সনাতন ধর্ম থেকেও পুরনো ধর্ম হল - নদী ধর্ম


যদি আমাদের শহর ইন্দ্রের সঙ্গে মিত্রতা করে তার জল আটকাতে না পারে, না শেখে তাহলে সেই জল বন্যার মতই আমাদের শহর নষ্ট করবেই। আর এই জল যদি বয়ে চলে যায় তাহলে গরমে খরাও হবে। গঙ্গাকে, হিমালয়কে কেউ চুপিচুপি ষড়যন্ত্র করে মারছে না। এরা তো সব আমাদেরই লোক। বিকাশ, জি.ডি.পি, নদী সংযোজন, বড় বাঁধ সবকিছু চলছে। হয়তো এটা এক পক্ষ করছে, নয়তো অন্য পক্ষ। উন্নতির এই ঝান্ডার তলায়, পতাকার তলায় পক্ষ – বিপক্ষের ভেদ মুছে যায়। এক্কেবারে আলাদা আলাদা কথা। প্রকৃতির ক্যালেন্ডার আর আমাদের ঘর বা অফিসের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার । কালনির্ণয় । পাঁজি।

আমাদের সম্ববত্সরের ক্যালেন্ডারের পাতা বছরে বারো (12) বার পাল্টে যায়। প্রকৃতির ক্যালেন্ডার কিন্তু শুধু কয়েক হাজার বছরেই নয়, কয়েক লক্ষ বা কয়েক কোটি বছরে পর একবার পাতা ওল্টে।

আজ যদি আমরা গঙ্গা নদীর কথা আলোচনা করতে চাই তো তাহলে আমাদের প্রকৃতির ভূগোলের এই ক্যালেন্ডারের কথা ভুললে চলবে না। তবে কোটি কোটি বছরের এই ক্যালেন্ডারকে স্মরণ করার তথা মনে রাখার অর্থ এই নয় যে আমরা আমাদের আজের, বর্তমানের কর্তব্য ভুলে যাব। বর্তমানের কর্তব্য থাকবে সবার প্রথমে।

গঙ্গা নোংরা (ময়লা) হয়ে গেছে। গঙ্গাকে পরিষ্কার করতে হবে। আবর্জনা মুক্ত করতে হবে। অতীতেও পরিষ্কার করার অনেক পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। কোটি কোটি টাকা জলের মতই গঙ্গার জলে বয়ে গেছে, কিন্তু কোন সুরাহা হয় নি, সুফল পাওয়া যায় নি। তাই শুধুমাত্র আবেগে ভেসে আবার আমরা এমন কোন কাজ করবো না যে, কোটি কোটি টাকার পরিকল্পনা তৈরী হবে অথচ গঙ্গাও যেমনের তেমনই নোংরা বা অপরিস্কার থেকে যাবে।

পুত্র – কন্যারা জিদ্দী হতে পারে। কু-পুত্র, কু-কন্যাও হতে পারে। তবে আমাদের দেশের মাটিতে কু-মাতা কখনও হয় না – এটাই আমারা মনে করি, এটাই আমরা যুগ যুগ ধরে মেনে এসেছি। তাহলে একটু ভাবুন তো, যে গঙ্গা মায়ের ছেলে - মেয়েরা তাঁকে স্বচ্ছ করতে, পরিষ্কার করতে প্রায় ত্রিশ – চল্লিশ (30 – 40) বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছে, তো তাহলে তিনি কেন পরিস্কার হচ্ছেন না ? তাহলে কী এতই জেদি আমাদের এই মা ?

সাধু সন্ত, সমাজ, প্রতিটি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, বৈজ্ঞানিকগণ, গঙ্গা নিয়ন্ত্রক পর্ষদ, এমনকি বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো এত বড় বড় মহাজনও গঙ্গাকে পরিশ্রম, অর্থ ও মন দিয়ে পরিষ্কার করতে চায়। আর মা, ইনি এমনই মা যে তিনি পরিষ্কারই হতে চান না।

বোধহয় একটু সময় নিয়ে খুব ধৈর্য্যের সঙ্গে আমাদের এই গেরোটিকে, সমস্যাটিকে বুঝতে হবে।

ভালো হোক বা খারাপ প্রতিটি যুগেরই একটা ঝান্ডা, একটা পতাকা থাকে। একে বিচার ধারাও বলা যেতে পারে। এই পতাকার রঙ এতটাই গাঢ় হয় ও তাতে এমন জাদু থাকে যে সে অন্যান্য সব রঙের ঝান্ডার ওপর ছড়িয়ে পড়ে। তিরঙ্গা, লাল, গেরুয়া, সবুজ সবাই তাকে নমস্কার করে, তারই গুনগান গায়। সেই যুগের, সেই সময়ের যেসব লোক, যাঁরা সবেতেই নিজেদের মতামত জাহির করেন বা যাঁরা নীরবেই থাকেন তারাও প্রায় সকলেই দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সেই বিচারধারাকে নিজের করে নেয়।

কেও কেও বুঝে, কেও বা আবার না বুঝেও। এই যুগকে আবার বিগত ষাট সত্তর (60 – 70) বছরের উন্নতির ধারাকে বিকাশের সময় বলা হয়ে থাকে। যা কিছু দেখে নিজের এই দেশটিকে তাদের পিছিয়ে পড়া মনে হয়ে ছিল। পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে তারা তার উন্নতি করে দেখাতে চায়। বিকাশ পুরুষ -এর মত বিশ্লেষণ সব সম্প্রদায়েরই ভাল লেগেছে।

অন্য কথা ছেড়ে আবার গঙ্গায় ফেরা যাক। পৌরানিক প্রবচন বা গল্পকথা ও ভৌগলিক তথ্য এসবের যোগফল এ কথাই বলে যে, গঙ্গা অপৌরুষেয়। কোন এক পুরুষে গঙ্গা তৈরী হয় নি। বহু বহু সংযোগের পর গঙ্গা অজীর্ণ হয়েছেন। জন্ম নয়। ভূগোল ও ভূতত্ত্ব এ কথাই বলছে যে গঙ্গার জন্ম হিমালয়ের জন্মের সঙ্গে জুড়ে আছে। প্রায় দু - কোটি ত্রিশ লক্ষ (2,30,00000) বছরের পুরোনো ভূ - প্রাকৃতিক উথাল-পাতাল থেকে। এই সময় একবার ফিরে আমাদের দেওয়ালে টাঙানো ক্যলেন্ডারের দিকে তাকানো যাক। এতে এখানে এখন মাত্র 2017 বছরই হয়েছে।

চলুন এই বিশাল সময়ের যে ব্যবধান তা এখন আমরা ভুলে যাই। এইটুকুই দেখা যাক যে প্রকৃতি গঙ্গাকে সদা প্রবাহমান রাখার জন্য তার প্রতি কি কি কৃপা বর্ষণ করেছে। প্রকৃতি শুধু মাত্র বর্ষার ভরসায় গঙ্গাকে ছাড়ে নি। বার্ষা তো হয় মাত্র চার মাস। বাকি আট মাস গঙ্গার জল কিভাবে বইবে ! কি ভাবে ? তারজন্য প্রকৃতি তার উদারতার আরও এক রূপ গঙ্গাকে দিয়েছে। গঙ্গার সংযোগ ঘটেছে হিমগঙ্গার সঙ্গে, জলকে হিমের সঙ্গে মেশানো হয়েছে।

প্রকৃতিকভাবেই গাঙ্গত্রী ও গোমুখ হিমালয় এত অধিক উপরে, এত উঁচু শিখরে রেখেছে যে সেখানের বরফ গলে শেষ হবার নয়, কখনও শেষ হয় না। বর্ষা যখন শেষ হয়ে যায় তখন হিমালয়ের বরফ গলে গলে গঙ্গার ধারা অবিরল রাখে।

আমাদের সমাজ গঙ্গাকে মায়ের স্বীকৃতি দিয়েছে আর শুদ্ধ সংস্কৃত থেকে শুরু করে ভোজপুরিতে পর্যন্ত অনেক শ্লোক, মন্ত্র, গান, সরস, সরল সাহিত্য রচিত হয়েছে গঙ্গাকে নিয়ে। সমাজ তার পূর্ণ ধর্ম নিবেদন করেছে গঙ্গার রক্ষায়। আর এই ধর্ম একথাও বলে যে আমাদের ধর্ম, সনাতন ধর্ম থেকেও পুরানো আরও এক ধর্ম রয়েছে। তা হল নদী ধর্ম। নদী তার উত্পত্তি থেকে মোহনা পর্যন্ত এক ধর্মের, এক রাস্তার, এক উপত্যকার, এক প্রবাহের পালন করে। তাই আমরা নদী ধর্মকে আলাদাভাবে চিনতে পারি না, কেননা এতদিন পর্যন্ত আমাদের পরম্পরা তো সেই নদী ধর্মের সাথেই নিজের ধর্মকে জুড়ে রেখেছিল।

তারপর না জানি কখন বিকাশ নামের নতুন ধর্মের ঝান্ডা সবার ওপরে উড়তে লাগল। এই প্রসঙ্গটি কিছুটা অপ্রিয় লাগবে, তবুও এখানে বলতেই হবে - এই ঝান্ডার নীচে প্রতিটি নদীর ওপর বড় বড় বাঁধ তৈরী হতে লাগল। নদী ধর্মের সমস্ত অনুশাসন ভেঙ্গে এক নদী ঘাটের জল অন্য নদী ঘাটে নিয়ে যাবার জন্য পরিকল্পনা তৈরীতে একেবারে ভিন্ন পন্থী রাজনৈতিক দল গুলির মধ্যেও এক অদ্ভুত সহমত দেখা গেল।

বহু রাজ্যে বয়ে চলা, ভাগরথী, গঙ্গা, নর্মদা এই ঝন্ডার নীচে আসাতেই হঠাত্ই মা -এর বদলে কোন না কোন রাজ্যের জীবন রেখা হয়ে ওঠে আর তারপর সেই রাজ্যে এই নদীর ওপর তৈরী হতে থাকা বাঁধগুলি নিয়ে সমাজে, পরিবেশে এমন বাতাবরণ তৈরী হয় যে কোন সংবাদ, সুস্থ আলোচনার অবকাশই থাকে না।

দুটো রাজ্যে একই রাজনৈতিক দলের সরকার থাকলেও, বাঁধ, জল বণ্টন নিয়ে এমন ঝগড়ার সৃষ্টি করে যে মহাভারতও পিছনে পড়ে যায়। সব বড় বড় রথি, সরকারে আসা সমস্ত দল, সব নেতৃত্ব কোথায় যেন বাঁধা পড়ে যায়। প্রত্যেকের কাছেই নদী সংযোজন একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ বলে মনে হয়।

তারা এটা ভুলে যায় যে প্রয়োজন পড়লে তবেই প্রকৃতি নদী জোড়ে। এর জন্য প্রকৃতি কয়েক হাজার - লক্ষ্য বছর তপস্যা করে, তবেই গিয়ে গঙ্গা – যমুনা এলাহাবাদে মিলিত হয়। কৃতজ্ঞ সমাজ সেই সংযোগ স্থলটিকে তীর্থস্থান মনে করে। মোহনাতে প্রাকৃতিক ভাবেই নদী না জানি কত ভাগে ভেঙ্গে ভাগ হয়ে যায়। না ভাঙ্গলে সাগরের সঙ্গে নদীর মিলন, সঙ্গম হতে পারে না। তাহলে জায়গায় জায়গায় নদীতে বাঁধ দিয়ে নহর করে নদী থেকে পরিষ্কার জল বার করে নেওয়া হোক। সেচ, বিদ্যুত তৈরী ও শিল্প চালানোর জন্য। বিকাশের জন্য। এবার যেটুকু জল বাঁচল তা বড় বড় পাইপ লাইনে করে দ্রুত ফুলে – ফেঁপে ওঠা শহরে, রাজধানীতে পৌঁছে দেওয়া হোক।

এটাও ভুলে গেলে চলবে না কি এই ত্রিশ চল্লিশ (30-40) বছর আগে পর্যন্ত এই সব শহরে অগুনতি ছোট - বড় পুকুর ছিল। এই পুকুরগুলি চার মাসের বর্ষাকে নিজের বুকে ধারণ করত আর শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা করত ও জলের স্তর ওপরে উঠিয়ে আনত। এই ওপরে উঠে আসা জলস্তর বাকি আট মাস শরের তৃষ্ণা মেটাতো। এখন এইসব জায়গায় জমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে।

প্রমোটর - নেতা - আধিকারী মিলে মিশে সারা দেশের সব পুকুর শেষ করছে। ৫০ বছরে মহারাষ্ট্রে এমন খরা হয়নি, সব থেকে ভয়ঙ্কর খরা। আর এই কয়েক দিন আগে পর্যন্ত মহারাষ্ট্র ছিল খরার কবলে। আর তার ঠিক কয়েক দিনই পরেই মহারাষ্ট্রেরই – পুনে, মুম্বইয়ে এক দিনের বৃষ্টিতেই বন্যা শুরু হয়ে গেল। ইন্দ্রের সুন্দর একটি পুরান নাম পুরন্দর – পুর, জেলা, শহরকে ভেঙ্গে ফেলে যে, অর্থাত যদি আমাদের শহর ইন্দ্রের সঙ্গে মিত্রতা করে তার জল আটকাতে না পারে, না শেখে তাহলে সেই জল বন্যার মতই আমাদের শহর নষ্ট করবেই। আর এই জল যদি বয়ে চলে যায় তাহলে গরমে খরাও হবে।

ফিরে গঙ্গায় ফেরা যাক। কিছু দিন ধরে টিভিতে প্রচারিত হচ্ছিল উত্তরাখন্ডের বন্যা, গঙ্গার বন্যার কথা স্মরণ করা যাক। নদীর ধর্ম ভুলে গিয়ে আমরা নিজেদের অহংকার প্রদর্শনের জন্য তৈরী করেছি বিভিন্ন বিকটাকৃতির মন্দির, ধর্মশালা তৈরী করেছি নদী ধর্মের কথা চিন্তা না করেই। হালে যে বন্যা হল তাতে শুধু মূর্তিগুলিই নয়, গঙ্গা সমস্ত কিছুই নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে গেছে।

তাহলে বিকাশের নামে নদীর সব জল বার করতে থাকুন, জমির দামের কারণে পুকুর বুজিয়ে ফেলুন, আর তারপর সারা শহরের জঞ্জাল, বিষ নদীতে ফেলা হোক। এবার ভাবতে বসুন এবার কোনো নতুন প্রকল্প তৈরী করে আমরা নদীকে পরিষ্কার করে নেবো। নদীই তো বেঁচে নেই। নোংরা নালায় পরিনত হয়েছে। নোংরা নালা পরিষ্কার হচ্ছে। ভরূচ গিয়ে দেখুন রসায়ন শিল্পের উন্নতির নামে নর্মদাকে কিভাবে বর্বাদ করা হয়েছে। নদী এইভাবে পরিষ্কার হবে না। এইভাবে যতবার আমরা পরিস্কার করতে যাব প্রতিবারই আমরা নিরাশ হব।

তাহলে কি কোন আশাই নেই। কোন রাস্তা নেই। না, এরকম নয়। আশা আছে। তবে তখনই, যখন আমরা ফিরে আবার নদী ধর্মকে ঠিকঠাখ বুঝবো। আমাদের বর্তমান উন্নতির ধারাকে ঠিক বিচার করতে পারবো। কোনরকম কূটনীতি ছাড়া। গঙ্গাকে, হিমালয়কে কেউ চুপিচুপি ষড়যন্ত্র করে মারছে না। এরা তো সব আমাদেরই লোক। বিকাশ, জি.ডি.পি, নদী সংযোজন, বড় বাঁধ সবকিছু চলছে।

হয়তো এটা এক পক্ষ করছে, নয়তো অন্য পক্ষ। উন্নতির এই ঝান্ডার তলায়, পতাকার তলায় পক্ষ – বিপক্ষের ভেদ মুছে যায়। মারাঠীতে খুব সুন্দর একটি প্রবাদ রয়েছে – রাবণ তোঁড়ী রামায়ণ। রাবণ নিজেই ব্যাখ্যা করছে রামায়নের কাহিনী। আমরা এমন রাবন যেন না হই।

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading