সাফ মাথার সমাজ

26 Nov 2015
0 mins read

পুরোনো পুকুর পরিষ্কার করানো হলো না, নূতন তো খোঁড়ার কথাই নেই l পাঁক পুকুরে নয়, পাঁক ভরে গেছে নব্য সমাজের মাথায় l তখন সমাজের মাথা অনেক বেশী সাফ ছিল l তাঁরা পাঁককে সমস্যার মতো নয়, প্রসাদের মতো গ্রহণ করেছিলেন l

পুকুরে জল আসে, জল যায় l এই আসা-যাওয়া পুকুরে প্রভাব ফেলে l বর্ষার খরধারা আগৌরের মাটি ধুয়ে নিয়ে আসে, আগরে মাটি ঘুলে ওঠে l পাড়ের মাটি ধ্বসে, আগরে মাটি জমে l

পুকুরের স্বরূপ নষ্ট হওয়া এই খেলা চলে নিয়মিত l তাই পুকুর যাঁরা তৈরা করেন সেই মানুষজন, সেই সমাজ পুকুরের স্বরূপ রক্ষা করার খেলাটাও খেলে এসেছেন ততটাই নিয়ম পূর্বক l বিগত কয়েকশো বছর এই নিয়ম মাফিক পরিচর্যাই সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ঠিকমতো l

প্রথমবার পুকুরে জল ভরলেই পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেতো l কাজটা কিন্তু তত সহজ ছিল না l তবু সমাজের স্বার্থেই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত হাজার হাজার পুকুর বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল l এই কঠিন কাজটি তাঁরা এত ব্যবস্থা সম্মত করেছিলেন যে সব কিছু সহজভাবে হয়ে যেতো l

আগৌরে পা দিলেই রক্ষণাবেক্ষণের প্রথম কাজ দেখতে পাওয়া যাবে l পুকুরের আগৌর তৈরী আরম্ভ হতেই দেখতে পাওয়া যায় যে তার সূচনা দেওয়ার জন্য পাথরের সুন্দর স্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে l দেশের অনেক এলাকাতেই এটা দেখতে পাওয়া যায় l স্তম্ভ দেখেই আপনি বুঝতে পারবেন এখন আপনি পুকুরের আগৌরে দাঁড়িয়ে l এখান থেকেই জল গিয়ে পুকুর ভরাবে l তাই আগৌরকে রাখতে হবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন l জুতো প্রভৃতি পরে আগৌরে যাওয়া যাবে না l মল, মুত্র ত্যাগ বা থুতু ফেলার তো প্রশ্নই ওঠে না l ‘তুথু ফেলবেন না, জুতো পরে আসবেন না’ – এইরকম কোন বোর্ড অবশ্য লাগানো হতো না, তবে মানুষজন স্তম্ভ দেখেই এই বিষয়গুলির পূর্ণ খেয়াল রাখতেন l

আগৌরের জলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও শুদ্ধতা বজার রাখার কাজ শুরু হতো প্রথম দিন থেকেই l নতুন পুকুর যেদিন ভরে উঠতো সেদিনই মহা সমারোহে তাতে জীব-জন্তু এনে ছাড়া হতো l মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া... l পুকুর বড়ো ও গভীর হলে তাতে কুমীরও l কোন কোন জায়গায় সামর্থ অনুযায়ী জীবন্ত প্রাণীগুলির সঙ্গে সোনা রুপোর জীবজন্তু বিসর্জন দেওয়া হতো l মধ্যপ্রদেশের রায়পুর শহরে সোনার নথ পরিয়ে কচ্ছপ ছাড়া হয় এই মাত্র বছর পঞ্চাশেক আগেও!

প্রথম বছর জলে কিছু বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিতও দেওয়া হতো l ভিন্ন জায়গায় এর প্রকার ভেদ ছিল কিন্তু কাজ একই- জল পরিষ্কার রাখা l মধ্যপ্রদেশে এই গাছগুলি ছিল গদিয়া বা চিলা l অন্য দিকে রাজস্থানে প্রচলিত ছিলো কুমুদিনী, নির্মলী বা চাকসু l চাক্ষুষ থেকেই সম্ভবত চাকসু শব্দ এসেছে l কোন এক সময় পুকুরের জল পরিস্কার রাখতে চাকসু চারার প্রচলন খুব বেশি পাওয়া যায় l বর্তমান জয়পুরের পাশে একটি বড় শহরের নাম চাকসু l সম্ভবত চাকসু চারার প্রতি কৃতজ্ঞতা বশতই এই নামকরণ l

পাড়ে অশ্বত্থ, বট প্রভৃতির গাছ লাগানোর চল অনেক দিনের l পুকুর ও এই গাছেদের মধ্যে যেন এক প্রতিযোগিতা দেখা যায় বয়স নিয়ে l কে বেশি দিন টেকে গাছ না পুকুর? প্রশ্ন সাধারণত উত্তরহীনই থেকে গেছে l উভয়ের এই দীর্ঘ্ সম্পর্ক এমনই অবিচ্ছেদ্য যে যদি একটি বিনষ্ট হয় তাহলে অন্যটিও যেন সেই মৃত সঙ্গীর শোকেই তাকে অনুগমণ করে l গাছ কাটা পড়লে কিছু দিনের মধ্যেই পুকুরও শুকিয়ে ভরে ওঠে, আর পুকুর নষ্ট হলে গাছও বেশী দিন বাঁচতে পারে না l

পুকুরে আম গাছও লাগানো হয় l তবে আম গাছ পাড়ে কম, পাড়ের নীচের জমিতেই বেশী দেখতে পাওয়া যায় l ছত্রিশগড়ের অনেক পুকুরেই মা শীতলা বসবাস করছেন মনে করে পুকুরগুলির পাড়ে নিমের গাছ অবশ্যই লাগানো হতো l গাছ ছাড়া, নেড়া পুকুরের তুলনা করা হয়েছে মূর্তিহীন মন্দিরের সঙ্গে l

বিহার, উত্তরপ্রদেশের অনেক জায়গায় পাড়ের ওপর অরহড়-এর গাছও লাগানো হতো l এই এলাকায় নতুন তৈরী পুকুরের পাড়ে কিছুদিন পর্যন্ত সরষের খোলে ধোঁয়া করা হতো , যাতে ইঁদুরে বা অন্য কিছুতে গর্ত করে পাড়কে দুর্বল না করে দেয় l

এই কাজগুলো এমনই যে পুকুর তৈরীর পর এক বার করলেই হয় বা খুব দরকার পড়লে আরো এক-আধ বার l কিন্তু পুকুরে মাটি জমা হয় প্রতি বছরই l তাই মাটি তোলার কাজটি সুন্দর নিয়মের বাঁধনে বাঁধা হয়েছিলো l কোথাও পাঁক তোলার মতো কঠিন পরিশ্রমের কাজকেও এক অনন্দঘন সামাজিক উত্সবে পরিণত করা হয়েছিলো l আবার কোথাও বা যেমন তা নীরবে পুকুরের তলায় গিয়ে জমা হতো ঠিক সেই ভাবেই নীরবে তুলে এনে পুকুরের পাড়ের ওপর রাখা হতো l

পাঁক ওঠানের সময় ঠিক করা হতো ঋতু দেখে l যে সময় পুকুরের জল সব থেকে কম থাকবে l গোয়া ও পশ্চিমঘাটের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে এই কাজ দেওয়ালীর ঠিক পরেই করা হয় l উত্তরের অনেক বড় এলাকায় এই কাজ করা হয় নববর্ষ অর্থাত চৈত্রের ঠিক আগে এবং ছত্রিশগড়, বাংলা, বিহার, ওড়িষা ও দক্ষিণে করা হয় বর্ষা আসার আগে, ক্ষেত প্রস্তুত করার সময় l

আজ পুকুর থেকে বিচ্ছিন্ন সমাজ আর সমাজ পরিচালনা করে যে প্রশাসন উভয়েই পুকুর পরিষ্কার ও পাঁক তোলার কাজকে সমস্যার চোখে দেখে এবং এই সমস্যা সমাধান না করে নানান বাহানা খুঁজে বেড়ায় l তাদের আধুনিক হিসেবে এই কাজ খরচসাপেক্ষ l অনেক জেলা শাসক নিজের এলাকাতে পুকুর থেকে পাঁক তুলতে না পারায় বড় কারণ হিসেবে এই কথাটাই বলেন যে, ‘এর খরচ এতো বেশী যে তার থেকে নূতন পুকুর খোঁড়ানোও সস্তা’ l পুরোনো পুকুর পরিষ্কার করানো হলো না, নূতন তো খোঁড়ার কথাই নেই l পাঁক পুকুরে নয়, পাঁক ভরে গেছে নব্য সমাজের মাথায় l তখন সমাজের মাথা অনেক বেশী সাফ ছিল l তাঁরা পাঁককে সমস্যার মতো নয়, প্রসাদের মতো গ্রহণ করেছিলেন l প্রসাদ গ্রহণ করার পাত্র ছিলেন কৃষক, কুম্ভকার ও গৃহস্থ l এই প্রসাদ পেতেন যে সব চাষী তাঁরা প্রতি গাড়ি হিসেবে মাটি কাটতেন এবং নিজের জমিতে দিয়ে জমির উর্বরতা বাড়িয়ে নিতেন l এই প্রসাদের বদলে তিনি গাড়ি প্রতি কিছু নগদ বা ফসলের কিছু অংশ গ্রাম কোষে জমা করতেন l এই পয়সাতেই চলতো পুকুর মেরামতির কাজ l আজও ছত্রিশগড়ে লদ্দি (পাঁক) তোলার কাজ করেন কৃষক পরিবারগুলি l এখন প্রতন্ত অঞ্চলে সাবান পৌঁছে যাবার পরও কিছু পরিবার লদ্দি দিয়েই সারে তাদের মাথা ঘসা বা স্নানের কাজ l

বিহারে একে বলা হয় উড়াহি l উড়াহি হলো সমাজসেবা , শ্রমদান l গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে কর্মক্ষম সদস্যরা পুকুরে জমা হন l প্রতিটি পরিবার থেকেই করা হবে এই মাটি তোলার কাজ l কাজের সময় গুড় জল খাওয়ানো হবে l পঞ্চায়েত থেকে জোগাড় করা অর্থের একভাগ খরচা হতো উড়াহি সংযোজনে l

দক্ষিণে ছিল ধর্মদা প্রথা (ধর্মের কাজ বা ভালো কাজের জন্য জমি দান করার প্রথা)l এই প্রথায় গ্রামের ভূমির এক অংশ দান করার প্রচলন ছিলো l এর থেকে যা অর্থ আসতো তা খরচ করা হতো পাঁক তোলার কাজে l এই রকম ভূমিকে কোড়গে বলা হতো l

প্রশাসন ও সমাজ যদি কোন কাজে কোমর বেঁধে নামে তো কোন কাজেই দেরী হয় না l দক্ষিণে পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে উভয়ের এই মিলন ছিল বহুল প্রচলিত l এই কাজের জন্য রাজ-খাজনা থেকে তো অনুদান পাওয়া যেতোই তা ছাড়াও যাতে আলাদা একটা খাজনা সংগ্রহ ব্যবস্থা তৈরী করা যায় সেরকম একটি নিয়মও একই সঙ্গে লাগু ছিল l

প্রতি গ্রামে কিছু ভূমি, ক্ষেত বা ক্ষেতের কিছু অংশ আলাদা করে রেখে দেওযা হত পুকুরের জন্য l এই জমির কর লাগতো না l এই জমিগুলিকে বলা হতো মান্যম্ l মান্যমে্ যা আয় হতো বা যে ফসল পাওয়া যেত তা খরচ করা হতো পুকুরের সঙ্গে বিভিন্ন কাজে l যত প্রকারের কাজ তত প্রকারের মান্যম্ l যেখানে যে কাজ করা দরকার সেখানেই তার ব্যবস্থা হতো l সেখানেই তার খরচ জোগাড় করা হতো l

শ্রমিকদের পারিশ্রমিক আসতো অলৌতি মান্যম্ থেকে l সারা বছর পুকুর দেখাশোনা করতেন যাঁরা তাদের জন্য ছিল অনৌকরণ মান্যম্ l পুকুরপাড়ে গরু, ছাগল ভেডা়-র যাতায়াত লক্ষ্য রাখতেন যে সমস্ত পরিবার তাঁদের জীবিকা নির্ভর করতো এই মান্যম্ থেকে l পাড়ের মতো আগৌরেও পশুদের আটকে রাখার জন্য লোক লাগতো সারা বছর l এঁদের ব্যবস্থা হতো বঁন্দেলা মান্যম্ থেকে l পুকুরের সাথ যুক্ত ক্ষেতগুলিতে ফসল বোনার থেকে কাটা পর্যন্ত পশুদের আটকানোর পারিশ্রমিক মেটাতো- বঁন্দেলা মান্যম্ l এই কাজ যাঁরা করতেন তাঁদের বলা হতো পটটি l একটা নির্দষ্ট সময় পর্যন্ত এই কাজ চলেছিল l

সেচের সময় নহরের ডাট খোলা, ক্ষেতে সময়মতো জল পৌঁছানো এগুলি আলাদা দায়িত্ব l এই পরিষেবা দিতো নীরমুনক্ক মান্যম্ l কোথাও কৃষক জল নষ্ট করছে কিনা, এটা যাঁরা দেখাশোনা করতেন তাঁদের বেতন দেওয়া হতো কুলমকওল নাম্যম্ থেকে l পুকুরে কত জল আছে, কোন কোন ক্ষেতে কি কি লাগালো আছে, কার কত জল প্রয়োজন, এ সমস্ত প্রশ্নের সমাধান করতো নীরঘন্টি বা নীরকুটটি l দক্ষিলে এই পদ শুধুমাত্র হরিজন পরিবারগুলিকে দেওয়া হতো l পুকুরের জলস্তর দেখে ক্ষেতগুলিতে তা নায্যভাবে ভাগ করে দেওয়ার সূক্ষ্ম হিসেবের দক্ষতা দেখতে পাওয়া যায় এই নীরঘন্টিদের বংশধারায়l আজকের কিছু সমাজ বিজ্ঞানী বললেন, ‘ হরিজনদের এ পদ দেওয়া হতো স্বার্থের জন্যই’ l এই পরিবারগুলির নিজেদের জমি ছিল না l তাই যাঁদের জমি ছিল তাঁদের ক্ষেতে জলের যে কোন প্রকার বিবাদে এঁরা নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে পারতেন l কিন্তু যদি ভূমিহীন হওয়াই একমাত্র যোগ্যতার আধার হয়, তাহলে ভূমিহীন ব্রহ্মণতো সব সময়ই সুলভ l যাইহোক, আমরা আর একবার মান্যম্-এ ফিরি l

অনেক পুকুরের জলই সেচ ছাড়াও খাবার কাজেও ব্যবহৃত হতো l পুকুর থেকে যাঁরা ঘর পর্যন্ত জল পৌঁছাতেন তাদের বলা হতো কাহার l কাহারদের বেতন দেওয়া হতো উরনি মান্যম্ থেকে l

পুকুরের সাধারণ ভাঙ্গা-চোরা ঠিক-ঠাক করা হতো উপ্পার ও ওয়াদি মান্যম্ থেকে l পুকুর ও পুকুরের নহরগুলির দেখা-শোনাতে খরচ হতো ওয়াক্কল মান্যমে্র টাকা l পাড়ে ও নহরের ওপর গাছ লাগানো, সারাবছর তাদের লালন পালন পরিচর্যা, কাটছাঁট- এই সমস্ত দায়িত্ব পালন করতো মানল মান্যম্ l খুলগা মান্যম্ ও পাটুল মান্যম্ সামলাতো মেরামতি ছাড়াও নতুন পুকুর খোঁড়ার খরচও l এক পুকুরের সঙ্গে যুক্ত এতো প্রকার কাজ, এতো পরিষেবা সারা বছর ঠিক মতো চলছে কি না এটা দেখাও তো একটা কাজ! কোন কাজে কতো লোক লাগাতে হবে, কোথায় কি মেরামত করতে হবে এ সমস্ত ব্যবস্থাই করা হতো কটর মান্যম্ থেকে- একে কুলমবেটটু বা কম্মোইবেটটু-ও বলা হতো l

দক্ষিণের এই সংক্ষিপ্ত ও সাধারণ বর্ণনা, পুকুর ও তার সঙ্গে যুক্ত সমগ্র ব্যবস্থার গভীরতাকে আমাদের সামনে সর্বৈবভাবে তুলে ধরতে পারে না l এ ব্যবস্থা তো অথৈ l এরকমই ব্যবস্থা বা এর সঙ্গে মিল রয়েছে এমন ব্যবস্থা উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই সম্ভবত ছিলো l পরাধীনতার সময় তা কিছুটা নষ্ট হয়েছে l এবং এরপর বিচিত্র স্বধীন এই সমাজে সমস্ত কিছু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল l

তবে গৈঙ্গজী কল্লার মতো মানুষ বারে বারেই এসেছেন এই ছিন্ন-ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে শুধরে তোলার জন্য l

নামতো ছিল গঙ্গাজী না জানি কিভাবে গৈঙ্গজী হয়ে গেলেন l স্নেহ, ভালোবাসা ও আবদারের কারণেই সম্ভবত তাঁর নাম পাল্টে যায় বা বিকৃত হয়ে যায় l গৈঙ্গজীর শহরকে কয়েকশো বছর ধরে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল বিশাল আটটা পুকুর l রক্ষণাবেক্ষণের যথাযতো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার পর পুকুরগুলি ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হতে থাকে, ধ্বসে পড়তে থাকে, নষ্ট হয়ে যেতে থাকে l যদিও এগুলি তৈরী হয়েছিলো আলাদা আলাদা প্রজন্মেই, তবুও আটটির মধ্যে ছয়টি ছিল একই শৃঙ্খলে বাঁধা l এগুলির রক্ষণাবেক্ষনও সেই প্রজন্মের মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেই করতেন বোধ হয় l তারপর দেখাশোনার সেই সুবন্দোবস্ত, শৃঙ্খলা কোন এক সময় ভেঙ্গে পড়ে l

এই শৃভ্খল ভেঙ্গে পড়ার শব্দ গৈঙ্গজীর কানে কখন পৌঁছায় জানি না, তবে আজ যে সব বুড়ো-বুড়ি ফলৌদি শহরে রয়েছেন তাঁরা গৈঙ্গজীর একটাই ছবি মনে রেখেছেন-ছেঁড়া চপ্পল পায় গৈঙ্গজী সকাল থেকে সন্ধ্যে ঘুরছেন এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে l স্নানের ঘাট, জল নেওয়ার ঘাট কেউ নোংরা করছে দেখলেই স্নেহভরা বকুনি দিতেন l

কখনো তিনি পাড়ের দেখাশোনা করছেন তো কখনো নেষ্টার l কোথায় কোন পুকুরে কি ধরণের মেরামতি দরকার তার তালিকা তৈরী করে চলেছেন মনে মনে l পুকুরগুলিতে খেলতে আসতো যে সমস্ত বাচ্চারা চাদের বিভিন্ন ধরনের খেলা শেখাতেন, নিজেও তাদের সঙ্গে খেলতেন l শহরের তিন দিক ঘিরে থাক পুকুরগুলিতে একপাক দিতে সময় লগতো প্রায় তিন ঘন্টা l গৈঙ্গজীকে কখনো প্রথম পুকুরে দেখা যেতো তো কখনো শেষ পুকুরে l সকালে এখানে পাওয়া যেতো তো বিকেলে ওখানে, আর দুপুরে বেলা না জানি কোথায়!গৈঙ্গজী নিজেই নিজের কাঁধে পুকুরগুলি রক্ষণাবেক্ষণের ভার তুলে নিয়েছিলেন l

বছরের শেষে একটা সময় দেখা যেতো গৈঙ্গজী পুকুরের বদলে শহরের গলিতে গলিতে ঘুরছেন l প্রতিটি ঘরের দরজায় পৌঁছাতেই তিনি একটি টাকা পেয়ে যেতেন না চাইতেই l সকলেই জানতেন গঙ্গৈজীর এক টাকারই প্রয়োজন, তার বেশীও নয় কমও নয় l টাকা তোলা হয়ে গেলে সারা শহরের বাচ্চাদের জোটাতেন l বাচ্চাদের সঙ্গেই জমা হতো – ঝুড়ি হাতঝোড়া টামনা, কোদাল l একের পর এক পুকুর পরিষ্কার হতো l প্রতিটি পুকুরের নেষ্টা পরিষ্কার হতো, আগরের মাটি তুলে দেওয়া হতো পাড়ে l প্রতি ঝড়া মাটির জন্য একজন বাচ্চা পেতো পুরস্কার দু-আনা পয়সা l

গৈঙ্গজী কল্লা কখন থেকে এই কাজ করছিলেন, তা এখন আর কারো খেয়াল নেই l শুধু এই টুকুই জানাযায় ১৯৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই কাজ l এরপর গৈঙ্গজী চলে গেলেন l

কোন মৃত্যুকে শহর এরকম ভাবে মনে রাখেনি l পুরো শহরটাই জোগ দিয়েছিল তাঁর অন্তিম যাত্রায় l একটি পুকুরে নীচে ঘাট তৈরী করে তাঁর অন্তিম সত্কার করা হয় এবং সেখানেই সমাধী তৈরী করা হয় l যিনি পুকুর তৈরী করতেন সমাজ তাঁকে সন্ত্-এর সম্মান দিত l গৈঙ্গজী নূতন পুকুরতো তৈরী করেন নি, আগের পুকুরগুলিই রক্ষণাবেক্ষণ করে গেছেন, তবুও সমাজ তাঁকে সন্ত্-এর সম্মানই দিয়েছে l

ফলৌদিতে এই খেলা সন্ত্ খেলেছেন, তো জয়সলমেরে রাজা নিজেই খেলেছেন এই খেলা l সারা শহর জানত, তবুও ঢেড়রা পড়তো – ‘রাজার পক্ষ থেকে, এ বছরের শেষ দিন, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন শহরের সব থেকে বড়ো পুকুর ঘড়সীসোরে লাহাস খেলার আমন্ত্রণ রইল’ l সেদিন রাজা, রাজপরিবার, দরবার, সেনা ও প্রজা সকলেই ঘড়সীসোরে জমা হোতেন কোদাল, টামনা, ঝড়া নিয়ে l রাজা মাটি তুলে প্রথম ঝড়া ধরে পাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতেন, বাজ-বাজনা সহ লহাস শুরু হতো l দরবারের তরফ থেকে এদিন সমস্ত প্রজার পান-ভোজনের ব্যবস্থা থাকতো l রাজা প্রজা সকলেরই হাত মাটিতে একাকার l এদিন রাজার কাঁধের সঙ্গে যে কারো কাঁধের ধাক্কা লাগতে পারতো l যিনি দরবারেও সুলভ নন, আজ তিনি পুকুরের দরজায় মাটি বইছেন l রাজার অঙ্গরক্ষীরাও যোগ দিতেন এই কাজে l এই রকমেই এক লাহসে জয়সলমেরে রাজা তেজসিং-এর ওপর আক্রমণ হয় l তিনি পুকুর পাড়েই মারা যান, লহাস খেলা কিন্তু বন্দ হয়নি, চলতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে l মধ্যপ্রদেশের ভীল সমাজেও লহাস খেলা হতো l গুজরাটেও চালু আছে l গুজরাতে তো এই ঐতিহ্য পুকুর থেকে প্রসারিত হয়ে সামাজিক যে কোন কাজে যুক্ত হয়েছিলো, যাতে সকলের সাহায্য প্রয়োজন l ‘সকলের জন্য সকলের সাহায্য’-এই বিশ্বাস বা প্রথা থেকেই পুকুর তৈরী হতো l একই দৃষ্টিভঙ্গীতে তা রক্ষণাবেক্ষণও l পাঁক তোলা, ফেলা- সমাজের এই খেলা লহাস উল্লাসের সঙ্গে চলতো l

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishra in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bundelkhand, Tanks in Rajasthan, Simple living and High Thinking, Honest society, Role Models for Water Conservation and management, Experts in tank making techniques

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading