সঞ্চরণ ও ভূজীবরাসায়নিক চক্র (Movement and Biogeochemical Cycling)


মাটিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব নির্ভর করে যে –শিলাস্তর ক্ষয় করে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে মূলত তার ওপর। তাতে বায়ু ও জলবাহিত বা মনুষ্য প্রবিষ্ট আর্সেনিকের আগমন ঘটলে মাটির, বিশেষ করে উপরিমৃত্তিকার আর্সেনিক মাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। মাটির আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদির প্রাচুর্য, মাটির অম্লতা – ক্ষারকীয়তা, জারণধর্মিতা, জীব - জীবাণুর প্রকৃতি ও ঘনত্ব মৃত্তিকায় আর্সেনিকের পরিমাণ নিরূপণ করে। বালি মাটিতে আর্সেনিকের আবন্ধন কম, কর্দমাক্ত বা দোঁয়াশ মাটিতে বেশি। মাটির অম্লতা বেশি হলে (অর্থাত pH কম হলে), আর্সেনিক আলগা হয়ে সঞ্চরণশীল হয় বেশি। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পৃথিবীতে আর্সেনিক ছিল, থাকবেও চিরকাল। ভূ-অভ্যন্তর থেকে প্রচুর আর্সেনিক প্রতি বত্সর ভূপৃষ্ঠে সংযোজিত হয়। আবার স্থলভাগের বেশ কিছু আর্সেনিক জলচক্রের মাধ্যমে নদী ও পলিকণা পরিবাহিত হয়ে সমুদ্রগর্ভে সমাধিস্থ হয়। ফলে ভূপৃষ্ঠ অনেকটাই আর্সেনিক ভার মুক্ত হয়। সমুদ্র বিশাল এবং তাতে ফসফেট কম থাকায় সেখানে আর্সেনিক - ফসফেট অনুপাত অধিক; তাই মাছ ও নানা সামুদ্রিক প্রাণীদেহ আর্সেনিকের সঞ্চয়ণ অপেক্ষাকৃত বেশি। আর্সেনিকের সঙ্গে ফসফরাসের রাসায়নিক সাদৃশ্য বেশি। আর্সেনিকের ভূজীব রাসায়নিক চক্র অপূর্ণাঙ্গ (imperfect), অনেকটা আর্সাইন গ্যাস জীবাণু ও ছত্রাক দ্বারা বিমুক্ত হয়ে বাতাসে আসে। সেখানে তাদের স্থিতিকাল 9 দিন মতো, যা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও আবহওয়ার অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। সেখানে জারিত হয়ে, ধূলিকণা বাহিত হয়ে, বা এমনি অধঃক্ষিপ্ত হয়ে আর্সেনিক চক্রে অংশগ্রহণ করে। খনিজ উত্তোলন, ধাতু নিষ্কাশন, কয়লা দহন, নানারকম শিল্প প্রযুক্তিতে আর্সেনিকের ব্যবহার ও কোনও কোনও অঞ্চলের ভূগর্ভে জল উত্তোলনের ফলে পরিবেশে আর্সেনিক বাড়ছে। আর্সেনিক কার্বন বন্ধন সমন্বিত জৈব আর্সেনিক শুধু জীবদেহেই সংশ্লোষিত হয়, বাইরের বৃহত্তর অজৈব পরিবেশে হয় না।

বায়ুমন্ডলে আর্সেনিকের উপস্থিতি মাত্রা সাধারণত

দূর গ্রামাঞ্চলে

0.02 ng / m3

শহরাঞ্চলে

3 - 200 ng / m3 কখনো কোথায়ও 1000 ng / m2 এর  বেশীও হয়

জলীয় পরিবেশে

10µg / L এর কম, (কোন কোন শিল্পাঞ্চলে বেশী)

সাগর মহাসাগরে  

1 – 2 µg / L

মৃত্তিকায়

1 – 40 mg / kg

 

আর্সেনিক চক্রে ধাতব অকসাইড সমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা


আর্সেনিক চক্রে কতগুলি ধাতুর ( যেমন আয়রন, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম) প্রভৃতির অকসাইড ও হাইড্রকসাইডের ভূমিকা সাতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সুদৃঢ় রাসায়নিক এবং / অথবা পরিশোষণ আবন্ধনের মধ্য দিয়ে স্থানে স্থানে সময়ে সময়ে এরা আর্সেনিকের সঞ্চরণ নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষ করে, ভূগর্ভ অ্যাকুইফারে বা ভূপৃষ্ঠের জলপ্রবাহে।

মাটিতে আর্সেনিক


মাটিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব নির্ভর করে যে – শিলাস্তর ক্ষয় করে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে মূলত তার ওপর। তাতে বায়ু ও জলবাহিত বা মনুষ্য প্রবিষ্ট আর্সেনিকের আগমন ঘটলে মাটির, বিশেষ করে উপরিমৃত্তিকার আর্সেনিক মাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। মাটির আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদির প্রাচুর্য, মাটির অম্লতা – ক্ষারকীয়তা, জারণধর্মিতা, জীব - জীবাণুর প্রকৃতি ও ঘনত্ব মৃত্তিকায় আর্সেনিকের পরিমাণ নিরূপণ করে। বালি মাটিতে আর্সেনিকের আবন্ধন কম, কর্দমাক্ত বা দোঁয়াশ মাটিতে বেশি। মাটির অম্লতা বেশি হলে (অর্থাত pH কম হলে), আর্সেনিক আলগা হয়ে সঞ্চরণশীল হয় বেশি।

pH এর মাত্রা 7 – এর বেশি হলে AsO43- , HAsO42- –এর উত্পত্তি সমাধিক, আর Ph 7 –এর কম হলে H2AsO4 বেশি হয়। মাটিতে ফসফেট বেশি এলে ( যেমন, কৃষিতে প্রদত্ত অজৈব সার থেকে) আর্সেনিক কম আবদ্ধ হয়, ফসফেটের সঙ্গে আবদ্ধনের রাসায়নিক স্থানের স্থানের প্রতিযোগিতায় আর্সেনিকের বদলে ফসফেট দৃঢ়তরভাবে আবদ্ধ হয়, মাটির তাপমাত্রা বাড়লে পরিশোষণ কমে। জলপ্রবাহ বা বন্যা বেশি হলে মাটির আর্সেনিক - ভার কমে। আগেই বলা হয়েছে যে, মাটির উপর বিজারক জৈব পদার্থ ও জল থাকলে ছত্রাক ও জীবাণুদের প্রাণ – রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃত্তিকার আর্সেনিক উদ্বায়ী আর্সাইন হয়ে মাটির আর্সেনিক ভার অনেকটাই কমিয়ে দেয়। মাটিতে আর্সেনিকের জারণ-বিজারণ, পরিশোষণ (adsorption), পরিশোষণ মুক্তি (desorption), অধঃক্ষেপণ, উদ্বায়ীভবন, জৈবীকরণ, অজৈবীকরণ সবই হয়। মাটিতে আর্সেনিকের স্থিতির অর্ধ জীবনকাল প্রায় সাড়ে ছয় বছর।

প্রজাতিসমূহের পরিবেশীয় রূপান্তর


শিলার ক্ষয়ীভবন ও আবহবিকার থেকে মৃত্তিকার উত্পত্তি। তার ওপর রাসায়নিক ও জৈবিক আবহবিকারের ফলে শিলার ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৃত্তিকার ক্রমবিকাশ। মাটি একটি জীবন্ত পদার্থ নানাবিধ অ্যালুমিনো সিলিকেট আকরিকসমূহ মাত্রই নয়। তার ভেতর আছে জল, জৈব পদার্থ আর বিপুল সংখ্যক জীবাণু, ছত্রাক ও কীটাদি। এসবের সমবেত জীবরাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়ায় আর্সেনিকের রাসায়নিক প্রজাতিসমূহের নিয়ত ঘটে চলে রূপান্তর। As(V) এর বিজারণে As(III), আবার As(III) কোথাও জারিত হয়ে As(V) –এ পরিণত হয়। জৈব আর্সেনিক অজৈব আর্সেনিকে রূপান্তরিত হয়।

অধিক জারণধর্মী বাতায়িত পরিবেশে As(V) -এর প্রাধান্য, বিপরীত ক্রমে জারণ ধর্মীতা কমালে As(III) - এর প্রাধান্য বেশি হয়। এইসব রাসায়নিক ক্রিয়া - বিক্রিয়ায় মৃত্তিকার জীবাণুসমূহের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। ক্যান্ডাইডা হিউমিকুলা (Candida humicola) ছত্রাক মিথাইল ফিনাইল আর্সিনিক অ্যাসিড ও ডাইমিথাইল ফিনাইল আর্সিন অকসাইড (methyl phenyl arsenic acid and dimethyl phenyl arsine oxide) বিজারিত করে ডাইমিথাইল ফিনাইল আর্সাইনে পরিণত করে। সিউডোমোনাস ও অ্যালকালিজিনস (Pseudomonas and Alcaligenes) দ্রবীভূত আর্সেনেট [ As(V) ] -কে বিজারিত করে আর্সাইনে (AsH3) পরিণত করে। চ্যালেঞ্জার দেখিয়েছিলেন স্কোপুলারিওপসিস (scopulariopsis) ও অ্যাসপারগিলাস (Aspergillus) ছত্রাক দুটি আর্সেনিক অকসাইড, সোডিয়াম আর্সেনেট, DSMA ও CA কে বিজারিত করে আর্সাইনে পরিণত করে।

জীবাণু ও ছত্রাকের বিক্রিয়ায় As- C বন্ধনীর নানাবিধ জৈবধাতব যৌগাদি উত্পন্ন হয়। পরিবেশের বিজারণ ধর্মিতা বাড়তে থাকলে As (V) ক্রমশ বেশি বেশি বিজারিত হয়ে অবশেষে As(III) -এর উদ্বায়ী আর্সাইনসমূহ উত্পন্ন হয়।

As (V) ও As (III) -এর বায়োমিথাইলেশন জীবনের পক্ষে একটি স্বাভাবিক নির্বিষকরণ প্রক্রিয়া, অথবা স্বাভাবিক প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়া। কোয়াটারনারি জৈব রাসায়নিকগুলি, যেমন – আর্সেনোবিটেন (AB), আর্সেনোকলিন (AC) প্রকৃতপক্ষে একেবারে নির্দোষ, নির্বিষ।

মৃত্তিকা পরিবেশে জীব রূপান্তরের উপচক্র


মাটিতে ক্রমাগত আর্সেনিক আসতে থাকলে ক্রমশ তা উদ্ভিদের পক্ষে অসহনীয় বিষ হয়ে দাঁড়ায়। মাটিতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, উদ্ভিদের পচা অবশেষ প্রভৃতিতে উদ্ভূত বিজারক পরিবেশে জীবাণু, ছত্রাক, জল প্রভৃতির উপস্থিতিতে আর্সেনিক আর্সাইন গ্যাস সমূহে পরিণত হয়ে বায়ুমন্ডলে বিমুক্ত হয়। বাতাসে ধূলিকণা বাহিত আর্সেনিকের চেয়ে বাষ্পীভূত আর্সেনিকের পরিমাণ প্রায় চারগুণ বেশি। প্লাবিত মৃত্তিকার বিজারক পরিবেশে প্লাবনশেষে ক্ষেতের আর্সেনিক বিস্তর কমে যায়। 2000 সালের পশ্চিমবাংলার ভয়ঙ্কর বন্যায় এটা ঘটেছিল।

জল ও পললে আর্সেনিকের উপচক্র


জলীয় পরিবেশে আর্সেনিকের জারণ, বিজারণ, জৈব যৌগের অজৈবীকরণ, জৈব সংশ্লেষণ, অধঃক্ষেপণ, পরিশোষণ সবই হয় এবং অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সঙ্গেই হয়।

Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading