যেওনা তুমি পরদেশ


1999 সালে উত্তরাখণ্ডের সব জায়গায় যখন জলের প্রচণ্ড অভাব, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে তখন দূধাতলি এলাকায় এপ্রিল, মে, জুন মাসেও চালে টলটলে জল ভর্তি ছিল l 2010 সাল পর্যন্ত এই এলাকাতে প্রায় কুড়ি হাজার ( 20,000 ) ছোট বড় চাল তৈরী হয়েছে l ২০০৪ সালে পুরুলিয়ার আশাবরী প্রকাশনার থেকে “যেওনা তুমি পরদেশ” শিরোনাম নিয়ে হিন্দী লেখাটির বাংলা অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

মুখবন্ধ


আমরা বারে বারে দেখেছি লোকবিজ্ঞানের মধ্যে স্থানিকতা এমন অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত থাকে যে তাকে স্থানিকতা মুক্ত করে বিস্তির্ণ প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করা প্রায়ই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে l এখানেই হয়ত লোকবিজ্ঞানের প্রকরণের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা চর্চার বিমূর্ত ধারণার কোথাও মেল বন্ধন ঘটানো দরকার বা বলা যায় প্রয়োজন রয়েছে l কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিদ্যাচর্চার এই দুটি ধারা এখনও পরস্পরকে প্রয়োজনীয় মান্যতা দেয় না – আর এরই ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই এই দুটি ধারার মধ্যে সার্থক কথপোকথন এখনও অনুপস্থিত l কিন্তু এই দুটি ধারাকে আমরা মেলাতে না পারলেও, কিছুটা কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারি, আর যদি সেটা করে দেখাতে পারি, তাহলে এ কথা বলা যেতেই পারে যে - সাফল্যের সুরেলা ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হবেই l যেমনটা হয়েছে, পৌড় গাঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ডের দূধাতলি এলাকায় l

পৌড় গাঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ডের দূধাতলি এলাকার গ্রামগুলি প্রায় চার হাজার (4000) ফুট থেকে সাত হাজার (7000) হাজার ফুট উচুঁতে রয়েছে l সারা বছর ধরেই এখানে ঠাণ্ডা থাকে l শীতকালের সময় তো বেশির ভাগ এলাকা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে l এরকম ঠাণ্ডা জায়গায় গাছ - গাছালিও বাড়ে খুব ধীর গতিতে l আর মাটি তৈরী হতেও সময় লাগে সাধারণ অবস্থার থেকে অনেক বেশি l কিন্তু বর্ষার সময় আবার খাড়া ঢালের কারণে এই অমূল্য মাটি বয়ে যেতে কিন্তু মোটেই সময় লাগে না l তীব্র গতিতে বয়ে চলা জল নিজের সাথে আরও দ্রুতগতিতে মাটি কেটে বয়ে নিয়ে চলে l এই অবস্থায় মাটি ও জল সংরক্ষণের কাজ কয়েক বছরের নয়, কয়েক দশকেই হয়তো করা সম্ভব হয় l কিন্তু পৌড় গাঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ডের দূধাতলি এলাকার মানুষ এই অসম্ভবকে খুব ধৈর্য্যের সঙ্গে সম্ভব করে দেখিয়েছেন l এখানে এঁদের পরিসংখ্যান বা টাকা - পয়সা নয়, নিঃশব্দে কাজ করাই ছিল লক্ষ্য l তাই আজ তারা নিজেদের স্বজনদের সঙ্গে মাটি আর জলের ‘পরদেশ’ যাওয়া আটকাতে সক্ষম হয়েছেন l আর তাই আজ এই এলাকায় প্রায় 35টি গ্রামের খালি পড়ে থাকা বিরাণ ভূমিতে, জলের অভাবে খিল পড়ে থাকা জমিতে এবং সুন্দর ঘন জঙ্গলে পর্যন্ত প্রায় 7000 চাল -এ জল সারা বছর রুপোর মতো ঝকঝক করছে l

এই লেখাটি প্রথমে নিউ দিল্লির গান্ধী শান্তী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘গান্ধীমার্গ’ -এর নভেম্বর - ডিসেম্বর 2011 সংখ্যায় প্রকাশিত হয় l এরপর হিন্দীতে পুস্তিকা আকারেও বেরিয়েছে l এরকম একটি সদর্থক, হৃদয়গ্রাহী কাজের উদাহরণ বাংলায় করা একান্ত প্রয়োজন মনে হল l লেখাটি পড়লে আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন বলে আমি শুধু মনে করি না সর্বান্ত করণে বিশ্বাস করিl এখানে আর একটি কথা বিনম্রভাবে বলি – ‘আশাবরী’ অনুপম মিশ্রের অন্যান্য বইগুলির সাথে আরও একটি বই প্রকাশ করতে পেরে গর্বিত l তবে অনুপম মিশ্রের শব্দ চয়নের যে মগ্নতা – ভাষান্তর করতে গিয়ে হাবুডুবু খেতে হয় বারে বারে l অনুপমজী বইটির নামকরণ করেছেন ‘না জা স্বামী পরদেশা’ l আপাত দৃষ্টিতে সপাট সরল ছোট্ট এই একটি বাক্যেই কি আবেগ মথিত ঘন বেদনার সঙ্গে পুরো চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে l কি গভীর ব্যঞ্জনা l এই ব্যাঞ্জনাটুকুকে সম্বল করেই আমরা বাংলায় নামকরণ করলাম - ‘যেওনা তুমি পরদেশ’ l

যেওনা তুমি পরদেশ


ঢৌণ্ড জেলার পঞ্চায়েত ভবনে ছোট ছোট মেয়েরা নাচছিল, নেচেই চলেছে l তাদের গানের বোল ছিল-
ঠাণ্ডে পানি মেরা পাহাড় মা
না যা স্বামী পরদেশ l
( ঠাণ্ডা জল আমার পাহাড়ে স্বামী তুমি যেও না বিদেশ )

গানের এই বোল সামনে বসে থাকা পুরো গ্রামটাকে বসিয়ে রেখেছে, বর্ষার দাপট সত্ত্বেও l বৃষ্টিতে ভিজছিল যে সমস্ত দর্শক তাদের মধ্যে এমন অনেক যুবতী বা মধ্য - বয়স্কা মহিলা রয়েছেন যাঁদের স্বামীরা নিজেদের জীবনের অনেক বসন্তই বিদেশে আছেন l এমন বৃদ্ধ দর্শকও ছিলেন যিনি বিদেশে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই কাটিয়েছেন, জীবনের বেশিরভাগ সময় l ভেজা মাদুরে এ রকম শিশুরাও রয়েছে, যাদের হয়তো বা আগামী দিনে বাইরে চলে যেতে হবে l

একটা গান পাহাড়ের লোকেদের পরদেশ যাওয়া কিভাবে আটকাবে l কিন্ত্ত গান গাইছিল যে দলটি তারা গেয়েই চলেছে - আজ ঢৌণ্ড গ্রামে, তো কাল ডুলমোট গ্রামে, আবার জন্দ্রিয়াতে, ভরনোতে, উফরৈঁখাল-এ ... l এই অনুষ্ঠানটা শুধুমাত্র একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল না l এতে কিছু গায়ক রয়েছেন, নর্তক রয়েছেন, একটা হারমোনিয়াম, ঢোল রয়েছে তো তারই সাথে কয়েকশো কোদাল, গাঁইতিও রয়েছে l যা দিয়ে প্রতি গ্রামে এমন কিছু কাজ করা হবে যাতে বর্ষার দুরন্ত গতিতে বয়ে যাওয়া জল ওখানে কিছুক্ষণ থামে l জলের সঙ্গে দ্রুত বয়ে যাওয়া মাটি সেখানে আটকা পড়ে l আর এই গ্রামগুলি, উজাড় হয়ে যাওয়া বনাঞ্চল, খেত-খামারগুলি আবার সেজে ওঠে l আধুনিক অগ্রগতির নীতিগুলি এখানের জীবনের লয়কে, সুরকে, বেসুরো করে ছেড়েছে, তাকেই ফিরে সুরময় করে তোলার চেষ্টা করছে যে দলটি, তাঁরা হলেন দূধাতলি গ্রামের l

2001 -এর জানুয়ারীতেও যখন শুখারলা আর শুখাল না তখন কৃতজ্ঞ গ্রাম তার নাম বদলাবার সিদ্ধান্ত নিল l কি হবে নূতন নাম? নূতন নাম খোঁজা কোন সহজ কাজ ছিল না l কিন্তু এই কঠিন কাজটাকে গ্রামের লোক নিজেদের শ্রদ্ধার গঙ্গায় সঙ্গে জুড়ে দেওয়া উচিত মনে করেছে l গ্রামের নাম তো গড়খাগর ছিল না, নদী হয়ে গেল গড়গঙ্গা l আজ গড়গঙ্গা সারা বছর বয়ে চলেছে l আর তারপর ‘পসোলী’ নদীতে গিয়ে মিশে তাকে আরো সমৃদ্ধ করছে l পৌড় গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ডের দূধাতলি এলাকার উফরেঁখাল -এ আজ থেকে প্রায় 21 বছর আগে সংগঠিত এই ছোট দলটি এখন প্রায় একশো (100) গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, আর এই এলাকায় নিজেদের কাজ করার পরিবেশ তৈরী করছে l নিজেদের কাজের মধ্যে রয়েছে - নিজেদের জল, নিজেদের জঙ্গল, নিজেদের চারা, নিজেদের জ্বালানি আর নিজেদের মাথা, আত্মাভিমান l

এই দলটি বিনম্র নায়ক হলেন সচ্চিদানন্দ ভারতী l উনি উফরৈঁখাল -এর ইণ্টার - কলেজে পড়ান l তিনি নিজে পড়াশোনা করেছেন চামোলি জেলার গোপেস্বর কলেজে l সময়টা 1979 সাল l সেই সময় ওখানে বিখ্যাত চিপকো আন্দোলনের জন্ম হয় l ভারতী, কলেজের কোর্সের পড়াশোনা ছাড়াও নিজের উত্সাহে পাহাড়ি জীবনের পরিবেশ বিষয়েও পড়াশোনা করেন l এবং সেটা তিনি খুব নিষ্ঠার সাথেই করেন l তিনি চিপকো আন্দোলনের জনক শ্রী চণ্ডী প্রসাদ ভট্টের সঙ্গে আন্দোলনের কয়েক ধাপে লড়াইও করেন এবং পরে তাঁদের সৃষ্টিমূলক পক্ষের সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন l সংঘর্ষ ও সৃষ্টির সংযুক্তপাঠ তিনি সেখান থেকেই শিখেছিলেন l

পড়াশোনা শেষ করে ভারতী 1979 সালে নিজের গ্রাম গাড়খার্ক, উফরৈঁখাল ফেরেন l সে সময় তিনি খবর পেলেন মধ্য উত্তরাখণ্ডে স্থিত দূধাতলি এলাকায় বন বিভাগ ফার, রাগা গাছ কাটছে l হিমালয়ের রাগা প্রজাতির গাছ ভোজ বৃক্ষের মতো লুপ্ত হতে চলেছে l পুরনো যা ছিল তা কাটা পড়েছে আর নতুন যা গজানো দরকার ছিল, তা গজাচ্ছে না l

শ্রী সচ্চিদানন্দ ভারতীর মনে হল এই গাছ কাটা যে ভাবেই হোক বন্ধ হওয়া দরকার l তিনি কয়েকজন বন্ধুর সাথে দূধাতলি বনাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি গ্রামের দিকে গেলেন l পদযাত্রায় গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় গ্রামের মানুষজনকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করা হল কি - জঙ্গল অবশ্যই সরকারের, কিন্তু গাছ কাটার, গাছ বিনাশের প্রথম কুফলের প্রভাব গ্রামবাসীদেরই ভোগ করতে হবে l এই জঙ্গল যদিও আমাদের নয় কিন্তু বিনাশ আমাদেরই হবে l সবাই যদি একজোট হওয়া যায় তাহলে এই বিনাশকে আটকানো যেতে পারে l গ্রামবাসীদের এই জাগরণ, এই একজোট হওয়ার গল্প অনেক পুরোনো, এবং দীর্ঘও l এখানে সেটা ফিরে বলার প্রয়োজন নেই l শুধু এইটুকু বললেই হবে যে, কখনো কখনো ভালোভাবে কথা বলা হলে, সরকার ও সরকারী আধিকারীকরাও বোঝেন এবং সব সময়ই লড়াই বা সংঘর্ষে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না l দুধাকলিতেও তাই হল l

এরকম ঘটনা এই এলাকায় এই প্রথম l এর থেকে দুটো দিক বেরিয়ে এল - প্রথমটা হল সকলে একজোট হলে সরকারের ভুল কাজের সিদ্ধান্তকেও আটকানো যায়, বদলানো যায় l আর দ্বিতীয় এই যে - একটা বড় বিনাশকে যখন আটকানো গেল তখন এই জায়গা থেকেই কেননা সৃজন অর্থাত জঙ্গল বাড়ানোর কাজ শুরু করা যায় l

যা ভাবনা তাই কাজ। প্রায় সাথে সাথেই পরিবেশ বিষয়ক একটি কর্মশালার আয়োজন করা হল l আশপাশের এবং অবশ্যই অল্প কিছু দূরের মানুষজনকে উফরেঁখালে আসার আমন্ত্রণ জানানো হল l উফরেঁখাল হল রাস্তা থেকে অনেক দূরে ছোট্ট একটি গ্রাম l হাতে না কোন সম্বল, না কোন সম্পর্ক l মাথায় চিন্তা - কর্মশালাতো করা হবে কিন্তু তার জন্য তো পয়সা লাগবে l পয়সা ছাড়া কি কিছু হয়! খাওয়া দাওয়ার জন্যও অবশ্যই কিছু খরচা হবে l কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়, কার কার কাছে সাহায্য চাওয়া যায়? গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান নতুন দিল্লীতে চিঠি লেখা হল l এক হাজার টাকা সেখান থেকে পাওয়া গেল l

এইভাবে 1980 সালের জুলাই মাসে দূধাতলি এলাকায় প্রথম পরিবেশ বিষয়ক কর্মশালা সম্পন্ন হল l সকলে নিজের নিজের এলাকার পরিস্থিতি, বনাঞ্চলের অবস্থা, কোথায় কত গাছ কাটা পড়ছে, এ সমস্ত কথা পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করল l যে ঘটনা চুপচাপ ঘটে চলেছিল, তার মৌনতা ভঙ্গ হল l কর্মশালা শেষে সকলে মিলে পাশের বনভূমিতে গাছের চারা পুঁতল l

দূধাতলী এলাকায় প্রথম কর্মশালা দিয়ে এক নুতন চিন্তাধারার চারা রোপন হল এভাবেই l তখন এই নূতন চিন্তার চারা রোপণ করেছিল যে হাত, তারাও জানত না যে ভবিষ্যতে এই উদ্যোগ এই এলাকায় সঠিক বিকাশের এক সুদৃঢ় সুবিশাল বৃক্ষ হয়ে উঠবে, এবং এর ঘন ছায়ায় নতুন আরো অনেক বিচারই গজিয়ে উঠবে বা গজিয়ে উঠতে সাহায্য করবে l

এই সকল কাজ সঠিকভাবে চালানোর জন্য 1982 সালে একটি সংস্থা তৈরী হল - ‘দূধাতলি লোক বিকাশ সংস্থান’ l গঠনের সময়ই কিছু বিষয় ঠিক করে নেওয়া হয়েছিল l নিজের এলাকায় পরিবেশ বিষয়ে কাজ তো করা হবেই, কিন্তু তা যেন স্থানীয় লোক তথা স্থানীয় বিষয়ক হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখা হবে l এটাও ঠিক হল যে কর্মশালার মাধ্যমেই এইসব কাজ করা হবে l খুব তাড়াতাড়ি এটাও বোঝা গেল যে জঙ্গল যদি করতে হয় তাহলে নিজেদের প্রয়োজনীয় চারা নিজেদেরই তৈরী করতে হবে l সংস্থা গঠনের মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন শিক্ষকরা l তাই পরের ধাপে প্রথমেই তাদের নজর পড়ল ছাত্রদের উপর l তখনও পরিবেশবিদ্যা স্কুলের আবশ্যিক পাঠ্য হয় নি l কিন্তু এখানেতো পরিবেশ বিদ্যা পাঠ্য নয়, জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল l

ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রেরণাতে বিভিন্ন প্রকার বীজ সংগ্রহ করতে আরম্ভ করল l প্রথমে আখরোট চারার একটা নার্সারী করা হল l চারাগুলি বিক্রি করা শুরু হল l গ্রামেরই সংস্থার তৈরী চারা বিক্রি করে কিছু রোজগার হল l ঐ পয়সা আবার ঐ কাজেই লাগানো হল l এইভাবে ছোট ছোট বিষয় দিয়ে এক বড় লক্ষ্যকে ছোঁয়ার জন্য লম্বা যাত্রা শুরু হল l একের পর এক কর্মশালার আয়োজন করা হতে থাকল, আর যে এলাকাগুলোতে জঙ্গল শেষ হয়ে গেছিল সেখানে আবার নতুন করে জঙ্গল তৈরীর কাজ শুরু হল l

এই শিবির বা কর্মশালার, অন্যান্য প্রথাগত কর্মশালাগুলির মতো নিয়ম রক্ষার দায় ছিল না - কাজ পূর্ণ করার জন্য এই কর্মশালারগুলির আয়োজন করা হত l তাই কর্মশালা এক দিন দুই দিন নয়, কখনো কখনো দশ দিন পর্যন্তও চলত l জায়গারও কোন বাঁধা ধরা কোন নিয়ম ছিল না। প্রয়োজন অনুযায়ী জায়গা ঠিক করা হতো। কখনো শিবির গ্রামাঞ্চলে হতো, তো কখনো আবার বনাঞ্চলে l কখনো আবার গ্রামের স্কুলে, তো কখনো বা পঞ্চায়েত ভবনে l জায়গা নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখা হত জায়গাটা যেন সর্বজনীন হয়, যাতে সবাই আসতে পারে l শিবির যেখানেই হোক, তার আশপাশের পাঁচ - দশটা গ্রামের স্ত্রী - পুরুষ মেয়ে - ছেলেদের জড়ো করার চেষ্টা করা হত l কেননা শিবিরের আলোচনার মূখ্য বিষয় থাকত ঘাস, জঙ্গল, জল, চাষ প্রভৃতি - আর তাই, শিবিরের পর শিবিরে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই চলল l পরে পরে এই কর্মশালার আলোচনার থেকেই সিদ্ধান্ত হল যে প্রতিটি গ্রামের নিজেদের বন হোক l বনগুলো যেন ঘনও হয় যাতে মেয়েদের জ্বালানি, ঘাঁস চারা সব জোগাড় করতে কিছুটা সুবিধা হয় l এইভাবে প্রতিটি কর্মশালার পর সেই গ্রামের মহিলাদের নিজেদের সংগঠন তৈরী হল, যাকে বলা হল - ‘মহিলা মঙ্গল দল’ l

এই মহিলা দল, কাণ্ডজে দল ছিল না l এর প্রধান কারণ কাগজ তৈরীই হয়নি l বর্তমানের কর্মশালাগুলোর মতো কোন লেখা - ঝোকা রেজিস্টার দস্তাবেজ এদের কিচ্ছু ছিল না l এদের সংগঠন ছিল পবিত্র হৃদয় থেকে তৈরী সংগঠন, তাই কর্মশালার আয়োজক প্রধান সংস্থা দূধাতলির কার্যালয়েও এদের সংখ্যা বা কোন রেকর্ড পাওয়া যাবে না l এইসব মহিলা মঙ্গল দলের বাস্তবতা তো সেইসব জঙ্গলগুলো থেকেই পাওয়া যেতে পারে, যেগুলো সেই সব গ্রামে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে l

প্রতি দিন দলের মহিলারা পালা করে বন পাহারা দিত l পাহারা দেওয়ার যে কায়দা বা নিয়ম তারা নিজেরা বার করে ছিল, তা শুধু অদ্ভূতই ছিল না ছিল যথেষ্ট সঙ্গীতময় l

একটা লাঠি, কিন্তু সাধারণ লাঠি নয় l লাঠির মাথায় বড় সাইজের দু-চারটে ঘুঙুর বেঁধে দেওয়া হয়েছে l এই লাঠির নাম হল ‘খাঁকর’ l খাঁকর নিয়ে মেয়েরা বন পাহারা করে l চলতে গিয়ে লাঠি পায়ে পায়ে মাটিতে লাগে আর তখনই খাঁকরের ঘুঁগুর বেজে ওঠে l বনের নিস্তব্ধতা ভেদ করে খাঁকরের এই সুরেলা শব্দ বনের অন্য প্রান্তে পাহারায় রয়েছে যে মেয়েটি তাদের পরস্পরকে জুড়ে দেয় l এই সঙ্গীতময় লাঠি অন্য একটি সুরময় ব্যবস্থারও অঙ্গ l জঙ্গল রাখোয়ালি সেরে মেয়েরা যখন সন্ধ্যে বেলায় ফিরে আসে তখন সে নিজের খাঁকরটি নিজের দরজার কাছে না রেখে অন্য কারো দরজার কাছে রেখে দেয় l এর অর্থ হল, আগামীকাল ঐ ঘরের মেয়েরা খাঁকর নিয়ে যাবে জঙ্গল রাখার কাজে l নিজের সন্তানের মতো যত্নে বড় করে তোলা জঙ্গলের রাখা করার, দেখাশোনা করার - এই ঘরোয়া ব্যবস্থা আজ দূধাতোলির প্রায় একশো ছত্রিশ (136) টি গ্রামে খুব নিয়ম করে স্ব-অনুশাসনে চলছে l প্রায় পাকদণ্ডিতে ভাগ হওয়া, ও পাহাড়ের শিখর আর উপত্যকার কারণে একটি অন্যটি থেকে বেশ কয়েকমাইল দূরে থাকা গ্রামগুলি বাইরের কোন পয়সা ছাড়া, আদেশ ছাড়া, নিজেদের জোরে খাঁকরের সঙ্গীতে জুড়ে চলে l

হয়তো বা দেশে প্রথমবারই এ রকম ঘটনা ঘটল যে সত্যি সত্যিই বন দফতরের একটি দল এখানে আসে আর এই এলাকায় গ্রামের লোকেদের লাগানো সুন্দর ঘন ফনফনে বন, সুরক্ষিত জঙ্গল দেখে না শুধু চুপি চুপি ফিরে গেল, সঙ্গে নিজেদের নব্বই (90) কোটি টাকার প্রকল্পটিও ফেরত নিয়ে গেল lকর্মশালাগুলোর আয়োজন যে সব সময় খুব সহজেই করা গেছে তা নয় l মাঝখানের কয়েকটা বছর তো খুব কঠিন সময় ছিল l কোনখান থেকে কোন সাহায্য ছিল না l কিন্তু কর্মশালা বা অন্যান্য কাজের শিকল কখনো ছিঁড়তে দেওয়া হয়নি l গ্রামগুলি নিজেদের সীমিত সাধ্যে এই অসীম কাজ লাগাতার চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে l

1993 -এর প্রথম দিকে সচ্চিদানন্দ ভারতী নিজের এলাকায় জঙ্গলের সাথে জলের পরম্পরাটিও বোঝাতে শুরু করেন l পাহাড়ে ‘তাল’ (তালাব) আজও দেখতে পাওয়া যায় l তবে তীক্ষ্ণ ঢালের জন্য এদের সংখ্যা কমই l তবে ‘খাল’ ও ‘চাল’ নামক আরো দুটি আকার এখানে দেখতে পাওয়া যেত l বিগত দিনে এগুলি প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে l দূধাতলির ‘উফরেঁখাল’ নামই তো এর প্রতীক l এই নাম থেকেই বোঝা যায় যে, কখনো এখানে জলের ভাল ব্যবস্থা ছিল l খালের আকার তালের থেকে ছোট, আর চাল খালের থেকেও ছোট l এগুলি উঁচু পাহাড়ে তীক্ষ্ণ ঢালেও তৈরী হয়েছে l কিন্তু এই সময় তা আর সামনে নেই l নূতন কাজ কি ভাবে করা হবে? কারোর কিছু জানা ছিল না l তাই নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা, কিছু আন্দাজ, কিছু প্রয়োগ দিয়ে জঙ্গলের সাথে সাথে পাহাড়ে জল সংরক্ষণের কাজও শুরু হল l একের সঙ্গে এক জুড়লে যোগফল হয় দুই, কিন্তু এখানে তা হল এগারো l এককের সঙ্গে একক যোগ করে ফল পাওয়া গেল দশক পরিমাণ l

দূধাতলি এলাকায় চাল তৈরীর কাজ ‘গডখর্ক’ গ্রামের উফরেঁখাল থেকে শুরু হয় l পরে তা জঙ্গলের আগুনের মতো অর্থাত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে l আজ এই এলাকায় প্রায় ৩৫টি গ্রামের খালি পড়ে থাকা বিরাণ ভূমিতে, জলের অভাবে খিল পড়ে থাকা জমিতে এবং সুন্দর ঘন জঙ্গলে পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার ( 7000 ) চাল -এ জল সারা বছর রুপোর মতো ঝক্-ঝক্ করছে l 1999 সালে উত্তরাখণ্ডের সব জায়গায় যখন জলের প্রচণ্ড অভাব, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে তখন দূধাতলি এলাকায় এপ্রিল, মে, জুন মাসেও চালে টলটলে জল ভর্তি ছিল l 2010 সাল পর্যন্ত এই এলাকাতে প্রায় কুড়ি হাজার ( 20,000 ) ছোট বড় চাল তৈরী হয়েছে l চালের প্রচলন ফিরে আসায় এই এলাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে l খিল খেতে আবার ফিরে চাষ হচ্ছে l বিরাণ বনভূমিতে সমস্ত বছর ধরে জল থাকায় প্রকৃতি নিজেই তার বহু অদৃশ্য হাতে প্রচুর চারা আর ঘাস লাগায়, বন আরো ঘন হয়ে উঠছে l ঘাস – চারা – জ্বালানী - জল ছাড়া পার্বত্য জীবন তিতবিরক্ত হয়ে উঠেছিল - আজ এখানে আবার মধুময় সুর ফিরে আসছে l ‘ঘাস চারা পানি / ইনকে বিনা যোজনা কানি’ এই স্লোগানও এখানে চলে l

চাল যেভাবে জঙ্গলে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, তা জঙ্গলে আগুন নেভাতেও অদ্ভূতভাবে কাজে লাগছে l উত্তরাখণ্ড বা দেশের অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে ভয়াবহ রকমের আগুন লাগার ঘটনা ঘটে l এই আগুন নেভানোর কোন বিশেষ উপায় বনবিভাগ এখনও বার করতে পারে নি l যখনই এই বিষয়ে কোন আলোচনা বা তর্কবিতর্ক হয় তখনই বন দপ্তর রুশ, গ্রীস, স্পেন, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ দিয়ে হেলিকপ্টারকে কাজে লাগানোর কথা বলে l তারা এটা ভুলে যায় যে, সেখানে হেলিকপ্টারও আগুন নেভাতে পারছে না l আর এই ঘটনা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে l

জঙ্গলে আগুন একটা বড় সমস্যা l বর্ষাকালে বৃষ্টির জল পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচের খাদে, নদী নালায় বয়ে চলে যায় l তারপর শীতকাল ঠিকই পেরিয়ে যায় l গরম আসতে আসতে সমস্ত বন তেতে উঠে, ঘাস শুকিয়ে যায় আর অপেক্ষা থাকে এক ফিনকি আগুনের l 1998 -এর মে মাসে প্রায় আশি (80) হাজার হেক্টর বনাঞ্চল আগুনে ছাই হয়ে যায় l বর্তমানে প্রতি বছর দাবানলে প্রায় চারশো পঞ্চাশ (450) কোটি টাকা লোকসান হয় l দামী জঙ্গল, গাছ - পালা আর বন্য জীবজন্তু প্রভৃতির যে ক্ষতি হয় তা সরকারী পরিসংখ্যানে বা পয়সায় তাকে মাপতে পারা যায় না l প্রকৃতির দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রম সমাজের জন্য বংশানুক্রমিক সুবিধা, বর্ষা-দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচার সর্বোত্তম কবচ - সবকিছু চোখের নিমেষে পূড়ে ছাই হয়ে যায় l

দূধাতলিতে যখন থেকে চাল এবং খালের কাজ শুরু হয়েছে তখন থেকেই এখানের বনগুলি আগুন থেকে সুরক্ষিত হয়ে চলেছে l প্রতিটি গ্রামের জঙ্গলে তৈরী হয়েছে চাল, আর তাই গরমের তপ্ত মরসুমেও আর্দ্রতার কারণে সবুজ হয়ে রয়েছে l আর আগুন লাগতে পায় না l যদি কোথাও আগুন লেগেও যায় তো সকলকে অসহায় হয়ে পড়তে হয় না এই ভেবে যে কিভাবে এই আগুন নেভানো যাবে l ভর্নো নামের গ্রামে নিজেদের লালিত জঙ্গলে 1998 সালের মে মাসে আগুন অবশ্যই লেগেছিল কিন্তু চালের উপস্থিতির কারণে তা খুব তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে l কিন্তু এই গ্রামেরই পাশে সরকারী বন আগুন থেকে রক্ষা পায় নি l একইভাবে জাইন্দ্রা গ্রামের সরকারী বনও আগুনের গর্ভেই আহুতি হয়েছিল l বন বিভাগ বনকে আগুন থেকে বাঁচাতে আপিল করার জন্য, কমিটি তৈরী করতে তো আসে, কিন্তু আগুন নেভানোর জন্য আসতে পারে না l এই গ্রামগুলিতে গ্রামবাসীরা চাল তৈরী করে নিজেদের বন সুরক্ষিত করেছে আর সরকারী বনে লাগা আগুনকেও নেভাতে গিয়ে নিজেরাই আগুনে ঝলসে যান, তাঁদের আর বাঁচানো যায় নি l

এই চালগুলি অথবা যেগুলিকে এখন ওখানের লোকেরা ‘জল তালাই’ বলছে, গ্রামের সরকারী জল প্রদান প্রকল্পকেও নূতন জীবন দান দিয়েছে l উত্তরাখণ্ডের অনেক গ্রামে জলের অভাব দেখা দিচ্ছে l হিমালয়কে জলের / নদীদের বাপের বাড়ি বলা হয়ে থাকে l কিন্তু জলের বাপের বাড়িতেই জল অবশিষ্ট ছিল না l স্বজল -এর মতো ব্যয় সাপেক্ষ প্রকল্পতেও জলের মতো প্রচুর পয়সা বয়ে গেছে, কিন্তু জল বয়ে আসেনি l কিছু সীমিত এলাকাতেই এটা হয়েছে এ কথা ঠিক, কিন্তু তাদের তৈরী চাল এখানের জলের সমস্যার সমাধান করে দেখিয়েছে l এখন সারা বছর ধরে প্রচুর জল রয়েছে l শুকিয়ে যাওয়া ছোট ছোট নদী - নালাগুলিকেও সচল করেছে এই চালগুলি l

উফরেঁখালের জঙ্গল থেকে বেরিয়েছে ‘শুখারলা’ নদী l এই শুখারলা বর্ষায় উথলে উঠতো, আর নভেম্বরেই শুকিয়ে যেত, তাই নদীটির নাম হয়েছিল শুখারলা l এখানে 1993 সাল থেকে 1998 সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার জল তালই তৈরী হয়েছে l এগুলিতে সঞ্চিত জলের প্রতিটি বিন্দু শুখারলার স্বভাব পাল্টে দিয়েছে l এখন কিন্তু গরমের দিনেও শুখারলায় জল থাকছে l তবুও গ্রামের লোক ধৈর্য্য ধরে শুখারলার নাম পাল্টায় নি l কিন্তু 2001 -এর জানুয়ারীতেও যখন শুখারলা আর শুখাল না তখন কৃতজ্ঞ গ্রাম তার নাম বদলাবার সিদ্ধান্ত নিল l কি হবে নূতন নাম? নূতন নাম খোঁজা কোন সহজ কাজ ছিল না l কিন্তু এই কঠিন কাজটাকে গ্রামের লোক নিজেদের শ্রদ্ধার গঙ্গায় সঙ্গে জুড়ে দেওয়া উচিত মনে করেছে l গ্রামের নাম তো গড়খাগর ছিল না, নদী হয়ে গেল গড়গঙ্গা l আজ গড়গঙ্গা সারা বছর বয়ে চলেছে l আর তারপর ‘পসোলী’ নদীতে গিয়ে মিশে তাকে আরো সমৃদ্ধ করছে l

হিমালয়ের এই গ্রামগুলিকে নিজের উদারতায় এতো লাভবান করে চলেছে যে চাল, তার নিজের আকার খুবই ছোট হয়, আর এই ছোটতেই এর বড়ত্ব লুকিয়ে রয়েছে l যেখানে ঠিকঠাক জায়গা পাওয়া যায় সেখানে পাঁচ থেকে দশ মিটার আকারের জল তালাই বানানো যায় l এ নিজে নিজেই কোন চমত্কার করতে পারে না l চমত্কার লুকিয়ে রয়েছে জল তালাইয়ের শৃঙ্খলার মধ্যে l যখন উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পুরো ঢাল, জল তালাই নিজের ছোট ছোট আকারে ঢেকে দেয় তখন জলের অক্ষয় ভাণ্ডার তৈরী হয় l জল পাহাড়ের ঢালে এদিক ওদিক দিয়ে বয়ে চলে তাই জল তালাইও এদিক ওদিক তৈরী করা হয় l আর এইভাবে সব জায়গাতে জল একত্র হয়ে যায় l এই জল, তালাইয়ের সংগৃহীত জল ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নীচে উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছে যায় l এখানে এই নীচের দিকে, চালের থেকে একটু বড় আকারের খাল বা তাল বানানো হয়েছে l এগুলিতে এখন সারা বছর জল ভর্তি থাকে l চাল আকারে ছোট আর তৈরী করতে খরচাও কম l পঞ্চাশ, এক শত, বা দুই শত (50 - 100 – 200) টাকার মধ্যে একটা চাল হয়ে যেতে পারে l যাঁরা তৈরী করেন তাঁরা নিজের কাজ মনে করেই তৈরী করেন l তাই পঞ্চাশ বা এক শত, (50 – 100) টাকার সাহায্যও কম মনে করেন না l চাল তৈরীর সময়, যিনি তৈরী করছেন তিনি নিজেকে কারো মজদুর ভাবেন না l তাঁরাই এদের মালিক, আর তাঁদের এই প্রভুত্বই সামাজিক সমৃদ্ধিকে বৃদ্ধি করে l এই প্রকার সুদৃঢ় সমৃদ্ধি পুরো সমাজের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, মাথা উঁচু করে l তখন যদি হঠাতই বড় কিন্তু অব্যবহারিক কোন প্রকল্প সেখানে এসেও পড়ে তাহলেও মানুষের পদস্খলন হয় না l

এইরকমই একটি প্রকল্প 1998 সালে পূর্ব নায়ার উপত্যকায় আসে l জল বিকাশের কাজ ছিল l সহযোগী ছিল বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো নামী - দামী সংস্থা l কিন্তু গ্রামের লোক এই প্রকল্পটিকে সমর্থন করেন নি l কাজতো সেই একই ছিল, গ্রামে গ্রামে যা করা হচ্ছিল - বন বিকাশ, জলধারার বিকাশ l পয়সাও কিছু কম ছিল না l

পুরো প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল নব্বই (90) কোটি টাকা l প্রকল্পটি প্রচারের জন্য যখন গ্রামে গ্রামে বড় বড় বোর্ড লাগানো হল, তখন শ্রী সচ্চিদানন্দ ভারতী বন বিভাগের অধিকর্তাদের একটি ছোট্ট চিঠি লিখলেন l তাতে তিনি খুবই নম্রভাবে লিখেছিলেন, এই এলাকায় জঙ্গলের, জলের খুব ভালো কাজ গ্রামগুলি নিজেরাই সম্পন্ন করেছে, কোন প্রকার বাইরের, বিদেশের বা সরকারী সাহায্য ছাড়াই l তাহলে এই নব্বই (90) কোটি টাকায় আপনারা কি কাজ করতে চলেছেন? ভরসা যদি না হচ্ছে কিছু ভাল সরকারী আধিকারীকের একটি দল এখানে পাঠান l তাদের দিয়ে যাচাই করিয়ে নিন l আর যদি আামাদের কথা ঠিক মনে হয় তাহলে দয়া করে আপনাদের প্রকল্প ফিরিয়ে নিয়ে যান l

হয়তো বা দেশে প্রথমবারই এ রকম ঘটনা ঘটল যে সত্যি সত্যিই বন দফতরের একটি দল এখানে আসে আর এই এলাকায় গ্রামের লোকেদের লাগানো সুন্দর ঘন ফনফনে বন, সুরক্ষিত জঙ্গল দেখে না শুধু চুপি চুপি ফিরে গেল, সঙ্গে নিজেদের নব্বই (90) কোটি টাকার প্রকল্পটিও ফেরত নিয়ে গেল l

জঙ্গলের গ্রাম, হিমালয়ের কয়েকটি মাত্র গ্রাম যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে বাইরের সাহায্য, বিদেশী পয়সা, সরকারী পয়সা না নিয়ে নিজেদের কিছু শুভ চিন্তকদের সাহায্যে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ভুল শুধরে মাত্র কুড়ি বছরে এত বড় কাজ করে দেখাতে পারবে, তাহলে কেবল উত্তরাখণ্ডই নয়, তাতে সমস্ত পার্বত্য এলাকার সুধরানোর বীজ লুকিয়ে রয়েছে l

পর্বত প্রমান এই সাফল্য পাওয়ার জন্য দুধাতলির লোক বিকাশ সংস্থান-এর কর্মকর্তাগণ সংস্থানের বিষয়েও এক আলাদা ধরণের সাধনা করেছেন l একশো ছিত্রশ (136) -টি গ্রামের এত সুন্দর বিশাল কাজ করেছে যে সংস্থা, তাদের কর্মকর্তা মাত্র পাঁচ জন l

প্রধান হলেন, শ্রীসচ্চিদানন্দ ভারতী। তিনি উফরেঁখালের ইণ্টার কলেজের শিক্ষক l বেতন দেয় শিক্ষা দপ্তর l ছেলেদের যত্ন সহকারে ভালবেসে পড়ান l তারপর যে সময় বাঁচে তাতে পুরো সময়টাই সমাজসেবা করেন l শ্রী ভারতী শিক্ষাকে – সমাজ সেবার শিক্ষাকে সত্যি সত্যি ছোট স্কুলের চার দেওয়াল থেকে বার করে সারা এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শিখর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন l দ্বিতীয় কর্মকর্তা হলেন, শ্রী দীনেশ l ইনি এখন সংস্থার মন্ত্রী l উফরেঁখাল গ্রামেই ছোট একটি ওষুধের দোকান করেন l যখনই সমাজের কাজ, সংস্থার কাজ আসে তিনি ওষুধের দোকানের সাটার নামিয়ে সেবার দরজা খুলে দেন l তিনিও সংস্থা থেকে কোন বেতন নেন না l তৃতীয় জন হলেন শ্রী দীনদয়ালজী l তিনি একজন ডাক পিওন l তিনি ডাকও বিলি করেন, সঙ্গে দুধাতলী সংস্থার মাধ্যমে মানুষের সুখ দুখও ভাগ করে নেন l নিজের এলাকায় পরিবেশ প্রসারের চিঠি দূর দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছে দেন l আর ওনার এই চিঠি সকলেই পড়েন l চতুর্থ জন হলেন, বিক্রমজী l ইনিও গ্রাম ডুলমোট -এ নিজের পৈত্রিক দোকান দেখাশোনা করেন l পঞ্চম জন হলেন, শ্রী হরিসিংজী l তিনি চাষবাস করেন l তাছাড়াও কয়েকশো গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে সংস্থার সেচ্ছাসেবকরা l এদের সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক l তাদের মধ্যে ঐ মহিলাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো, যাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাঁকর নিয়ে নিজেদের জঙ্গল পাহারা দেয় l

সংস্থার খরচা, এতবড় কাজের জন্য জিনিষপত্র জোগাড় করা, শ্রী ভারতী প্রথম দিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন কিছুর জন্যই বিদেশী পয়সা না নেওয়ার l অন্য সংস্থাও এইরকম সংকল্প নিয়ে থাকে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন পড়লে তা ভেঙ্গেও ফেলে l দূধাতলিতে এই নিয়ম এখন পর্যন্ত ভাঙ্গা হয়নি l

সম্বল জোগাড় করা ও তা প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করার প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়ে l সংস্থাটি রেজিস্টার্ড সংস্থা l প্রতি বছর আয় - ব্যয়ের অডিট করাতে হয় l যে অডিটর এই কাজটি করেন তিনিও এঁদের কাছে কোন পয়সা নেন না l সংস্থাও তাদের অডিট রির্পোট বিস্তৃতভাবে নিজেদের এলাকার ছোট - বড় সব খবরের কাগজে বার করে l রির্পোটি ছাপিয়ে তাঁরা সর্বজনিক করে দেন l সর্বজনিক কাজের খবরাখবর সর্বজনের হয়ে যায় l

এই এলাকার গ্রামগুলি প্রায় চার হাজার (4000) ফুট থেকে সাত হাজার (7000) ফুট উচুঁতে রয়েছে l সারা বছরই ঠাণ্ডা l শীতকালের সময় তো বেশির ভাগ এলাকা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে l এরকম ঠাণ্ডা জায়গায় গাছও বাড়ে খুব ধীরে ধীরে l আর মাটি তৈরী হতেও প্রচুর সময় লাগে l কিন্তু বর্ষার সময় খাড়া ঢালের কারণে এই অমূল্য মাটি বয়ে যেতে সময় লাগে না মোটেই l তীব্র গতিতে বয়ে চলা জল নিজের সাথে আরও দ্রুতগতিতে মাটি কেটে বয়ে নিয়ে চলে l এই অবস্থায় মাটি ও জল সংরক্ষণের কাজ কয়েক বছরে নয়, কয়েক শতাব্দীতেই করা সম্ভব হয় l

দূধাতোলির এই কাজ তাই খুবই ধৈর্যেই সঙ্গে দাঁড় করানো গেছে l এখানে পরিসংখ্যান বা টাকা-পয়সা নয়, নিঃশব্দে কাজ করাই ছিল লক্ষ্য l তাই দূধাতোলির এই দল কখনই হয়তো বা নিজের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারেনি l বাইরের লোক, বন্ধুবান্ধব, যারা ভাল চায় এমন লোক কখনও কখনও এখানে আসেন l তখন তাঁদের খুবই আত্মিক অভ্যর্থনা জানানো হয় l ভগবানের পূজায় লাগ যে ‘পৈঁয়া’ -র পাতা তার সাধারণ কিন্তু ভব্য মালাতে ‘বুরাঁস’ ( রডডেনড্রন ) -এর একটি ফুল সমস্ত গ্রামের আতিথ্য ভাবনাকে আনন্দে বদলে দেয় l খেত আর বনের ফুল কর্মশালাগুলোকে নূতনভাবে রঙ্গীন করে তোলে, গানের দলটির গান, ঢোল, নাঙড়া, শিঙার আওয়াজ সমস্ত উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হয় - মাটি আর জলের ‘পরদেশ’ যাওয়া আটকাতে l

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading