পুরুলিয়ার ভৌম জলের কথা


ভৌম জলের অপ্রতুলতার জন্যই পুরুলিয়ার মতো শক্ত শিলাদ্বারা গঠিত অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সামান্য পরিমাণ পানীয় জল সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

পানীয় জলের উত্স ছাড়াও ভৌম জল সম্পদের ব্যবহার কৃষিকাজে ক্রমবর্ধমান। তামাম দুনিয়ার মতো পুরুলিয়াতেও এই জল আহরণ ও উত্তোলনের প্রাথমিক বিধিগুলি যথাযথ প্রতিপালিত না হওয়ার জন্য অনেক স্থানেই জলতলের স্বাভাবিক সমতা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে পুরুলিয়াতেও দেখা দিচ্ছে ভৌম জলের সংকট।

আমরা জানি পৃথিবীতে স্বাদু জলের উত্স হিসাবে ভৌম জল অতি পরিচিত l মাটির বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে এই জলের বিশুদ্ধিকরণ ঘটে l প্রকৃতি থেকে পাওয়া সমস্ত সম্পদের মধ্যে ভৌম জল হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ স্বাদু জলের উত্স সন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে । ফলস্বরূপ ভৌম জলের আধার তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে । যদিও এই আধার সব জায়গায় একই রকমভাবে বিস্তৃত নয়।

ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ও বৃষ্টিপাত ভৌমজলের পরিমাণকে নির্ধারণ করে। আমাদের পুরুলিয়া জেলার মাটি পাথুরে, তাই এখানে ভৌমজলের আধার অপ্রতুল। আর এই অপ্রতুল আধারকে আমরা আরও সংকটে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের বিবেচনা রহিত আচরণে মধ্য দিয়ে।

এ কথা সকলেই জানেন বৃষ্টির জলই ভৌমজলের প্রধান উত্স। বৃষ্টির জল মাটির ওপর পড়ার পর স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী কিছু অংশ মাটির ছিদ্র পথ দিয়ে ভিতরে চলে যায়। বাকি অংশ ভূমির ঢাল ধরে নদী বা জলাশয়ে গিয়ে মেশে। প্রধাণতঃ ভূমির যে অংশ বালি বা দোঁয়াশ মাটি দ্বারা গঠিত, সেই অংশ দিয়ে বৃষ্টির জল ভিতরে প্রবেশ করে ও মাটির নীচে নির্দষ্ট স্তরের [ ভূ-বিজ্ঞানের ভাষায় মাটির নীচে এই নির্দিষ্ট স্তরকে অ্যাকুইফার(Aquifer) বলা হয়] মধ্যে ভূমির ঢাল অনুযায়ী প্রবাহিত হয়। জায়গায় জায়গায় মাটির গঠন অনুযায়ী মাটির নীচের এই স্তরের গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন হয়। যে কোন জায়গায় কুয়ো খোঁড়ার সময় মাটির এই বিশেষ স্তরের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। জলপূর্ণ এই স্তরগুলি সবসময়ে প্রবাহমান অবস্থায় থাকে। তাই যখন কোন ছিদ্র পথে মাটির উপরিতল থেকে ঐ স্তরে পৌঁছানো যায়, তখন ঐ প্রবাহমান জলের সন্ধান মেলে। কোন কোন সময় ঐ জলপ্রবাহ অতি উচ্চচাপ যুক্ত অবস্থায় থাকে, তাই কোন ছিদ্র পথ ঐ স্তরের সঙ্গে যুক্ত হলে উচ্চ চাপযুক্ত জল তীব্র বেগে নির্গত হয়। কিন্তু শক্ত শিলা যুক্ত স্থানে ভৌম জলপ্রবাহ ভিন্ন রকমের হয়। কারণ ঐ স্থানে শিলার উপরিভাগের ফাটলের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল নীচে যায় আর ভূমির ঢাল অনুসারে প্রবাহিত হয়। স্থান বিশেষে ফাটলের নীচের Weathered residuum অংশে জমা হয়। সাধারণভাবে শক্ত শিলা দ্বারা গঠিত ভূ-ভাগে ভৌমজলের প্রবাহ পলিমাটি দ্বারা গঠিত অঞ্চলের জলপ্রবাহের তুলনায় কম হয় । এই একই কারণে পুরুলিয়ার মতো জায়গায় এই জলের পরিমাণ কম । ভৌম জলের অপ্রতুলতার জন্যই পুরুলিয়ার মতো শক্ত শিলাদ্বারা গঠিত অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সামান্য পরিমাণ পানীয় জল সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

বৃষ্টিপাত ভৌমজলের প্রধাণ উত্স, তাই কোন অঞ্চলের ভৌম জলের আলোচনায় সেই জায়গার বৃষ্টিপাতের গতি প্রকৃতি জানার প্রয়োজন রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় গ্রীষ্মের শেষে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সাধারণ ভাবে এই বৃষ্টিপাত হয়। মাটির গঠন অনুযায়ী বৃষ্টির জলের একটা অংশ মাটির ভিতরে প্রবেশ করে ও ভৌমজলের যোগান দেয়। এই প্রক্রিয়াকে রিচার্জ (Recharge) বলে। যেহেতু বৃষ্টির জল ভৌমজলের যোগান দেয়, তাই প্রতিবত্সর এর পুনর্নবীকরণ ঘটে থাকে।

প্রতিবত্সর যে পরিমাণ ভৌম জল উত্তোলন করা হয়, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তার সবটুকুই বৃষ্টির জলে পূর্ণ হয়। ফলতঃ কখনই এই জলসম্পদ শেষ হয় না। তবে ব্যবহারের আগে এর সঠিক পরিমাণ জানা প্রয়োজন। সাধারণভাবে ভূগর্ভস্থ প্রবহমাণ জলধারার ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমার পার্থক্য থেকে কতটা জলসম্পদ উত্তোলন করা যাবে তার হিসাব পাওয়া যায়। অর্থাত জলতল সীমার এই ওঠানামার পরিমাণ থেকে আমরা ভৌমজল সম্পদের সঠিক পরিমাণ জানতে পারি। স্বাভাবিকভাবে বর্ষাকালে জলের নিম্নসীমা পরিমাপ করা যায়। জলতলের এই ব্যাপক ওঠানামার জন্য অনেক জায়গাতেই গ্রীষ্মকালে জল উত্তোলন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রধাণত মালভূমির শক্ত শিলা দিয়ে গঠিত অংশে ফাটলের মধ্য দিয়ে জলধারা প্রবাহিত হয়। ঐ সমস্ত জায়গায় গ্রীষ্মকালে জলতল সীমা এত নীচে নেমে যায় যে সামান্য পরিমাণ পানীয় জল সংগ্রহ করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নলকূপের সাহায্যে অপরিকল্পিত ভাবে ভৌমজল উত্তোলন করার ফলে গ্রীষ্মকালে নিম্নমুখী জল তল সীমা জল তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ভূ-প্রাকৃতিক তারতম্যের জন্য মাটির নীচের জল সম্পদের ব্যবহার ভিন্ন হয়। পুরুলিয়ার ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্রপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে দেখলে এই জেলায় সমভূমির পরিমাণ শক্ত পাথুরে অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। মাটির স্তর বিন্যাস অনুযায়ী জেলা ভৌম জলসম্পদে সমৃদ্ধ। তবে জেলার সব স্থান থেকে সমপরিমাণ ভৌম জলসম্পদ আহরণ করা হয় না। কারণ ভৌম জলসম্পদের চাহিদার তারতম্য। এই জলসম্পদের চাহিদার একটা বড় অংশ অবশ্যই পানীয় জলের উত্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাকি অংশ কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে লাগে। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি চলে আসার ফলে ভৌমজলের ব্যবহার সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গভীর ও অগভীর নলকূপ, খনন করে প্রধাণত এই সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে। অনেক জায়গাতেই হচ্ছে প্রচুর অপচয়। সবে মিলে পুরুলিয়ার ভৌমজলসম্পদ আজ সংকটের মুখে।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading