প্রসঙ্গ- জলছবি ও চলচ্চিত্র

16 Feb 2017
0 mins read

রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ ছবির কথাই ধরা যাক। ছবিটি মুক্তি পাবার পর বহু বিদগ্ধ সমালোচক বলেছিলেন - জলই এই ছবির প্রধান চরিত্র। তাই জলকেই পরিচালক ব্যবহার করেছেন ছবিটিকে প্রাণবন্ত করার জন্য। চিত্র গ্রাহক ছিলেন দীনেন গুপ্ত। ছবিটিতে দেখা গিয়েছে জল চরিত্রকে অন্ন দিচ্ছে, প্রেম ভালোবাসা দিচ্ছে, আবার দুঃখে মনকে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছে। গৌতম ঘোষ-এর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ছবির ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ছবিটিতে জলের ব্যবহার অনবদ্য, অপূর্ব ( চিত্রগ্রহণ ও পরিচালক গৌতম ঘোষ )।

ছায়াছবিতে প্রকৃতিকে ব্যবহার শুরু হয়েছে এই শিল্পের শুভ জন্ম মুহূর্ত থেকেই। যেমন একদিকে গগনচুম্বী পাহাড়কে তেমিন অন্য দিকে নদীকে। সমুদ্রের এমনকি পুকুরের জলকেও ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন ছবির বিভিন্ন প্রয়োজনে।

১৮৯৬ সালে মিঃ স্টিফেন ও মিসেস নেলী স্টিফেন নামে দুই বিদেশি ধর্মতলার গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে ভিজে সাদা কাপড়ের উপর ছবি দেখাতো।

একটা চৌকো চারদিক আটকানো একটা টিনের বাক্সের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে সেই বাক্সের গায়ে একটা গোল ছিদ্রের সামনে একটা টুকরো ফিল্ম ধরতো। ভিতরের আলো ঐ ফিল্মের উপর পড়তেই তার একটা ছায়া ঐ ভিজে কাপড়ের উপর পড়তো। ঐ ছায়াগুলি ছিল স্থির চিত্র—যেমন রেলগাড়ি ছুটছে, রাস্তায় কুকুর ডাকছে, সমুদ্রের উপর জাহাজ ভাসছে ইত্যাদি ইত্যাদি সব বিভিন্ন ছবি। পরবর্তী কালে ঐ স্থির এবার একটু একটু করে নড়তে শুরু করল। অর্থাত যাত্রা শুরু হল সর্ট ফ্লিম বা ছোট ছবি করার। এইভাবে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে বিংশ শতাব্দীতে দেখা গেল ছবির মধ্যে দেখা যাচ্ছে নদীর মাছ ধরছে। তাই বলা যেতে পারে চিত্রে জলের ব্যবহার শুরু হল। চিত্রে জল -এর ব্যবহার বলতে গিয়ে আমার একটা বিশেষ ঘটনা মনে পড়ে গেল। কলকাতায় প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করেন অতীতের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত, বিজ্ঞাপন ছিল বিখ্যাত চা ব্যবসায়ী লিপটন –এর। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, চিত্রটির চিত্র গ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্র গ্রাহক সুব্রত মিত্র। পথের পাঁচালীর চিত্র গ্রহণের জন্য ছবিটি সারা বিশ্বের বিদগ্ধজনের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিল।

যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেহেতু চায়ের বিজ্ঞাপন তাই সুব্রত মিত্র পনেরো, ষোলোটি জায়গা থেকে জল সংগ্রহ করেছিল চায়ের লিকারের যথাযথ এবং অবশ্যই উত্কৃষ্ট রং তৈরি করার জন্য। জল প্রকৃতির সম্পদ। তবুও সেই জলের বোধহয় নিশ্চয়ই তারতম্য রয়েছে। সেই জন্যই হয়ত সুব্রত মিত্র বিভিন্ন জায়গা থেকে জল সংগ্রহ করেছিলেন। এখানেও সেই প্রাধান্যটাই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল অর্থাত সেই জল। বিংশ শতাব্দীতে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবিতে জলের ব্যবহার বিশেষভাবে দেখা গিয়েছে। কখনো খনির ব্যঞ্জনার ক্ষেত্রে, কখনো বা আবার ঘটনা এবং চরিত্রের প্রয়োজনে। কখনো বা শুধুমাত্র চরিত্রকে উজ্জ্বল করতে সমুদ্র কিংবা নদীর জলকে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি ছোটো জলাশয়ও এর ব্যাতিক্রম নয় বা বাদ যায়নি। বিশেষ করে গ্রাম্য চিত্র অর্থাত গ্রামের পটভূমিকায় যে সব ছায়াছবি তৈরি হয়েছে, সেখানে পুকুর থাকতই পল্লীগ্রামের প্রধান বৈশিষ্টটি ফুটিয়ে তোলার জন্য। গ্রাম ভিত্তিক ছবিতে পুকুর থাকবে না, পরিচালক সেই পুকুরে বিভিন্ন চরিত্র স্নান করবে না এ আবার হয় নাকী। আবার পুকুর থাকবে আর সেই পুকুরের জলে সাঁতার কাটার দৃশ্য থাকবেনা, সেটাও হয় না।

তবে বেশ কয়েকটি ছবিতে জল -এর ব্যবহার আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’, রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’, গৌতম ঘোষ -এর ‘পার’ এবং ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, জগন্নাথ চ্যাটার্জীর ‘খেয়া’ প্রভৃতি ছবিতে দেখা যায় জল এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। কাহিনির আসল বিষয় বস্তু যাই হোক বা বলা যায় কাহিনি বিন্যাস এমনভাবে গ্রথিত হয়েছে যে তাতে মনে হয় জলই যেন চরিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অর্থাত বলা যেতে পারে জল ছবির প্রধান চরিত্র, যেমন বেহুলা লক্ষ্মীন্দর ছবি দেখার পর অনেকেই মন্তব্য করেছেন - গঙ্গাই লক্ষ্মীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে।

রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ ছবির কথাই ধরা যাক। ছবিটি মুক্তি পাবার পর বহু বিদগ্ধ সমালোচক বলেছিলেন - জলই এই ছবির প্রধান চরিত্র। তাই জলকেই পরিচালক ব্যবহার করেছেন ছবিটিকে প্রাণবন্ত করার জন্য। চিত্র গ্রাহক ছিলেন দীনেন গুপ্ত। ছবিটিতে দেখা গিয়েছে জল চরিত্রকে অন্ন দিচ্ছে, প্রেম ভালোবাসা দিচ্ছে, আবার দুঃখে মনকে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছে। গৌতম ঘোষ -এর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ছবির ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ছবিটিতে জলের ব্যবহার অনবদ্য, অপূর্ব ( চিত্র গ্রহণ ও পরিচালক গৌতম ঘোষ )।

সরোজ দের ‘কোনি’ ছবির ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে ( এই ছবিতে সহকারি হিসাবে আমি [ লেখক ] যুক্ত ছিলাম )। জলই কোনির জীবন, তাই জীবন সংগ্রামে তাকে জয়ী হতে হবে। তাই তাকে জীবন পথ ধরে এগিয়ে যেতে হয়েছে। আর তাকে এই সংগ্রামে উদ্দীপিত করেছেন তার সাঁতারের শিক্ষক ক্ষিতি দা (সৌমিত্র চ্যাটার্জী), অভাবনীয় সাফল্যে উজ্জ্বল এই ছবিটি দেখে অনেকে বলেছিলেন বহু দিন এই ছবির কথা দর্শকদের মনে থাকবে।

অতীতে এবং বর্তমানেও বহু ছবির রোমাণ্টিক গানের দৃশ্যে জলকে ব্যবহার করা হয়েছে। কেবল আনন্দেই নয়, বিয়োগান্তক দৃশ্যেও নৌকায় মাঝির ভাটিয়ালী গান ব্যবহার করা হয়েছে।

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কয়েকটি ছবির গান, ‘হসপিটাল’ ছবির সেই গানটি – ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’ কিংবা ‘শঙ্খ বেলা’ ছবির গান – ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, এমনকি বহুদিন আগেকার বহু পুরোনো ছবি সুশীল মজুমদারের ‘শুভ রাত্রি’ ছবিতে শোনা – ‘কে ঢেউ নাগালো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গান এবং তার ব্যবহার অর্থাত জলের উপরে চরিত্রের মুখে গানগুলি যেন চরিত্রগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

তাই বলা যেতে পারে ছায়াছবিতে জল -এর ব্যবহার বিশেষভাবে স্বার্থক শুধু নয় ভীষণভাবে স্বার্থক ও জনপ্রিয়। তবুও কেন এই ছবিতেই জলকে শত্রু ভাবা হয়েছে। পরিচালক অসিত সেন -এর ‘স্বরলিপি’ ছবিতে বন্যায় ভেসে যাওয়া গ্রাম ছেড়ে ছবির নায়িকা ( সুপ্রিয়া দেবী ) চলেছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। সারা গ্রাম জলে থৈ থৈ, কোথায় গিয়ে আশ্রয় পাবে, কোথায় গিয়ে তার প্রাণ বাঁচাবে নায়িকা ? এগিয়ে চলেছে আর নেপথ্যে চলেছে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের অনবদ্য রচনা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গোল্ডেন ভয়েস -এ একটি গান – ‘বিধি এ তোর কেমন বিচার বল, যে জলেতে তুমি তৃষ্ণা মেটাও, সেই জলেতেই কেন বিপদ হানো’।

Source: Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading