পুরুলিয়ার খরা ও তার প্রতিকারের উপায়


আশাবরী নামের পুরুলিয়ার একটি সংস্থা গ্রামের লোকজনকে সাথে নিয়ে পুকুরটির সংস্কার করে। এখন পুকুরটির থেকে গ্রামবাসী শুধু স্নানের জল নয়, সমস্ত বছর ধরে মাছ চাষ এবং সেচের জল ব্যবহার করে থাকে। পুকুরের কাছের জমিগুলি এখন আর এক ফসলা নয়, দো-ফসলা, তিন ফসলায় পরিণত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যেতেই পারে বড় বড় পুকুরগুলিকে বাঁচাতে পারলে এক সাথে অনেক কাজ করা যেতে পারে।

প্রথমেই আমাদের বুঝে বুঝে নেওয়া যাক খরা কাকে বলে। আসলে খরা হল- গরমের সময় প্রচণ্ড দাবদাহে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর যখন সব শুকিয়ে যায়, জলের জন্য ওঠে চারিদিকে বুকফাটা হাহাকার, জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন মাঠেই ফসল যখন মাঠেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখনই তাকে আমরা খরা বলি l এক কথায় জলের জন্য হাহাকারই হল খরা। আসলে বন্যার মতো খরাও একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এই খরা পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলোর নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধেই বছরের পর বছর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে পুরুলিয়ার মানুষের জীবনযাত্রাl

খরাকে এই জেলার মানুষ ভাগ্যের পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছে l অত্যাধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতির যুগেও আমাদের পুরুলিয়া মানুষ মনে করে এ তাদের কপালের লিখন l

যে কোন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং জলবায়ু যে খরার জন্য অনেকটা দায়ী তা অস্বীকার করা যায় না l পুরুলিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুলিয়া জেলাটি মূলত একটি পাহাড়ী ভূখণ্ডে গঠিত। এটি ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের পূর্বঢালে অবস্থিত l সমুদ্রপৃষ্ট থেকে এই জেলার গড় উচ্চতা ১৫০-৩৩০ মিটার l সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে ল্যাটেরাইটযুক্ত অনুর্বর মৃত্তিকা l ভূমি সিঁড়ির ধাপের মতো উঁচু নীচু অসমতল হওয়ায় বৃষ্টির জল জমবার এখানে সুযোগই পায় না। সহজেই জল গড়িয়ে যায় l আবার ভূস্তর কঠিন শিলাযুক্ত হওয়ায় জল মাটির নীচে বেশি দূর চুইয়ে চুইয়ে ঢুকতেও পারে না l তাই যদিও জেলায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তা সত্ত্বেও গরমের সময় জেলায় দেখা যায় জলের প্রচণ্ড অভাব। আসলে উপযুক্ত জলধারণের ব্যবস্থা না থাকায় বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির জল জেলায় ছড়িয়ে থাকা জোড় এবং নদীপথে সমতলভূমির দিকে গড়িয়ে যায় l আবার এখনতো রাস্তাঘাট হচ্ছে সব ঢালাইয়ের। চারদিক মুড়ে যাচ্ছে কংক্রিটে । জায়গায় জায়গায় বিশেষত শহরে ঘর বাড়ি বানাতে গিয়ে পুকুর, ডোবা, ঝিল প্রভৃতি বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে l জলাশয়গুলিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজও হচ্ছে না l

ধারাবহিকভাবে মানুষের জলের চাহিদা বাড়ায় মাটির বহু নীচ থেকে জলকে তুলে নেওয়া হচ্ছে l বড়ো বড়ো নির্মান ক্ষেত্রে জল তোলা হচ্ছে অকৃপনভাবে। কৃষিকাজও চলছে একই ভাবে l পুরনো কুয়োগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকট আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে l তাই সব দিক থেকেই খরার পথকে প্রসস্ত করে তোলা হচ্ছে।

আমরা অবাধে বনাঞ্চল করতে পারিনি কিন্তু বনভূমির যথেচ্ছ ধ্বংস করছি। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দিন দিন কমছে l ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে l প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় খরা নামক বিশালাকায় দানবটি বহাল তবিয়তে নিজের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে বছরের পর বছর l

পুরুলিয়া জেলার আয়তন ৬২৫৯ বর্গ কি. মি.। জনসংখ্যার বিচারে পুরুলিয়া জেলার স্থান দেশের মধ্যে ১৩৪ নং- এ। জনঘনত্ব ৪০৫ জন প্রতি বর্গ কি.মি। পুরুলিয়া জেলায় মোট গ্রামের সংখ্যা ২৬৮৭। পৌরসভা ৩টি- পুরুলিয়া, ঝালদা ও রঘুনাথপুর। পঞ্চায়েত-এর সংখ্যা ১৭০টি।

পুরুলিয়া জেলার খরার থেকে পরিত্রাণের উপায়


পুরুলিয়া জেলায় খরা মোকাবিলা অনান্য জেলার তুলনায় সহজে হতে পারে। তার কারণ এর ভূ-প্রকৃতি। যে ভূ-প্রকৃতির কারণে বৃষ্টির জল সহজেই নীচের দিকে গড়িয়ে যায় সেই ভূ-প্রকৃতির জন্যই বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একদিকে একটি পাড় বেঁধে দিয়েই একটি বড়-সড় পুকুর নির্মাণ করা সম্ভব। তাই পুরুলিয়া জেলায় খরা থেকে পরিত্রাণের সব থেকে উপযুক্ত, বড় ও শক্ত হাতিয়ার হল পুকুর নির্মাণ।

মজে যাওয়া পুকুরগুলিতে সঠিকভাবে সংস্কার করা হলে স্নানের জলের সমস্যা দূর হতে পারে। সেচের জন্যও জল পাওয়া যাবে। পাড়া থানার রামকৃষ্ণপুরের একটি পুকুরের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পুকুরটি এক সময় এতো বড় ছিল যে এই পুকুরে কুমির বাস করত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুরটির অনেকটা মজে যায়। তারপর ‘আশাবরী’ নামের পুরুলিয়ার একটি সংস্থা গ্রামের লোকজনকে সাথে নিয়ে পুকুরটির সংস্কার করে। এখন পুকুরটির থেকে গ্রামবাসী শুধু স্নানের জল নয়, সমস্ত বছর ধরে মাছ চাষ এবং সেচের জল ব্যবহার করে থাকে। পুকুরের কাছের জমিগুলি এখন আর এক ফসলা নয়, দো-ফসলা, তিন ফসলায় পরিণত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যেতেই পারে বড় বড় পুকুরগুলিকে বাঁচাতে পারলে এক সাথে অনেক কাজ করা যেতে পারে।

ছোট ছোট নদীগুলিতে যদি ছোট ছোট বাঁধ দেওয়া যায় তাহলে অন্ততঃ এক একটা অঞ্চলের সমস্যা মেটানো যেতে পারে। খরার সমস্যা মেটানোর জন্য সরকার এখন শুরু করেছে রিভার লিফটিং ইরিগেশন প্রকল্প। সেচের কাজে বা খরার মোকাবিলায় এই প্রকল্প যথেষ্ট উপযোগি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পুরুলিয়াতে অনেক জোড় আছে। সেই জোড়গুলিতে যদি পাকা বাঁধ দেওয়া যায় এবং বর্ষার সময় জল ধরে রাখা যায় তাহলে এক সাথে দুটো কাজই হতে পারে। একদিকে চাষি যেমন চাষের সময় তার প্রয়োজনীয় জল পাবে অন্যদিকে তেমনি এক ফসলি জমিকে বহু ফসলী জমিতে পরিণত করা সম্ভব হবে।

মজে যাওয়া পুকুরগুলিতে সঠিকভাবে সংস্কার করা হলে স্নানের জলের সমস্যা দূর হতে পারে। সেচের জন্যও জল পাওয়া যাবে। পাড়া থানার রামকৃষ্ণপুরের একটি পুকুরের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পুকুরটি এক সময় এতো বড় ছিল যে এই পুকুরে কুমির বাস করত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুরটির অনেকটা মজে যায়। তারপর ‘আশাবরী’ নামের পুরুলিয়ার একটি সংস্থা গ্রামের লোকজনকে সাথে নিয়ে পুকুরটির সংস্কার করে। এখন পুকুরটির থেকে গ্রামবাসী শুধু স্নানের জল নয়, সমস্ত বছর ধরে মাছ চাষ এবং সেচের জল ব্যবহার করে থাকে। পুকুরের কাছের জমিগুলি এখন আর এক ফসলা নয়, দো-ফসলা, তিন ফসলায় পরিণত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যেতেই পারে বড় বড় পুকুরগুলিকে বাঁচাতে পারলে এক সাথে অনেক কাজ করা যেতে পারে।

শহর ও গ্রামের বাড়িগুলিতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব। এই উদ্যোগকে জেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে একদিকে জলকষ্ট দূর হবে, অন্যদিকে মাটির আর্দ্রতাও বজায় থাকবে।

এগুলি ছাড়াও জলের অপচয় রোধ করতে হবে। জলের অপচয় যাতে কোনভাবেই না ঘটে তারজন্য অবশ্যই সার্বিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading