ফ্লোরাইড-অজ্ঞতা ও ফ্লোরোসিসের বাস্তবতা


বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের 7টি জেলার 43টি ব্লকের নলকূপের জলে অত্যধিক ফ্লোরাইড।... কোলাখুর্দ গ্রামে (পোস্ট অফিসে : জগদীশপুর) দেখলাম যে দেড়- দু হাজার মানুষের গ্রামটির বেশিরভাগ লোকই ফ্লোরোসিসে জীবন্মৃত।... নসিপুর গ্রামের ফ্লোরোসিস জগতবিখ্যত। সেখানে এক সময় নলকূপের জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা ছিল লিটার প্রতি 16 মি. গ্রা. আদ্রার খাইরিতে 8 মি.গ্রা.। আর কোলাখুর্দেও প্রায় ৮মি.গ্রা.। এবারে ভয়ংকরভাবে ফ্লোরাইড আক্রান্ত কিছু গ্রামের সন্ধান পেয়েছি গয়া, নওয়াদা, মুঙ্গের অঞ্চলে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদেহে, বিশেষ করে মেরুদণ্ডী প্রাণীসমূহের দেহে, ফ্লোরাইড কী ক্ষতি করতে পারে তা আমাদের রসায়নের পঠন - পাঠনের বইগুলিতে কোথাও নাই। চিকিত্সা বিজ্ঞানের পাঠ্যতেও বিষয়টি গুরুত্বহীন। কারণ হচ্ছে যে ফ্লোরোসিস হল গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষের রোগ এবং আমাদের সিলেবাস তৈরি হয় ইংল্যান্ড আমেরিকা বইগুলির ভিত্তিতে। আর ওই সব দেশে ফ্লোরোসিস, আর্সেনিকোসিসের প্রাথমিক আবিষ্কার ও গবেষণাদি হলেও সেখানে আজ ওই সব রোগ নিয়ন্ত্রিত, সেগুলির সমস্যাসমূহ অনেকটাই সমাধিত। আমি প্রায় অর্ধশতাব্দী ফ্লোরিন, ফ্লোরাইড প্রভৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন, গবেষণাদি করেও পাঁচ বছর আগেও জানতাম না যে ফ্লোরাইড মানুষ ও প্রাণীদেহে এত সব ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটায়। সন্দেহ নেই যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও শারীরবিদ্যার (এমনকি ডাক্তারদের বেশিরভাগেরও) একই দশা।

আমার প্রথম শিক্ষা শুরু 2006 সালের 1 লা জুলাই, বীরভূমের নলহাটির নিকটবর্তী নসিপুর গ্রামের ‘ববলু মাস্টার’ – এর হাতে। শান্তিনিকেতনে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ফ্লোরোসিস আক্রান্ত গ্রামের সংবাদ শুনে কৌতুহলবশত নসিপুর গিয়েছিলাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও খড়্গপুর আই আই টি-র প্রাক্তন অধ্যাপক বিশিষ্ট রসায়নবিদ ধনঞ্জয় নসিপুরি ওই গ্রামের। তাঁর পদবি / উপাধির মধ্যেই গ্রামের নাম রয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ গ্রামটিতে গিয়েই দেখলাম 8 / 10 বছরের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ফ্লোরাইড কথাটির সাথে সুপরিচিত। আমার আগমন ও অনুসন্ধানের কারণ শুনে তারা হি হি করে হাসতে বলল – “বাবলু মাস্টারের কাছে যাও”। তখনই দেখেছিলাম ছেলে মেয়েদের দাঁত হলদেটে, লাল, বাদামি, কালচে। এ রকম বিচিত্রিত mottled teeth যে ফ্লোরাইড বিষণের নিশ্চিত চিহ্ন, তা আমি পরে জেনেছি। বাবলু মাস্টার কোনো স্কুলের শিক্ষক নন। গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে কিছু উপার্জন করে কোনোমতে বেঁচে ছিলেন। তাঁর বয়স অনুমান করা শক্ত।

কারণ তাঁর সারা দেহে অকাল বার্ধক্য। পিঠ কুঁজোর মত বাঁকা। দেড়-দুই ঘণ্টা তিনি আমাকে জলবাহিত ফ্লোরাইড ও তার তাণ্ডবের কথা বললেন। আমি মনোযোগ সহকারে সব নোট করলাম। সেই আমার ফ্লোরোসিসের প্রথম পাঠ। এক দিদি ছাড়া তাঁর অন্যান্য 7 / 8 জন ভাইবোন অকালমৃত। 2009 সালের অক্টোবর নসিপুরে আবার গিয়ে জানলাম বাবলু মাস্টার প্রয়াত। বাঁকা পিঠের তাঁর জীবিত একমাত্র দিদিকে দেখলাম। দুবার-ই আর একজন ফ্লোরোসিস রোগী বিশ্বনাথ রবিদাসের (বয়স তখন প্রায় 63 / 64) সঙ্গে অনেকক্ষণ ছিলাম। তাঁর রোগযন্ত্রণার শুরু হয় আশির দশকের শেষ থেকে। তাঁকে সব সময় শুয়েই থাকতে হয়। ভারী দেহ। বিছানায় এপাশ ওপাশ ফিরতেও তাঁকে তাঁর স্ত্রী বা ছেলের সাহায্য নিতে হত। চিকিত্সা ও নিরাময়ের জন্য তিনি রামপুরহাট, বর্ধমান হাসপাতাল থেকে শুরু করে কলকাতার এস.এস.কে.এম. হাসপাতাল পর্যন্ত ঘুরে, অনেক হয়রান হয়ে, শেষ পর্যন্ত একেবারে নিরাশ হয়েছেন। 2009 সালের অক্টোবর আমি আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করি। এই গ্রামটি ঝাড়খণ্ডের সীমানায়। এই সময় আদ্রার কাছে খাইরি গ্রামেও দেখেছি, ফ্লোরোসিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের 7টি জেলার 43টি ব্লকের নলকূপের জলে অত্যধিক ফ্লোরাইড।

গত সেপ্টেম্বরে আমি বিহারের ভাগলপুরের কাছে কোলাখুর্দ গ্রামে ( পোস্ট অফিসে : জগদীশপুর) দেখলাম যে দেড়- দু হাজার মানুষের গ্রামটির বেশিরভাগ লোকই ফ্লোরোসিসে জীবন্মৃত। ভাগলপুর - মান্দার হিল শাখা লাইনে জগদীশপুর ও টিকলি রেল স্টশনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে, রেল লাইন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত কোলার্খুদ। ওইসব অঞ্চল বিভূতিভূষণের বিখ্যাত আরণ্যক উপান্যাসের পটভূমি। নসিপুর গ্রামের ফ্লোরোসিস জগতবিখ্যত। সেখানে এক সময় নলকূপের জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা ছিল লিটার প্রতি 16 মি. গ্রা. আদ্রার খাইরিতে 8 মি.গ্রা.। আর কোলাখুর্দেও প্রায় 8 মি.গ্রা.। এবারে ভয়ংকরভাবে ফ্লোরাইড আক্রান্ত কিছু গ্রামের সন্ধান পেয়েছি গয়া, নওয়াদা, মুঙ্গের অঞ্চলে। দেখি যেতে পারি কিনা। গ্রামের লোকেদের অবস্থা এখন অতি চমত্কার। আগে তারা খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে মরত, আর মরত জীবাণু ঘটিত অসুখ - বিসুখে। এখন সেসবের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মাটির নীচ থেকে তোলা আর্সেনিক, ফ্লোরাইড প্রভৃতি অজৈব বিষ। ফ্লোরোসিস, আর্সেনিকোসিস প্রভৃতি অসুখ - বিসুখের সূত্রপাত মোটামুটি 1970-এর দশক থেকে, যখন জীবাণুমুক্ত জল সরবরাহের জন্য ব্যাপকভাবে নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল আহরণের ব্যবস্থা শুরু হল।

ফ্লোলোসিস সম্পর্কে জানার ইতিহাস


দাঁতের ফ্লোরোসিসের প্রথম আবিষ্কার বোধহয় ইটালির নেপলস অঞ্চলে। সেখান থেকে আমেরিকা আসা শিশুদের দাঁতের এলোমেলো ও ছোপ পড়া অবস্থা দেখা যেত। পরে বোঝা যায় সেগুলো শিশুদের শরীরে অত্যধিক ফ্লোরাইড অনুপ্রবেশের ফল। ইটালির আগ্নেয়গিরি থেকে প্রচুর ফ্লোরাইড নির্গত হয়ে আঞ্চলিক জলভাণ্ডার ও মাটিকে দূষিত করত। সেই ফ্লোরাইডেই শিশুদের দাঁত এলোমেলো ও বিচিত্রিত হত। অনুরূপ ব্যাপার 1901 সালে আমেরিকার কলোরাডো অঞ্চলে দেখেছিলেন ডঃ ফ্লেডেরিক সামনার ম্যাকে (Frederick Sumner Mckay)। দাঁতের এই ধরনের ছোপ পড়া অবস্থা ‘কলোরাডো ব্রাউন স্টেইন’ বা ‘টেক্সাস টিথ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। 1909 সালে কলোরাডোর পাইকস পিক অঞ্চলের স্কুলগুলিতে সমীক্ষা চালিয়ে ডঃ ম্যাকে ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেন যে স্কুলের বাচ্চাদের 87.5 শতাংশ দাঁত ‘মটলড’, বা ছোপ পড়া। এ সবই মনুষ্য দেহে ফ্লোরাইডের প্রতিক্রিয়া। ফ্লোরিন রসায়ন ও ফ্লোরিন পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতি (ফ্লোরাইড আয়ন সিলেকটিভ ইলেকট্রোড) তখন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ফ্লোরাইড গবেষণা তখন বেশি অগ্রসর হতে পারেনি।

ভারতে ফ্লোরোসিসের প্রথম আবিষ্কার হায়দ্রাবাদের নোলোর জেলার নালগোন্ডা গ্রামে, উনিশশো তিরিশের দশকের প্রথম দিকে। আবিষ্কারক আঞ্চলিক চাষিরা। চাষিরা দেখেছিল বলদ লাঙল টানতে টানতে এক সময় আর পারত না, পা মুড়ে ক্ষেতে বসে পড়ত। অন্য বলদ এনে জুড়লে কিছুদিন পর তারও একই দশা হত। ক্রমে অন্যান্য গ্রামেও এই সব ঘটনাবলী ঘটতে থাকল। মানুষের মধ্যেও এই ধরণের রোগের প্রকোপ দেখা গেল। তখন ইংরেজ আমলারা অনুসন্ধান করলেন। ফ্লোরাইড বিষণের ফলে এই সব হতে পারে এমন সন্দেহ প্রথম করেছিলেন ডঃ সি জি পন্ডিত নামে একজন ভারতীয়। ঘটনাক্রমে তিনি বিখ্যাত ড্যানিশ ফ্লোরাইড বিশেষজ্ঞ কাজ রোহোলমের (Kaj Roholm) দুটি গবেষণা নিবন্ধ পড়ে অবহিত ও অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। অনুসন্ধানে জানা গেল নালগোন্ডার জল, মাটি, উদ্ভিদ থেকেই ফ্লোরোসিস। নালগোন্ডার জলে লিটার প্রতি 1 থেকে 3 মি. গ্রা. ফ্লোরাইড পাওয়া গিয়েছিল। সর্ব্বোচ্চ পাওয়া গিয়েছিল 6 মি.গ্রা.। অনুসন্ধানকারী ডঃ রবার্টস আক্রান্ত রোগীদের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি জেনারাল হাসপাতালে ভর্তি করে তাদের এক্স-রে পরীক্ষা করে ফ্লোরোসিস নির্ধারণ করেন। ফ্লোরোসিসের উপর প্রথম ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত 1937 সালে কলকাতার জার্নালে ( যা আমি আমেরিকা ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন থেকে সংগ্রহ করেছি )। জলবাহিত ফ্লোরাইডের মাধ্যমে ফ্লোরোসিসের গবেষণায় ভারতীয়রাই পথিকৃত। এখন ভারতে ফ্লোরাইডের গবেষণা কিছু কিছু হয়। তবে ইউরোপ আমেরিকাতেই বেশি।

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: society for direct initiative for social and health action (disha) 20 / 4, Shil Lane, Kolkata – 7000 015, written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading