্যেও গর্ভপাত বেড়েছিল।

নানা রকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফ্লাই অ্যাশের আর্সেনিকের ক্ষেত্রে বাড়ির সাধারণ মাছি থেকে ফলের মাছি প্রভৃতিরাও স্পর্শকাতর। সুইডেনের রনস্কার তাম্র নিস্কাশন কেন্দ্র নির্গত আর্সেনিকে মানুষের গর্ভপাত ও কম ওজনের শিশু জন্ম হত (world Health Organisation: Arsenic and arsenic compounds, (second edition, WHO Geneva, 2001). আর্সেনিকের উতসের যত কাছে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীলোকেরা কাজ করত তাদের ক্ষতি তত বেশি হত। দূরত্বের সঙ্গে ক্ষতি কমে যেত।পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং বিহারের ভোজপুর ও বকসারে নানা মাত্রার আর্সেনিক অধ্যুষিত অঞ্চলের তথ্যাদি থেকে দেখা যাচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্ত্রীলোকেরা যত বেশি দিন যত বেশি মাত্রার আর্সেনিক জল পান করেছেন, তাদের গর্ভস্থ বা গর্ভজাত সন্তানেরা তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (D. Cchakraborty: C. D. on Arsenic (2005)। স্বতঃস্ফূর্ত গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশু জন্ম, কম ওজনের নব জাতক এবং নব জাতকদের অধিক মৃত্যু দেখা গেছে। পৃথিবীর অন্যত্রও অনুরূপ অভিজ্ঞতা (W .E. Morton, D. A. Dunnette: Health Effects of Environmental Arsenic)

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading