ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার আবিষ্কারের ফলেই আর্সেনিক বিষণ অপরাধীদের শনাক্তকরণ ও বিচার সম্ভব হয়েছিল। ফোরেনসিক (forensic) ল্যাবরেটরি সমূহে আজকাল নতুনতর ভৌত পদ্ধতিসমূহ চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জায়মান হাইড্রোজেনের (Zn + HCI) সঙ্গে স্যাম্পলের আর্সেনিকের বিক্রিয়া ঘটিয়ে আর্সাইন গ্যাস (AsH3) উত্পন্ন করা হয়।প্রথাগত রসায়নে, এমনকী আর্সেনিক পরিমাপের বেশিরভাগ আধুনিক পদ্ধতিতে কোনও বস্তু বা জলে আর্সেনিকের মোট পরিমাণ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় না কতটা As(III) বা কতটা As(V) আছে। জৈব আর্সেনিকের কোন প্রজাতি কতটা তাও নিরূপণ করা কঠিন। সে সবের জন্য অত্যাধুনিক দামী যন্ত্রপাতির প্রয়োগ আবশ্যক, যা ভারত বা বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। প্রচলিত রাসায়নিক পদ্ধতি সমূহে অত্যল্পমাত্রার আর্সেনিকের গুণগত ও পরিমাণগত পরিমাপও সম্ভব নয়। প্রজাতি নির্ণয়ও তদ্রূপ। উন্নত ভৌত ( physical ) পদ্ধতি সমূহই সঠিক ও নির্ভর যোগ্য তথ্যাদি দেয়। নীচে আর্সেনিকের বৈশ্লেষিক রসায়নের একটি সাধারণ ধারণা দেবার প্রয়াস করা হল ।
আর্সেনিক নিরূপণ ও পরিমাপের প্রথাগত রাসায়নিক ও অধিকাংশ ভৌত পদ্ধতিসমূহে প্রথম প্রয়োজন আর্সেনিককে দ্রবণে পাওয়া। তা বিশ্লেষ্য পদার্থ মাটি, উদ্ভিজ্জ পদার্থ, মাছ, মাংস, রক্ত, নখ, চুল যাই হোক না কেন। ভূগর্ভ জল বা প্রস্রাবে সমস্যা নাই। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ পদার্থ সমূহ, মানুষের মল, চামড়ার খোসা, নখ, চুল প্রভৃতিতে আর্সেনিক নিরূপণ করতে প্রথমে তাদের রাসায়নিক বিয়োজন ঘটিয়ে সমগ্র আর্সেনিকে জলীয় দ্রবণে আনতে হবে (mineralization)। ক্ষেত্রবিশেষে আর্সেনিকের জারণ স্তরেরও ( অর্থাত As(III) ও As(V) এর অনুপাত ) পরিবর্তন ঘটতে দেওয়া চলবে না। বর্তমানে এইসব পদ্ধতিরও উন্নতি হয়েছে। জৈব রাসায়নিককে দুভাবে বিয়োজন করা যায় – এক, শুষ্ক ভষ্মীকরণ (dry ashing ) অর্থাত ম্যাগনেসিয়াম নাইট্রেট এবং অথবা ম্যাগনেসিয়াম অকসাইড মিশিয়ে উত্তপ্ত করে মণিকীভবন ( mineralization ) করা যায়। দুই, ভিজা ভষ্মীকরণ (wet ashing) পদ্ধতিতে নানারকম গাঢ় অ্যাসিড ( নাইট্রিক, সালফিউরিক, পারক্লোরিক ) মিশ্রণ ব্যবহার করে সব জৈবাংশ বিনষ্ট করা হয়। এছাড়া আছে টেফ্লন (teflon) বম্বে উচ্চচাপে মাইক্রোওয়েভ বিয়োজন।
2600C পর্যন্ত তাপমাত্রায় টেফ্লন বম্বে (বাজারে পাওয়া যায়) রাসায়নিক বিয়োজন ঘটিয়ে সমস্ত আর্সেনিককে দ্রবণে আনা যায়। কিছু জৈব যৌগের (যেমন, আর্সেনোবিটেন) জন্য আরও উচ্চ তাপমাত্রার ব্যবস্থা না হলে সমগ্র আর্সেনিকের মণিকীভবন হয় না।
জল, প্রস্রাব ইত্যাদি পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাবার সকর্কতা নিতে হবে, যাতে সংগ্রাহক পাত্র থেকে কোনও আর্সেনিক না আসে। সেক্ষেত্রে পলিথিন বোতলই ভাল। এছাড়া বাইরের ধূলো ময়লা থেকে যেন আর্সেনিক না ঢোকে। এবং বিশ্লেষণের আগে স্যাম্পলে বা নমুনায় জীবাণু বা ছত্রাক ক্রিয়া করে আর্সেনিকের কোনও রাসায়নিক বা জারণ স্তরের পরিবর্তন না ঘটিয়ে না ঘটায়। তার জন্যে প্রতি 1000 মিলি জলে বা প্রস্রাবে 1 মিলি গাঢ় হাইড্রক্লোরিক বা নাইট্রিক অ্যাসিড দিতে হবে।
এবারে প্রথমে স্যাম্পলে আর্সেনিকের সমগ্র পরিমাণ ও তারপরে আর্সেনিকের প্রজাতি নিরূপণের লভ্য পদ্ধতি সমূহের উল্লেখ করা হবে। পুরাতন আয়তনমাত্রিক (volumetric), তৌলিক (gravimetric) বিশ্লেষণ যেহেতু পরিবেশীয় স্বল্প মাত্রার আর্সেনিকের ক্ষেত্রে অচল, তাই তাদের বিবরণ এখানে আর উল্লেখ করা হল না।
ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার আবিষ্কারের ফলেই আর্সেনিক বিষণ অপরাধীদের শনাক্তকরণ ও বিচার সম্ভব হয়েছিল। ফোরেনসিক (forensic) ল্যাবরেটরি সমূহে আজকাল নতুনতর ভৌত পদ্ধতিসমূহ চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জায়মান হাইড্রোজেনের (Zn + HCI) সঙ্গে স্যাম্পলের আর্সেনিকের বিক্রিয়া ঘটিয়ে আর্সাইন গ্যাস (AsH3) উত্পন্ন করা হয়। উত্পন্ন গ্যাস ও নির্গত হাইড্রোজেনকে পুড়িয়ে একটি শীতল উপরিতলে ফেলা হয়। উপরিতলে (surface) আর্সেনিককে ধাতু হিসাবে দেখা যায়। তাকে হাইড্রোজেন পেরোকসাইডে দ্রবীভূত করে রাসায়নিক পরীক্ষা করে আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়। এই পদ্ধতির উন্নততর পরিবর্তিত সংস্করণ হল গুটজাইট ও ফ্লিটম্যান পরীক্ষা।
এই পরীক্ষা উপরোক্ত মার্স টেস্টের মতোন আর্সাইন গ্যাস উত্পাদন করিয়ে সিলভার নাইট্রেটের সঙ্গে বিক্রিয়া করিয়ে ধুসর বা হাল্কা বাদামি বর্ণ উত্পাদনে আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং আনুমানিক মাত্রা বা পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। মারকিউরিত ক্লোরাইড দ্রবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করালে হলদে থেকে লালচে - বাদামি বর্ণ উত্পন্ন হয়। এই পদ্ধতির নানারকম রূপান্তর দেখা যায়। তার মধ্যে মারকিউরিক ব্রোমাইড দ্রবণে নিষিক্ত কাগজের সঙ্গে আর্সাইনের বিক্রিয়ায় উপজাত হলদে থেকে লাল ও বাদামি বর্ণের উত্পত্তি পরীক্ষা করে আর্সেনিকের মাত্রার মোটামুটি পরিমাণ করা যায়। এই পরীক্ষায় লিটার প্রতি জলে 50 থেকে 100 মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পরিমাপ করা যায়।
গুটজাইট টেস্টের পরিবর্তিত নানা রূপ বাজারের নানা টেস্ট বাকসে (field kit) পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় আজকাল বহু কোটি টাকার ফিল্ড কিট দিয়ে বহু কর্মী গ্রামে গ্রামে নলকূপের জলে আর্সেনিক পরীক্ষা করে বেশি আর্সেনিকের নলকূপগুলির মুখে লাল রঙ (50 পিপিবির অধিক আর্সেনিক ) আর অন্যান্যদের মুখে সবুজ রঙ (50 পিপিবির কম আর্সেনিক) দিয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। ই-মার্ক ( E Merck ) কোম্পানির হাল্কা ছোট কিট (Merckoquant) খুব কার্যকরী না হলেও বহুল ব্যবহৃত; এতে As(III) ও As(V) দুইই সাড়া দেয়। মার্ক কিটের ক্ষমতা লিটার প্রতি জলে 50 থেকে 100 মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত. এছাড়া অন্যান্য নানারকম কিটও বাজারে পাওয়া যায়, যথা এনভিটপ (Envitop), কুইক টি টেস্ট (Quick T Test)।
এইসব ফিল্ড কিট দিয়ে আর্সেনিক সমীক্ষার সার্থকতা সম্বন্ধে পরিবেশীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বিস্তর বিতর্ক দেখা যায়।
মলিবডেনাম ব্লু পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে সমগ্র আর্সেনিককে As(V) -এ রূপান্তরিত করা হয়, সাধারণত গাঢ় নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে উত্তপ্ত করে। তাতে অধিক অ্যামোনিয়াম মলিবডেট দিয়ে উত্তপ্ত করে অ্যামোনিয়াম ফসফোমলিবডেটে রূপান্তরিত করা হয়। তাকে একটি বিজারক দ্রবণের (হাইড্রোজিন সালফেটই সবচেয়ে ভাল ) সাহায্যে বিজারণ করলে আর্সেনিকের মাত্রা অনুযায়ী দ্রবণের বর্ণ নীল হয়ে যায়। রঙের গাঢ়তা আর্সেনিকের পরিমাণের সাথে সমানুপাতী। স্পেকট্রো - ফটোমিটার যন্ত্রের সাহায্যেই সাধারণত রঙের তীব্রতার পরিমাপ করা হয়। সিলিকেট এবং / অথবা ফসফেট মলিবেডেটের সঙ্গে ঘটিয়ে আর্সেনিকের পরিমাপে বিঘ্ন ঘটায়। মলিবডেনাম ব্লু পদ্ধতিটি ভালো এবং এতে 0.01 মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পরিমাপ করা যায়।
দ্রবণের সমগ্র আর্সেনিককে জায়মান হাইড্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করিয়ে আর্সাইনে পরিণত করে পাতন করে ক্লোরোফর্ম বা ক্লোরোর্ফম-পিরিডিন মাধ্যমে হেকসামিথিলিন ও সিলভার ডাইইথাইল ডাইথায়ো কার্বামেটের সঙ্গে বিক্রিয়া করানো হয়। তাতে উত্পন্ন রং আর্সেনিকের উপস্থিতি ও পরিমাণ নির্দেশ করে। এই পদ্ধতিতে জলের লিটার প্রতি 0.04 মিগ্রা আর্সেনিক পরিমাপ করা যায়। জল, প্রস্রাব প্রভৃতি দ্রবণে এদেশে এই পদ্ধতিটি বহু ব্যবহৃত। বিকারকটি অপেক্ষাকৃত দামী।
তড়িত রাসায়নিক প্রচুর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে, তাদের সম্ভাবনাও অনেক। কিন্তু এপর্যন্ত এইসব পদ্ধতির এতসব অসুবিধা দেখা গেছে যে, পরিবেশীয় পরিমন্ডলে এদের প্রয়োগ প্রায় নেইই। দ্রবণে তড়িত সক্রিয় (electroactive) এত সব পদার্থ থাকে যে প্রথমে ক্রোম্যাটোগ্রাফি বা অন্যান্য পদ্ধতিতে অর্সেনিককে আলাদা করে নিতে না পারলে তড়িত রাসায়নিক পদ্ধতির সুপ্রয়োগ করা যায় না। তাছাড়া এইসব পদ্ধতিতে আর্সেনিক নিরূপণের নিম্নসীমাও খুব কম নয়। কয়েকটি অপেক্ষাকৃত সুপরিচিত পদ্ধতি হল – পোলারোগ্রাফি (Polarography), ডিফারোন্সিয়াল পালস ক্যাথোড স্ট্রিপিং ভোল্টামেট্রি (Differential Pulse Cathode Stripping Voltametry, DPCSV) প্রভৃতি।
নিউট্রন অ্যাকটিভেশন অ্যানালিসিস (Neutron Activation Analysis, NAA) বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষিত নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। এতে নমুনা বা স্যাম্পলকে বিনষ্ট না করেও আর্সেনিকের সমগ্র পরিমাণ নিরূপণ করা যায়, যেমন করা হয়েছিল নেপোলিয়নের চুলের আর্সেনিক নির্ণয়ের বেলায় বা নানা খাদ্য ও তরিতরকারিতে। এর একটা বড় অসুবিধা হল সব জায়গায় রেডিও কেমিক্যাল কাজ করার সুবিধা নেই, পারমাণবিক চুল্লিও (Nuclear Reactor) সর্বত্র নেই। এই পদ্ধতিতে ঘরের বাতাসের তামাকের ধোঁয়ায় 0.2 ন্যানোগ্রাম (0.0002) পর্যন্ত আর্সেনিক নিরূপণ করা গেছে।
আইসোটোপ ডাইলিউশন সাহায্যেও বেশ কিছু পদার্থে আর্শেনিকের মাত্রা নিরূপণ করা গেছে।
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder