প্রস্তাবনা


ছয় দশক আগে বিদেশ থেকে এসে এক বিশ্ব বিখ্যাত ভৌগোলিক রেল গাড়িতে দেশ ভ্রমনে ভারতের ভূমি প্রকৃতি ও তার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ জল সংরক্ষণ ও তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কত বৈচিত্রময় করে তুলেছে l মৌসুমী বৃষ্টির জল সযত্নে ধরে রেখে সারা বছর ব্যবহারে কত সযত্ন প্রয়াস l প্রশ্ন করেছিলেন, এই অভিজ্ঞতাকে কি কাজে লাগানো য়ায না l ষাট বছর পর এখন কথা উঠেছে বড় বড় জলসেচ প্রকল্পের উপর নির্ভরশীলতার বাইরে আমাদের ছোট বড় জলাধারগুলিকে জল সংরক্ষণের কাজে লাগাতে পারলে অতি অল্প ব্যয়ে স্থানীয় ভাবে তৃষ্ণা ও সেচের চাহিদা মেটানো সম্ভব, তাই সেদিকে নজর দিতে হবে l

নদীমাতৃক পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সর্বত্র পুকুরকে এভাবেই দেখা হয়েছে l রাজারাজড়া, জমিদার থেকে শুরু করে রায়ত কৃষক যাদের ছিটে ফোঁটাও জমি ছিল- সকেলই চাষের সঙ্গে জলের সংস্থানের কথা ভেবে পুকুর, দীঘি কাটিয়েছেন, মরা বা পরিত্যক্ত নদীখাতে বাঁধ দিয়ে জলধারণ ব্যবস্থাকেই বলা হয় ঐতিহ্যবাহী দীঘির জল ধরে সেচের আয়োজন l

আমাদের দেশে তৃষ্ণা মেটাতে বা সেচের জল সরবরাহ করেত ছোট বড় জলাধার নিয়ে বিতর্ক এখানে অপ্রাসঙ্গিক l প্রাসঙ্গিক শুধু আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে প্রাচীন অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার সংমিশ্রণে প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করার প্রয়াসকে উপেক্ষা না করে, স্বাগত জানানো l এতে কোন ক্ষতি তো নেই-ই, বরং ছোট ছোট প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাহিদা মেটানোর এ এক অতি সহজ পদ্ধতি l

‘আজও পুকুর আমাদের’-এই বইটির মূল রচনা হিন্দীতে, লেখক অনুপম মিশ্র l প্রকাশক ‘গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান’ l লেখক মূল বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘আজ ভি খরে হ্যায় তালাব’ l তাকে সামান্য বদল করে যে বাংলা শিরোনাম দিয়েছেন তাতেও বইটির সঠিক বক্তব্য পরিস্ফুট হয়েছে l নয়টি পরিচ্ছদের নামও বাছা হয়েছে অতি স্বযত্নে যাতে আমাদের জীবনে, সাদামাটা সংসারে পুকুরের অবদান ধরা পড়ে, পুকুরের ধারে গড়ে ওঠা গ্রাম সমাজে তার রক্তের বাঁধন ভুলে না যাই l

পুরুলিয়ার নিরুপমা অধিকারীর সঙ্গে বইটির প্রসঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখনই জল নিয়ে তাঁর আন্তরিক উত্সাহ আমাকে নাড়া দিয়েছিলো l আজ সেই জলের সন্ধানে তাঁর ‘পুকুর আবিষ্কার’ রীতিমত মুগ্ধ করেছে l ভূগোল চর্চা করতে গিয়ে জলের ব্যবহার, অপব্যবহার নিয়ে অনেক কথা বলেছি, পড়েছি, লিখেওছি l স্বাধীনতা পরবর্তী সেই যুগে তরুণ বয়সে এ রাজ্যের বহুমুখী নদী পরিকল্পনাগুলি প্রায় পদব্রজে ঘুরে খুঁটিয়ে দেখে মনে হয়েছে, ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ্ পায়না’- এই কথাটি কত ঠিকl আমাদের চিরকালের পুকুর ও দীঘি-দহগুলি হেজে মজে সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে গেলl আর আমরা ছুটেছি টেনেসি নদীর মডেলের দিকে l এ কথা কেউ বলে না যে বিদেশী মডেল মানেই খারাপ, অথবা তা থেকে শেখার কিছু নেই কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব হাজার হাজার পুকুরকে কেন ভুলে যাব? এথন বলা হচ্ছে বর্ষার অতিরিক্ত জল ধারণের জন্য বিশাল বড় বড় জলাধার যথেষ্ট নয়, বরং পলি জমে দিন দিন তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে বানের বিপদ তারা বৃদ্ধি করে l পশ্চিমবঙ্গে আধ- ডজন এমন জলাধারের রক্ষণাবেক্ষণ করাই প্রায় যেখানে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নতুনের কথা ভাবাও দূরূহ l

মাঝে মনে হয়েছিল আমাদের রাজ্যা ভৌমজলের প্রাচুর্য, তার ব্যবহারে আমাদের তৃষ্ণো মিটবে l এখন দেখা যাচ্ছে অতি ব্যবহারে সেই ভাণ্ডারেও টান পড়েছে, জল গরল হয়ে উঠে আসছে কোনও কোনও জায়গায় l তাই বিস্বস্ত সেই ‘পুরতান ভৃত্যকে’ স্মরণ করেতই হচ্ছে l নিরুপমা অধিকারী একটি চিঠিতে আমাকে লিখেছিলেন- এই বইটি সমাজের সেই হৃদয়কে, জলের উপের আধারিত সেই জীবন দর্শনকে বোঝার ও বোঝানোর একটি প্রয়াশ, যে হৃদয় দেশের এই কোনা থেকে ঐ কোনা পর্যন্ত নিজেদের শক্তি ও সম্পত্তি দিয়ে তৈরী করত পুকুর l

নিরুপমা বলছিলেন- কারা করত এই পুকুর, কারা করাত এই পুকুর, কত প্রকারের হত, কিভাবে করত- এই কথাগুলি বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে বইটিতে l চেষ্টা করা হয়েছে জলের অভাবে বর্ষার বাইরের দিনগুলিতে দুর্দশার পরিক্রমাটিকেও বুঝে নেবার l­­­­­ ঘোরতর উপেক্ষার মধ্যে আজও পুকুর আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ গ্রাম ও হাজার হাজার শহরকে বরুন দেবতার প্রসাদ বিতরণ করে চলেছে l

জল ও পরিবেশ-প্রেমীদের বইটি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস l

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading